shono
Advertisement

অবসাদ শুধু বড়দের নয়, শিশুমনেও থাবা বসাচ্ছে, দায় কার?

বাবা-মায়েরও তো কিছু ভূমিকা আছে।
Posted: 07:28 PM Jul 11, 2023Updated: 07:28 PM Jul 11, 2023

অবসাদ শুধু বড়দের নয়, শিশুমনেও থাবা বসিয়েছে। যার পূর্বসূত্র হল ইঁদুর দৌড়ে পিছিয়ে পড়া। যা থেকেই হীনমন‌্যতা শুরু। কাজেই ছোট থেকেই শিশুমনকে ঠিক করে গড়ে তুলুন। এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভূমিকা অন্যতম। বুঝিয়ে বললেন সাইকিয়াট্রিস্ট  ডা. অংশুমান দাশ। শুনলেন জিনিয়া সরকার।

Advertisement

ঘরে ঘরে বকাবকি চলছে। সন্তান যদি আশানুরূপ ফল করতে না পারে তাহলে মা-বাবার বকুনির প্রতিক্রিয়া নানা ভাবে ব্যক্ত হয়। কখনও অতিরিক্ত একগুঁয়েমি প্রকাশ পায়। কখনও আবার একাকীত্বে ভুগতে শুরু করে শিশু। কারও কারও কনফিডেন্স তলানিতে চলে যায়। ধীরে ধীরে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে ও শিশু বিপথগামী হয়।

প্রথমেই যেটা বলব, সন্তান যদি কোনও ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় তাহলে একেবারেই বকাবকি করবেন না। এখান থেকে শিশুমনে হীনমন্যতার অঙ্কুরিত হয়। আত্মবিশ্বাসের ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে যায়। ভুলটা এখান থেকেই শুরু। যার মাশুল দিতে হবে সারাজীবন।

পৌলমী দত্ত, সবে ১০ বছর বয়স। ক্লাস ফাইভে পড়ে, মায়ের সঙ্গে চেম্বারে এসেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা জানায়, কিছুতেই পড়াশোনায় মেয়ের মন বসছে না। হঠাৎ করেই খুব খারাপ রেজাল্ট করতে শুরু করেছে। নানা কথা বলে বুঝতে পারলাম অসম্ভব মানসিক চাপে রয়েছে। হীনমন্যতায় ভুগছে মেয়েটি। সঙ্গে বাবা-মায়ের বকাবকি, অন্যের ভাল উদাহরণ টেনে মেয়ের উপর রাতদিন শুধু আরও ভাল করতে হবে, খারাপ রেজাল্ট হলে লোকে কী বলবে এমন নানা পারিপার্শ্বিক চাপ রয়েছে। সব মিলিয়ে চরম হতাশা।

অল্পবয়সীদের মধ্যে অল্পতেই হাল ছেড়ে দেওয়ার মানসিকতা এখন খুব বেশি। আসল খামতি কোথায় জানেন? এদের ফাইটিং স্পিরিট গড়ে উঠছে না। অবসাদে খেই হারিয়ে ফেলছে জীবনের।

পরিস্থিত যা-ই আসুক মনে রাখতে হবে, রণে ভঙ্গ দেওয়া চলবে না। জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া মানে পিছিয়ে যাওয়া। লড়াই করে টিকে থাকতে পারার নামই জীবন। বাবা-মায়েরা এইভাবে যদি সন্তানকে না ভাবান, না বোঝান, তাহলে বাচ্চারা ছেলেবেলা থেকেই কিন্তু অনেকের থেকে অনেকটা পিছিয়ে গেল। সোজা কথায়, ফাইটিং স্পিরিট না থাকলে জীবনটা নেগেটিভিটিতে ভরে উঠবে।

অবসাদ থেকে ছেলে-মেয়েদের মুক্তি দেবেন কীভাবে, কীভাবে মনের জোরে লড়তে পারবে ওরা, এটা শেখানোই আসল শিক্ষা।

ওয়েলকাম ফেলিওর
সন্তান কোনও কিছুতে ব্যর্থ হলে তাকে তা হাসিমুখে বরণ করতে শেখান। যদি পরীক্ষায় কম নম্বর পায় বা কোনও কাজে আশানুরূপ ফল হল না সেক্ষেত্রে তাকে বাবা-মায়েরা বকাবকি করলে তার মন আরও ভেঙে যায়। উলটে বলুন, একবার খারাপ হয়েছে তো কী হয়েছে, চেষ্টা করলে ভাল হবেই। খারাপটাকে শিশুর কাছে বড় করে তুলে না ধরে বরং খারাপটার জন্যই তার একদিন আরও ভাল হবে এটা বোঝানো খুব দরকার। শিশুকে ছোট থেকে এই পাঠ দিয়ে বড় করতে হবে। তবেই ধীরে ধীরে মনের জোর বাড়বে একজনের।

কথায় আছে, কাদার তাল যখন নরম থাকে তখন তাকে যে ভাবে গড়তে চাইবে সেই ভাবেই গড়ে তোলা সম্ভব। সেই মাটিতেই অসুর গড়ে তোলা যায় আবার দেবী দুর্গাও গড়ে তোলা যায়। তেমনই শিশু মন। শিশুর কোমল মনকে যে ভাবে তার বাবা-মা গড়ে তুলবে সেই ভাবেই শিশু জীবনে চলার পথে মনকে চালনা করবে।

কেন খারাপ হয়েছে, বিশ্লেষণই সমাধান
সন্তানের খারাপ সময়ে তাকে মনে আশা জাগাতে হবে। তাকে নিরাশ না করে, নেতিবাচক কথা না বলে পরিস্থিতিটা কেন প্রতিকূলে গিয়েছে সেটা একসঙ্গে বসে বিশ্লেষণ করে শিশুকে বোঝাতে হবে। কোন কোন জায়গায় ঘাটতি ছিল, কীভাবে সেটা শুধরে নেওয়া যায় এসব ব্যাপারে আলোচনার মাধ্যমে সন্তানের মনের জোর বাড়াতে হবে। হাতে ধরিয়ে শিখিয়ে দিতে হবে তাকে। দুর্বল জায়গাগুলোকে আরও শক্তপোক্ত করার শিক্ষা দিতে হবে নরম ভাবে, ভালবেসে বুঝিয়ে। ঠিকভাবে শিশুকে গাইড করলে তবেই সে মনের জোরে যে কোনও খারাপ পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর শিক্ষালাভ করবে।

[আরও পড়ুন: সাবধান! জনপ্রিয় এই দুই অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ আপনার ব্যক্তিগত তথ্য পাঠাচ্ছে চিনে! ]

যতটুকু ক্ষমতা ততটুকুই করো
প্রত্যেকটি মানুষের কাজের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। স্বপ্ন থাকতে পারে, কিন্তু কখনওই তা নিজের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে ভাবা চলবে না। কারও ফুটবল খেলতে ভাল লাগে মানেই সে চাইলেই মেসির মতো খেলবে এটা হয় না। যার যতটা ক্ষমতা সে ততটাই পারবে। তাই অযথা চাপ দিয়ে কারও পোটেনশিয়াল বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। বাবা-মাকে বুঝতে হবে সন্তানের শারীরিক, মানসিকভাবে কোনও কিছু গ্রহণ করার ক্ষমতা কতটা। সকলের বুদ্ধিমত্তা সমান হয় না। যার যেমন, সে ততটাই পারবে। এই অতিরিক্ত চাপ কারও উপরে চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। তখন একজনের মনে হীনমন্যতা জন্ম নেয়। আত্মবিশ্বাস দুর্বল হতে থাকে। কঠিন পরিস্থিতিতে সহজে হার স্বীকার করে নেয়। এগুলো না করাই ভাল। ছোট থেকেই নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী পা ফেলতে শেখানো জরুরি।

মা-বাবার ইচ্ছে সন্তানের উপরে চাপাবেন না
সন্তান যে বিষয় পড়তে ভালেবাসে, যে চাকরি করে আনন্দ পায় সেগুলোই তাকে করতে দিন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখি বাবা-মায়ের ইচ্ছেকে সন্তানের উপর চাপিয়ে দেওয়ার হচ্ছে। এটা করবেন না। বরং সন্তানের স্ট্রং পয়েন্ট কোন বিযয়ে রয়েছে সেগুলি বিবেচনা করে, বুঝে সেই মতোই তাকে এগিয়ে যেতে পরামর্শ দিন। তবেই সে একদিন ডানা মেলে উড়তে পারবে, এতে সে তার ভিতরের প্রতিভাকে আরও সাবলীলভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হবে। আর যদি তা না করে উলটোটা বলা হয়, এটা পড়লে ভাল, এই অমুকে এটা করে, তাই তাকেও এটা করতেই হবে, না হলে খারাপ হবে- এধরনের কথার প্রভাবে শিশু মনের ক্ষতিই হয়। বারবার সন্তানকে এভাবে বলতে থাকলে সে যেটুকুও ভাল করতে পারত, সেটা করার জন্যও মনের জোর ক্রমশ হারিয়ে ফেলবে। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

সৎ পথেই সফলতা আসে
জীবনে কিছু পেতে গেলে তার জন্য কষ্ট করতে হবে, চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিজের প্রতিটি বিষয়ে সৎ থাকা। সৎ পথে চললে পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক শেষে ভালই হবে। চলার পথে সততা বজায় রাখা আসলে শরীরের ডায়েটের মতো মনের হেলদি ডায়েট। আর ভালর কোনও শেষ নেই, তাই চেষ্টা করে যেতে হবে, নিজের সেরাটা প্রতি ক্ষেত্রে দিয়ে যেতে হবে। হতাশা নিয়ে বসে থাকলে হবে না। তাহলেই সফল হতে পারবে।

ফাইটিং স্পিরিট কম, বুঝবেন কীভাবে?
যাদের জীবনে নেতিবাচক ঘটনা বেশি রয়েছে তাদের ফাইটিং স্পিরিট কম হয়। কারণ মনে অবসাদের মেঘ জমে থাকে। তা থেকেই মনের জোর হারায় একজন। যে লক্ষণ দেখলে একজন সতর্ক হবেন তা হল,
কোনও কাজ করাক আগেই নেতিবাচক চিন্তা করা। আমি পারব না বলে, পিছিয়ে আসা।
কোনও লড়াই করার পরিস্থিতি এলে প্রথমেই হার মেনে নেওয়া, মুখ ফিরিয়ে নেওয়া।
হেরে গেলে আবার পুনরায় চেষ্টা না করা।
চ্যালেঞ্জ নেওয়ার বদলে ভয়ে কান্নাকাটি বা অতিরিক্ত জেদ করা।

কখন মেডিক্যাল সাপোর্ট প্রয়োজন
একজনের মনের জোর গড়ে তুলতে একদম ছোট থেকে কীভাবে মানুষ হচ্ছে একজন, এটা যেমন খুব গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সেরোটোনিন হরমোনের খেলা রয়েছে এর পিছনে। মস্তিষ্কে এই হরমোনের ঘাটতি হলে অবসাদ বাড়ে বা ফাইটিং স্পিরিট ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকে। হতাশা, নিজের প্রতি বিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়।
এক্ষেত্রে অ্যান্টি ডিপ্রেসেন্ট ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা করে সেরোটোনিন হরমোনের মাত্রা বাড়ানো যায়।
প্রয়োজনে অ্যাংজাইটির ওষুধও দেওয়া হয়। এর সঙ্গে দরকার সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং করা।
রুটিন মেনে চলার নির্দেশও দেওয়া হয়। ঠিক সময়ে ঘুম, খাওয়া, ব্যায়াম খুব জরুরি।
নিত্য মেডিটেশন খুবই উপকারী।

জীবনযাপনে বাড়বে মনের জোর
ছোটবেলা থেকেই ইতিবাচক পরিস্থিতিতে শিশুকে মানুষ করুন।
খালি পুঁথিগত বিদ্যা নয়, পাঠ্যপুস্তকের বাইরে সামাজিকভাবেও একজনকে গড়ে তুলতে হবে। স্বামীজির কথায়, মানুষ গড়ার শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া দরকার।
সারাদিন ঘরে বসে না থেকে কম্পিটিটিফ স্পিরিট বাড়াতে হবে। তাই পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে শিশুকে বাইরে খেলতে পাঠান। মোবাইল গেমের চেয়ে ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেললে শরীরের পাশাপাশি মনের গঠনও ভাল হবে। হেরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পায় মন।
নিজের রেজাল্ট একটু খারাপ হয়েছে আর বন্ধু ভাল নম্বর পেয়েছে। এক্ষেত্রে বন্ধুকে বাহবা দিতে শিখতে হবে। অন্যের ভাল দেখলে ইর্ষাকাতর হওয়া সংকীর্ণ মানসিকতার পরিচয়। এতে নিজের মনেই চাপ বাড়ে।
শিশুদের অবসর সময়ে মনীষীদের জীবনী, ভাল নীতিকথা যুক্ত গল্পের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

[আরও পড়ুন: গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব শরীরের উপর কীভাবে পড়ছে? জানালেন বিশিষ্ট জ্যোতিষী ]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement