রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: ‘চিকু ভাইয়া...চিকু ভাইয়া-আ-আ...।’ ‘ওই দ্যাখ, এ দিকে তাকাচ্ছে। ভাবতে পারছিস, বিরাট কোহলি আমাদের দিকে তাকাচ্ছে!’ ‘কিং, কিং! পুরো রাজা, উফ। হাঁটাচলা দেখলি? কিং কোহলি কি আর এমনি বলে?' ইডেনের ক্লাবহাউস আপার টিয়ারে এখন বিকেলেও আর দু’দণ্ড বসা যায় না। গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহে কলকাতার দশা এমনিই অতিশয় সঙ্গীন। ইডেনে আরও। ক্লাবহাউসের উল্টোদিকের গ্যালারিটা খোলা। মাথার উপর ছাদ-টাদ নেই। কড়কড়ে রোদ চোখ-মুখ ঝলসে দিয়ে চলে যায় নিমেষে। কিন্তু ঠিক সম্মুখে বসে যে যুগল, তাঁদের সামান্য তাতে ভ্রূক্ষেপ আছে তো? চড়া রোদে ঠায় বসে থাকতে ওঁদের কষ্ট হচ্ছে না?
ধুর। কিস্যু হচ্ছে না! বিরাট কোহলির (Virat Kohli) প্রভাব, প্রতিপত্তি, ব্যাপ্তি দেখলে এক-এক সময় বড় বিস্ময় জাগে। বলুন না, ভারতবর্ষের রোদে পোড়া-জলে ভেজা মানুষের দৈনন্দিন সুখের কারণ, মোক্ষলাভের উৎস, দুঃখ-শোক-সন্তাপ ভুলে থাকার আনন্দমেলা হয়ে উঠতে পারেন ক’জন ক্রিকেটার? তা সে যতই এ দেশে ক্রিকেট নিছক খেলার বদলে সর্বধর্ম সম্মেলনের মায়াক্ষেত্র হোক। নাম-যশে বলীয়ান হয়েও দেশজ সুখের প্রতীক হয়ে ওঠার সৌভাগ্য সব ক্রিকেটারের হয় না। কারও কারও হয়। যেমন মহেন্দ্র সিং ধোনি কিংবা বিরাট কোহলি।
তা, সামনে উপবিষ্ট যুগলকে দেখলাম, ‘ভিডিও কল’ করে ইডেনে কোহলির মায়াবী বিচরণ দেখাচ্ছেন কাছের কাউকে। সঙ্গে রেডিও ধারাবিবরণীর আদলে ‘রিলে’ চলছে। ভালবাসার নিরন্তর আকুতি শুনে কোহলিকে দেখলাম, একবার ক্লাবহাউসের দিকে তাকাতে। তার আগে হাতে কালো ব্যান্ডের মতো কিছু একটা মহানন্দে নাচাচ্ছিলেন। নাম ধরে প্রাণান্ত চিৎকার শুনে ঘুরে গেলেন একবার। দেখলেন এ দিক-ও দিক। ঠাওর না করতে পেরে নীল-লাল কিটব্যাগ খুলে খুঁজতে বসে পড়লেন কিছু একটা। শেষে হাতে তুলে নিলেন সেই অস্ত্র, যা গত দেড় যুগ ধরে তাঁর বাধ্য খুব। খুব কথা শোনে। ব্যাট!
রোববার কোহলিকে ব্যাট হাতে এক ঝলক দেখতে খেলার শহরের ক্ষুধা যে কোন অনির্বচনীয় পর্যায়ে গিয়েছে, ইডেন না ঘুরলে বোঝা যাবে না। একটা ছেঁড়া টিকিটও কোথাও পড়ে নেই। দেখলে কে বলবে, খেলাটা দুপুরে? গায়ে জ্বালা ধরানো তাপপ্রবাহের অগ্নিকুণ্ডে! প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক নেট সেশন, ফিল্ডিং সেশন, সমস্ত রগড়ানি পর্ব মিটিয়ে ইডেন ছেড়ে আলাদা গাড়িতে বেরালেন যখন, জনতার চাপে ব্যারিকেডের একটা অংশ দুদ্দাড়িয়ে ভেঙে পড়ল! কোহলির গাড়িকে জনতা ধাওয়া করতে শুরু করল। এঁরাই মাঠে আসবেন আজ, হাতে বিরাট-ব্যাটিং নামক স্বর্গ-দর্শনের প্রত্যাশা নিয়ে। শনিবার সকালে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম, কুইন্টন ডি’ককের স্ত্রী-র পোস্ট করা একটা ছবি প্রবল ভাইরাল হয়েছে। তাঁর ঘড়ির ছবি। যেখানে দেখা যাচ্ছে, লখনউয়ে গতকাল মহেন্দ্র সিং ধোনি ব্যাট করতে নামার সময় শব্দ-ব্রহ্ম ৯৫ ডেসিবেল ছাড়িয়ে উর্ধ্বে উঠে গিয়েছিল। যা মিনিট দশেক ধরে চললে সাময়িক শ্রবণশক্তি হারাতে পারে মানুষ! রোববার ইডেনে বিরাট নামার পর যদি একই কাণ্ড ঘটে, শব্দ-মাত্রা নির্ধারিত সীমার সীমানা ছাড়িয়ে যায়, কিছুমাত্র আশ্চর্যের হবে না।
[আরও পড়ুন: কড়া নিরাপত্তার পরও পুরোপুরি এড়ানো যায়নি হিংসা, মণিপুরে পুনর্নির্বাচন ঘোষণা কমিশনের]
অথচ, ইডেনে আরসিবি-র হয়ে বিরাটের রান ভালো। কিন্তু আহামরি নয়। ১২ ম্যাচে ১১ ইনিংস খেলে রান ৩৫৩। গড় ৩৯.২২। স্ট্রাইক রেট ১২৬.৯৭। একটা সেঞ্চুরি। একটা হাফসেঞ্চুরি। কিন্তু সে সব আর দেখছে কে? কে-ই বা বিন্দুমাত্র ভাবতে যাচ্ছে যে, আইপিএল লিগ টেবলে দশ নম্বরে এখন বিরাট-ডু’প্লেসি-ম্যাক্সওয়েলের আরসিবি? বরং এ দিন বঙ্গ ক্রিকেট-জনতা, বঙ্গ ক্রিকেট-মিডিয়ার আরসিবি ও কোহলি নিয়ে যে আগ্রহের নমুনা চাক্ষুষ করা গেল, তা দেখলে মনে হবে, আরসিবি দুই আর কেকেআর দশ! লিখতে দ্বিধা নেই যে, ইডেনে স্বয়ং কেকেআরকেই (KKR) ‘দুয়োরানী’ দেখাচ্ছিল শনিবার!
এ দিন কোহলি ইডেনে দু’তিনটে জিনিস করলেন। কিছু নেটে। কিছু নেটের বাইরে। কিন্তু কোথাও গিয়ে নেটের বাইরে তাঁর ‘কাজকর্ম’ তুলনায় বেশি আকর্ষক হয়ে থাকল। নেটে আরসিবি-র বাঁ হাতি স্পিনার মায়াঙ্ক ডাগরকে খেললেন লম্বা সময় (স্পিনটা মাঝে-মাঝে ঈষৎ ভোগায় বিরাট রাজাকে)। লেগস্পিনারকে খেললেন কিছুক্ষণ। বাঁ হাতি থ্রো ডাউন স্পেশ্যালিস্টের থেকে থ্রো ডাউন নিলেন। এটাও অনায়াসে বোধগম্য কারণ বিপক্ষে দলে একটা মিচেল স্টার্ক রয়েছেন। আরও কত শত যে মন ভালো করা ছবি যে সৃষ্টি হল শনিবাসরীয় ইডেন জুড়ে! কেকেআরের রিঙ্কু সিংকে দেখা গেল, প্র্যাকটিসের ফঁাকে বিরাটের কাছে গিয়ে ব্যাটে সই করে নিয়ে আসতে। ক্রিকেটারদের ব্যাট সারাই করেন, অজিত শর্মা নামের তেমন একজনকে ইডেনে পাওয়া গেল। যিনি দু’টো তথ্য দিয়ে গেলেন। এক, সুনীল নারিন নাকি নিকোলাস পুরানের ব্যাট দিয়ে আইপিএল খেলছেন। আর দুই, বিরাট যে ব্যাটটা চিন্নাস্বামীতে উপহার দিয়েছিলেন, সেটা ঠিকঠাক করে দিতে বলেছেন রিঙ্কু। বিরাটের উপহার দেওয়া ব্যাট নিয়ে নাকি ইডেনে নামতে পারেন নাইট-নায়ক! সত্যি-মিথ্যে ভুলে যান। নির্যাসটা দেখুন। সমগ্র ইডেনে যেন একটাই চরিত্র। পার্শ্বনায়করা যাঁকে প্রদক্ষিণ করছে ‘বিভূতি’-র সন্ধানে।
কিন্তু দেখতে গেলে, কেকেআর আর আরসিবি-র কোনও তুলনাই হয় না। ট্রফি সংখ্যায় হয় না। অধুনা ফর্ম অনুপাতে হয় না। লিগ টেবল অবস্থানে হয় না। ইডেন রেকর্ড বিচারে হয় না। আজ পর্যন্ত ইডেনে ১১ বার দেখা হয়েছে কেকেআর আর আরসিবি-র। নাইটরা জিতেছে সাত বার। এবারই চিন্নাস্বামীতে যুদ্ধের প্রথম পর্বে আরসিবিকে (RCB) উড়িয়ে এসেছে। কেকেআর এ পর্যন্ত ছ’টা ম্যাচ খেলে জিতেছে চারটেয়। আরসিবি সাতটা খেলে জিতেছে মাত্র একটায়! ট্রফিতেও তো। আইপিএল ট্রফি কেকেআরের দু’টো। আরসিবি-র ভাণ্ডে তিনবার ফাইনাল ছাড়া কিছু নেই। তার উপর গম্ভীর মেন্টর হিসেবে ফিরে আসার পর নাইটদের আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। ঘরের মাঠে যাদের একমাত্র ছুটকো চিন্তা বলতে ‘ডেথ ওভার’ বোলিং।
সোনালি-বেগুনির হয়ে শনিবার প্রেস কনফারেন্স করতে এসেছিলেন পেসার বৈভব অরোরা। বলে গেলেন, “গত ম্যাচে ডেথ ওভারে আমরা ভালো বোলিং করতে পারিনি। কিন্তু তার আগের ম্যাচে ভালো পারফর্ম করেছিলাম। তাই ভাবনা খুব একটা নেই।” কেকেআরের দিক থেকে দেখলে, গোটা আরসিবি নিয়ে ভাবনার নাম তিনটে। বিরাট (৭ ম্যাচে যাঁর রান ৩৬১, ৭২ ব্যাটিং গড়, স্ট্রাইক রেট ১৪৭.৩৪)। অধিনায়ক ফাফ ডু’প্লেসি। এবং দীনেশ কার্তিক। শেষের জন আবার প্রাক্তন নাইট অধিনায়ক। ক’বছর আগেও এই ইডেন, কেকেআর, যাঁর ‘বসতভিটে’ ছিল। আইপিএল (IPL 2024) জুড়ে দুর্ধর্ষ ফর্মে থাকা কার্তিককে (৭ ম্যাচে ২২৬ রান, গড় ৭৫.৩৩, স্ট্রাইক রেট ২০৫.৪৫) জিজ্ঞাসাও করা হল, এ সমস্ত ব্যাপার রোববার ইডেনে তাঁর সুবিধে করে দেবে কি না? স্মিত হেসে ভারতীয় ক্রিকেটের ‘ডিকে’ উত্তর দিলেন, “সুবিধে হলে ভালোই হয়। কেকেআর ভালো টিম। তবে আমি আরসিবি-র হয়ে নিজের সেরাটা দিতেই কাল নামব।” কার্তিক আরসিবি বাদে অন্য টিমে খেললে এ নিয়েই লেখা যেত। শিরোনাম হত। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁর! তিনি খেলেন এমন এক টিমে, যার এক ব্রহ্ম, এক সূর্য, এক চন্দ্র। এক এবং একমাত্র বিরাট কোহলি!