আধুনিক প্রযুক্তি সহযোগে গঠিত নির্ভুল কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থারই নাম হল Precision Farming বা যথার্থ কৃষি। স্থানভিত্তিক পরিচালন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে (দূরবর্তী সংবেদন বা Remote sensing ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা বা GIS এবং বিশ্বজনীন অবস্থান নির্ণায়ক ব্যবস্থা বা GPS) একটি স্থানিক পরিবর্তনশীলতার নিয়মিত মূল্যায়ন করা হয়। এবং সেইমতো কৃষি জমিটির মধ্যেকার ফসল এবং মাটির যে পরিবর্তন পরিলক্ষিত করা যায়, তা চিহ্নিত করে মানচিত্রে চিত্রাঙ্কিত করা হয় এবং সেই অনুযায়ী কী রূপ পরিচালন ক্রিয়া গ্রহণ করতে হবে, তা ধার্য করা হয়। লিখেছেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সৌরভ রায়।
শেষ পর্ব (দ্বিতীয় পর্ব)
সেন্সর প্রযুক্তি: সেন্সর হল এক ধরনের যান্ত্রিক ব্যবস্থা যা পরিবেশের কোনও ঘটনার (শক, তাপ, আলো ইত্যাদি) প্রতি সাড়া দিতে পারে। মূলত সেন্সর হচ্ছে এক ধরনের কনভার্টার বা পরিবর্তনকারী যা পরিবেশগত কোনও পরিবর্তনকে একটি সিগন্যালে পরিণত করে এবং তা পরবর্তী একটি মাধ্যমে পড়া যায়। বর্তমানে ইলেকট্রনিক্সে সেন্সর বহুল পরিচিত একটি ডিভাইস। এটি কোনও পরিবেশগত পরিবর্তনকে বৈদ্যুতিক সিগন্যালে রূপান্তর করে। বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত কয়েকটি ইলেকট্রনিক্স সেন্সরের মধ্যে কন্ট্যাক্ট সেন্সর, টেম্পারেচার সেন্সর, দূরত্ব সেন্সর, প্রক্সিমিটি সেন্সর, পজিশন সেন্সর, ফোটো ডায়োড এবং টাচ সেন্সর উল্লেখযোগ্য। এই সেন্সর প্রযুক্তির সাহায্যে কৃষিক্ষেত্রের আপেক্ষিক আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, বাতাসের প্রবাহমাত্রা এবং উৎপাদিত ফসলের আকার, গঠন প্রভৃতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান আহরনণ সম্ভব হয়েছে। সেন্সর প্রযুক্তি গবেষণাগারে বিশ্লেষণের প্রয়োজন ছাড়াই বিপুল পরিমাণে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে কৃষি গবেষণার কাজকে সহজ করে তুলেছে।
দূরবর্তী সংবেদন বা রিমোট সেন্সিং: Remote Sensing হল কোনও বস্তুকে সরাসরি স্পর্শ না করে সেই বস্তু থেকে তার গুণাবলি সম্পর্কিত উপাত্ত সংগ্রহ করা এবং পর্যবেক্ষণ করার এক ধরনের কৌশল। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সেন্সর বা ডিভাইস ব্যবহার করা হয়। সাধারণত এই প্রযুক্তি বলতে তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণের দ্বারা মহাকাশ এবং পৃথিবী পর্যবেক্ষণকে বোঝানো হয়। যদিও এর মানে শুধু মহাকাশ হতে পর্যবেক্ষণ বোঝানো একেবারে ঠিক হবে না কারণ, Radar ও Lidar-এর সাহায্যে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে সিগন্যাল পাঠিয়ে দূরবর্তী সংবেদনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয় দূরবর্তী সংবেদন বা দূর অনুধাবন কৌশলে বেশ কিছু সেন্সর ব্যবহার হয়, সেগুলো হল ক্যামেরা, লেজার, রেডিও তরঙ্গ গ্রহণকারী রিসিভার বা সংগ্রাহক, রাডার ব্যবস্থা, সনার, সিসমোগ্রাফ, গ্রাভিমিটারস, ম্যাগনেটোমিটার ইত্যাদি।সাদা ডিম্বাকৃতির এবং কালো ডানা যুক্ত যান্ত্রিক পাখি কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহারের মাধ্যমে রিমোট সেন্সিং প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হয়। এদের সাধারণত ড্রোন বলে অভিহিত করা হয়। প্রথমে দূরে থাকা (রিমোটলি) ড্রোন ও কক্ষপথে থাকা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ফসলের ‘হাই রেজলিউশন’ ছবি তোলা হয়। এতে ব্যবহৃত হয় ‘মাল্টিস্প্রেক্টাল ক্যামেরা’ বা ‘বহুমুখী দৃশ্যতা ক্যামেরা এবং থার্মাল ক্যামেরা বা তাপ পরিমাপক ক্যামেরা। মাল্টিস্পেক্টাল ক্যামেরার মাধ্যমে ফসলে নির্দিষ্ট কোনও রোগ, পোকার আক্রমণ হলে তা জানা যায় এবং ফসলের উৎপাদন ও বৃদ্ধি সম্পর্কিত তথ্য সর্বত্র করা হয়। এই তথ্য দিয়ে ফসলে সার, রাসায়নিক এবং কীটনাশকের প্রয়োজনীয়তা ও পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। আর থার্মাল ক্যামেরা দিয়ে ফসলের তাপমাত্রা পরিমাপ করা হয়। ফসলের তাপ দেখে কৃষিক্ষেত্রে জলসেচের প্রয়োজনীয়তা, সময় নির্ধারণ করা হয়।
ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা বা Geographical Information Systems-GIS: ভূপৃষ্ঠের কোনও স্থান সম্পর্কিত উপাত্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য গৃহীত প্রযুক্তি হল GIS, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানচিত্রে উপগ্রহ চিত্রে উপস্থাপিত পারিসরিক তথ্যের বিভিন্ন লেয়ার বা স্তর সহজ উপায়ে ব্যাখ্যা করা যায় এবং এদের মধ্যেকার পারিস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় করা যায়। আধুনিককালের পার্সোনাল কম্পিউটার বা পিসি থেকে শুরু করে সুপার কম্পিউটার পর্যন্ত সকল প্রকার কম্পিউটারে জিআইএস ব্যবহার করা হয় এবং বর্তমানে একাধিক সফটওয়্যারে জিআইএস সহজলভ্য হয়েছে। তবে জিআইএস স্থাপনার জন্য বেশ কিছু উপকরণ প্রয়োজন, যেমন কম্পিউটার, ডিজিটাইজার, জিপিএস, প্লটার, নেটওয়ার্ক, সিডি-রম, ড্রাইভ, প্রিন্টার এবং জিআইএস ভিত্তিক সফটওয়্যার, যেটি এ সকল উপকরণকে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে প্রোগ্রামটিকে কার্যক্ষম করে। কৃষিক্ষেত্রে জিআইএস প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল বিভিন্ন স্তরের তথ্যাবলি সুংসহতভাবে সঞ্চয় করা, যেমন-ফসলের ফলন সংক্রান্ত তথ্য, মাটি জরিপের মানচিত্র, দূরবর্তী সংবেদনকারী বা রিপোর্ট সেন্সড তথ্য, মাটির পুষ্টি সংক্রান্ত তথ্য ইত্যাদি। এইসব তথ্যাবলি ব্যাখ্যার জন্য কোনও ভিজুয়াল দৃষ্টিকোণ যুক্ত করার মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যাবলি দৃষ্টিগোচর করানো হয়।
গ্রিড সয়েল স্যাম্পলিং: নির্দিষ্ট জমিতে পুষ্টি ঘনত্বের বৈচিত্র অর্জনের উদ্দেশ্যে মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। গ্রিড স্যাম্পলিং প্রচুর পরিমাণে নমুনা সংগ্রহের মাধ্যমে সেই বৈচিত্রগুলো ক্যাপচার করার চেষ্টা করে। গ্রিড স্যাম্পলিং সাইট বা স্থান নির্দিষ্ট মাটি পরিচালনার জন্য অনুকূল পদ্ধতি। নমুনা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের পর, গ্রিড সেল পদ্ধতিতে ম্যাপ পরীক্ষার মান দিয়ে মাটির পরীক্ষার মান একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে স্থির করা হয় এবং তারপর পয়েন্টগুলোর মধ্যে বিভাজন দ্বারা মানচিত্র গঠন করা হয়। গ্রিড সয়েল স্যাম্পলিং পদ্ধতিটি গতানুগতিক পদ্ধতির মাটির নমুনা সংগ্রহের মতো একই নীতিতে কাজ করে কিন্তু নমুনা সংগ্রহের ঘনত্বের বিচারে গ্রিড স্যাম্পলিং পদ্ধতিটি সাধারণ স্যাম্পলিং থেকে আলাদা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি ২০ একর কৃষিক্ষেত্রে ২ একর গ্রিড স্যাম্পলিং পদ্ধতি ব্যবহার করলে কৃষিক্ষেত্রটি মেটা দশটি নমুনা থাকবে এবং প্রতিটি নমুনা বা স্যাম্পল একটি আরেকটির থেকে ৩০০ ফুট দূরে অবস্থান করবে।
ভ্যারিয়েবল রেট অ্যাপ্লিকেশন: নির্ভুল কৃষিতে ভি.আর.এ. হল এমন এক প্রযুক্তি যা, বিভিন্ন কৃষিজ ইনপুটগুলো যেমন জল, খনিজ পদার্থ, সার, কীটনাশক ইত্যাদির ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত করে এদেরকে স্বয়ংক্রিয় করে তোলে। পদ্ধতিটি গতানুগতিক প্রয়োগের থেকে আলাদা এবং অর্থ সাশ্রয় করতে ও পরিবেশগত প্রভাবকে হ্রাস করতে সাহায্য করে। ভি.আর.এ পদ্ধতিতে কোথায়, ঠিক কতটা উপাদান প্রয়োগ করতে হবে, তা সেন্সর, মানচিত্র ইত্যাদির মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যাবলি বিচার করা যায়।
Precision Farming-এর প্রাথমিক পদক্ষেপ সমূহ:
১। বৃহত্তর কৃষিক্ষেত্রের পরিবর্তনশীলতা বা প্রকরণ (Variation) গুলোকে চিহ্নিত করা।
২। ছোট ছোট প্রকরণ বা Variation গুলোকে পৃথকভাবে পরিচালনা করা।
৩। মূল্যায়ন বা গুণগ্রাহিতা বিচার।নির্ভুল কৃষিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জামের দ্বারা আমরা কোনও বৃহত্তর কৃষিক্ষেত্রের ছোট ছোট Variation-গুলোকে সহজেই চিহ্নিত করতে পারি এবং স্থান নির্দিষ্ট কৃষি সংক্রান্ত সুপারিশকে মান্যতা দিয়ে পৃথক পরিচালন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এবং সবশেষে সমগ্র ক্রিয়াকলাপের সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে আমরা Precision Farming-এর সুযোগ-সুবিধা যাচাই করতে পারি।
ভারতে Precision Farming-এর বর্তমান অবস্থা: ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে এখনও স্বমহিমায় Precision farming-এর প্রয়োগ শুরু হয়নি। তবে, সম্প্রতি, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার তত্ত্বাবধানে এবং সহযোগিতায় সিমলায় ভারতীয় আলু গবেষণা কেন্দ্রে Precision farmign-এ দূরবর্তী সংবেদন বা Remote Sensing এর ভূমিকা অন্বেষণ শুরু হয়েছে। আমেদাবাদের স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টারের আর্থিক সহযোগিতায় পাঞ্জাবের জলন্ধরের আলু গবেষণা কেন্দ্রের আওতাধীন আঞ্চলিক স্টেশনে নির্ভুল কৃষির ব্যবহার হচ্ছে। মধ্যপ্রদেশের ভোপালে অবস্থিত কেন্দ্রীয় কৃষি প্রকৌশল ইনস্টিটিউট-এর তত্ত্বাবধানে মিরাটের ক্রপিং সিস্টেম রিসার্চ প্রকল্প অধিদপ্তর Precision farming-এর বিভিন্ন প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেখানে কৃষিতে Variable rate application প্রযুক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। চেন্নাইয়ের স্বামীনাথন রিসার্চ ফাউন্টেশন জাতীয় কৃষি ও পল্লি উন্নয়ন ব্যাংকের (NABARD) সাহায্যে তামিলনাড়ুর দিনদিগুল জেলার একটি গ্রামকে দত্তক নিয়েছে এবং সেখানে নির্ভুল কৃষি পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রগতিশীল কৃষকদের আর্থিক অবস্থা উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
Precision farming-এর প্রতিকূলতা: ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নির্ভুল কৃষির ব্যাপারটি এখনও ধারণা হয়েই রয়ে গিয়েছে।
নির্ভুল কৃষি পদ্ধতি প্রয়োগের অসুবিধাগুলো হল:
১। ব্যবহারকারীদের গতানুগতিক সংস্কৃতি এবং নির্ভুল কৃষি সম্পর্কে ভ্রান্ত উপলব্ধি।
২। ভারতে মোট জনসংখ্যার ৫৭.৮ শতাংশেরও বেশি মানুষের ১ হেক্টরের চেয়েও কম জমি রয়েছে। ছোট জমিতে নির্ভুল কৃষি পদ্ধতির সঠিক প্রয়োগ সম্ভব নয়।
৩। নির্ভুল কৃষি পদ্ধতি ব্যবহারের দরুন সাফল্যের অভাব।
৪। শস্য ব্যবস্থায় বিষম স্বত্ব এবং বাজারের অসম্পূর্ণতা।
৫। নির্ভুল কৃষি ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা এবং মালিকানা ও উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব।
৬। দেশীয় প্রযুক্তিগত অনভিজ্ঞতা।
৭। জ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত ফাঁক।
৮। নির্ভুল কৃষি সরঞ্জামের উচ্চমূল্য।
Precision Farming-এর ভবিষ্যৎ: পাঞ্জাব, হরিয়ানার মতো রাজ্যগুলোতে যেখানে বড় বড় আকারের ফার্ম রয়েছে, সেসব রাজ্যে নির্ভুল কৃষির সঠিক প্রযোগ খুব সহজেই করা যেতে পারে। আর, এসব অঞ্চলে Precision Farming পদ্ধতি প্রয়োগের আরেকটি সুবিধা হল,এই রাজ্যগুলো কৃষি যান্ত্রিকীকরণের পথে অনেকটা এগিয়ে। কৃষি সম্প্রসারণ উপদেষ্টামণ্ডলী এবং দেশের প্রতিটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে কৃষকদের নির্ভুল কৃষি সরঞ্জামগুলোর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। আমাদের দেশে মোট ২২টি Precision farming development Centre রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের PFDCটি খড়্গপুর অাইঅাইটির কৃষি যান্ত্রিক শাখায় অবস্থিত। এই কেন্দ্রদি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যানপালন দফতরের অধীনস্থ রাজ্য উদ্যানপালন অধিকার দ্বারা পরিচালিত হয়। রাজ্য সরকারের প্রচেষ্টায় এই সেক্টরের ক্রিয়াকলাপ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রের মাধ্যমে সম্প্রসারণ করার প্রচেষ্টা চলছে।