টোসিস রোগের জেরেই দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসেছিলেন জিনাত আমান। চল্লিশ বছর ধরে এই সমস্যার সঙ্গে লড়াই করেছেন তিনি। কতটা মারাত্মক এই সমস্যা? জানালেন অপথালমোলজিস্ট ডা. পূর্বান গঙ্গোপাধ্যায়।
চোখের সমস্যা মানেই যে তা অভ্যন্তরীণ সমস্যা হবে তা কিন্তু নয়। চোখের বাইরেও এমন কিছু হয়, যা দৃষ্টিশক্তির ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে আবার সৌন্দর্যের পথেও কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। জিনাত আমনের মতো অভিনেত্রীও চোখের এমনই এক অসুখের কারণে দীর্ঘদিন সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পাননি। কী এই অসুখ? টোসিস (Ptosis)।
এটি চোখের পাতার পেশির সমস্যা। পেশি অকেজো হয়ে গেলে চোখের উপরের পাতা ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে শুরু করে। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে জিনাত আমন এই অসুখে আক্রান্ত ছিলেন। ধীরে ধীরে ক্ষীণ হচ্ছিল দৃষ্টিশক্তি। সম্প্রতি অপারেশনও হয়েছে।
ঠিক কী হয় এই অসুখে?
এই অসুখে চোখের উপরের পাতা নিচের দিকে নেমে আসতে থাকে। তাই টোসিসকে আই ড্রুপিংও বলা হয়। এই উপরের পাতা নিচের দিকে নেমে আসা চারটি কারণে হতে
পারে। সবচেয়ে মারাত্মক হয়, কনজিনেটাল টোসিস বা জন্মগত ত্রুটির কারণে টোসিস।
এক্ষেত্রে জন্ম থেকে চোখের উপরের পাতাটি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে নেমে থাকে। আসলে চোখের পাতা শাটারের মতো কাজ করে। এর কোনও বিরাম নেই। মিনিটে ৩০ বার উপরে-নিচে ওঠানামা করে।
জন্মগত কারণে পাতার পেশি দুর্বল হলে তখন হয় কনজিনেটাল টোসিস। কার কতটা পাতা নেমে থাকবে তার উপরে সমস্যার গভীরতা নির্ভর করে। অল্প নেমে থাকলে তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু চোখের পাতা যদি বেশি নেমে থাকে তাহলে সমস্যা হয়। শিশুদের এক্ষেত্রে চোখ পুরো না খোলা থাকলে চোখে আলো প্রবেশ করে না। ফলে অপটিক নার্ভ দুর্বল হয়ে পড়ে। একে লেজি আই বা অ্যামব্লায়োপিয়া বলা হয়। যদি সময়ে এই অসুখের চিকিৎসা না করা হয় তাহলে নার্ভ সারাজীবনের মতো দুর্বল হয়ে যায়। ফলে শিশু দেখতে শেখে না, সারাজীবনের মতো অন্ধ হয়ে যায়। তাই জন্মের পর টোসিস থাকলে তখনই অপারেশন করার দরকার।
এছাড়া মার্কাস গান ফেনোমেনা হলে অর্থাৎ শরীরের যে পেশি আমাদের খাবার চিবাতে সাহায্য করে, তার সঙ্গে যে নার্ভ যুক্ত যেগুলি যদি, চোখের উপরের পাতাকে তুলতে যে নার্ভ সাহায্য করে তার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় তখন টোসিস হয় অর্থাৎ চোখের পাতা পড়ে যায়। আবার দেখা যায়, এই কারণে কেউ কিছু খাওয়ার সময় বা চিবানোর সময় চোখের পাতা ওঠানামা করতে থাকে। অনেকটা এরকম, কিছু খাওয়ার সময় মনে হবে সে চোখ মারছেন ব্যক্তিটি। আসলে তাঁর চোখের পাতা পড়ে যেতে থাকে চিবানোর সঙ্গে সঙ্গে।
[আরও পড়ুন: শীতে জুতো পরলে মোজায় গন্ধ! সমস্যার সমাধান হবে ঘরোয়া উপায়েই, রইল টিপস ]
দ্বিতীয় কারণ, নিউরোজেনিক টোসিস। এক্ষেত্রে কোনও কারণে যেমন মাথার ভিতরে স্ট্রোক ইত্যাদি কারণে নার্ভ প্যারালাইসিস হলে তা থেকে টোসিস হতে পারে। এটা হঠাৎ করেই হয়। সাধারণত হাই সুগার, প্রেসার ইত্যাদি কারণে হঠাৎ স্ট্রোক হলে তা থেকে এমন হয়। তাই চোখের পাতা হঠাৎ পড়ে গেলে এমআরআই করার প্রয়োজন পড়ে, কেন নার্ভ অকেজো হয়ে গেল তা দেখতে হয়। সাধারণত ৪০ ঊর্ধ্বদের এটা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এক্ষেত্রে নার্ভের চিকিৎসা করা প্রয়োজন। অপারেশন করে ঠিক করতে হয়।
তৃতীয় কারণ, মায়োজেনিক টোসিস। এক্ষেত্রে মায়াস্থেনিয়া গ্রেভিস অসুখ থেকে চোখের পাতা পড়ে যায়। চোখের পাতার পেশিতে সে নার্ভগুলো রয়েছে সেগুলি যখন পেশিকে ইনফরমেশন পাঠায়, তখন পেশি কাজ করতে শুরু করে। এই ইনফরমেশন পাঠানোর কাজটায় যখন গন্ডগোল হয়ে যায় তখনই মায়োজেনিক টোসিস হয়। এক্ষেত্রে নিউরোন ও পেশির সংযোগস্থলে সমস্যা হয়। ফলে পেশি ঠিক মতো জাগ্রত হয় না। এক্ষেত্রে দিন যত এগোতে থাকে ধীরে ধীরে চোখের পাতা নিচের দিকে নামতে থাকে। এই অসুখ বিভিন্ন টেস্ট করে নির্ণয় করা হয়। এই টোসিসের ক্ষেত্রে অপারেশন লাগে না, ওষুধেই চিকিৎসা করা সম্ভব।
শেষ কারণ হল, অ্যাপোনিউরেটিক টোসিস। এই সমস্যা বয়সকালে হয়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের সমস্ত স্থানের চামড়া ও পেশি শিথিল হতে থাকে। চোখের পাতাতেও যে চামড়া
বা পেশি আছে তা শিথিল হয়ে পড়ে। খুব বয়সকালে তাই চোখের উপরের পাতা নিচের দিকে নেমে যায়। এক্ষেত্রে দেখার সমস্যা হলে তখন অপারেশন ছাড়া গতি নেই।
কারণ, অনুযায়ী রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা আলাদা। এই অসুখ ছোট থেকে বড় সকলেরই হতে পারে উক্ত কারণে। তাই সময়ে সাবধান হন। একমাত্র মায়োজেনিক টোসিস ওষুধের দ্বারা ঠিক করা সম্ভব। বাকি কারণে হলে অপারেশন লাগবে। তাই উপরের চোখের পাতা ঝুলে পড়লে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। না হলে দেখতে সমস্যা হয়, অনেক সময় দেরি হলে অপারেশনে সাড়া মেলে না। সারাজীবন দেখার সমস্যা থেকেই যায়।
জিনাত আমন এখন সুস্থ। আবার ফিরছেন অভিনয়ে। মণীশ মালহোত্রা পরিচালিত ‘বানটিক্কি’ সিনেমায় অভয় দেওল, শাবানা আজমির সঙ্গে অভিনয়ও করছেন। এখন উন্নত চিকিৎসায় এই অসুখ থেকে মুক্তি সম্ভব। শুধু দরকার সময়ে সচেতনতা।