ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়: বৃহস্পতিবার আগুনে পুড়েছিল ঝুপড়ির অবলম্বনটুকু। লেলিহান শিখায় ছাই হয়েছিল দুই মেয়ের বিয়ের আয়োজন। শাড়ি গয়না থেকে শুরু বিয়ের যাবতীয় সামগ্রী। কাগজকুড়িয়ে দুই মেয়ের বিয়ের জন্য প্রায় ৭০ হাজার হাজার টাকা জমিয়েছিলেন ময়না বিবি। আগুনের ভয়াল রূপ সেই জমানো টাকাকে ছাই করে দিল। দুদিন পরেই মেয়েদের বিয়ে। কী করে তিনি কন্যাদান করবেন? মাথায় হাত পড়েছিল। তবে কথায় আছে না, ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে লক্ষীলাভ কেউ আটকাতে পারে না। অগতির গতি হয়ে আর্মেনিয়ান ঘাট লাগোয়া ধ্বংসপ্রাপ্ত ঝুপড়িতে পৌঁছে ছিলেন তৃণমূল বিধায়ক নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়। চিন্তিত ময়না বিবির কাঁধে রেখেছিলেন আশ্বাসের হাত। সেই হাত দিয়েই একে একে দুই মেয়ের কানের দুল, বেনারসী শাড়ি, জামাইদের শেরওয়ানি। অতিথিদের পাত পেড়ে খাওয়ার বিধি ব্যবস্থা। সবই হল। এককথায় রবিবারে দুপুরে পুড়ে যাওয়া বস্তিতেই বইল আনন্দের সুর। আটহাত এক করে দিয়ে সম্পন্ন হল বিয়ের অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে নবদম্পতিকে আশীর্বাদ করলেন নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়।
[আগুনের গ্রাস কাড়তে পারেনি স্বপ্ন, ময়না বিবির দুই মেয়েকে জীবনদান তৃণমূলের]
অনেকদিন পর মানবিকতার অনন্য নজির দেখল শহর কলকাতা। আগুন লাগে, পুড়ে যায় বস্তি, ঝুপড়ি। এ কোনও নতুন ছবি নয়। বছরের সালতামামী হিসেব করতে বসলে দেখতে পাবেন প্রতি ৩৬৫ দিনে অন্তত দু-একটি ঝুপড়ি অগ্নিদেবের কৃপা বর্ষণে ভস্মীভূত হয়েছে। সেটা হয়তো নদীর পাড়, কিংবা রেললাইনের ধার বা পশ এলাকার প্রবেশপথে অবহেলায় গড়ে ওঠা গরিবের আস্তানা। কখনও বিড়ির আগুন, কখনও বা গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে। কখনও আগুন সাজানো সংসার, প্লাস্টিকের চেয়ার, সস্তা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় আটকে থাকা লাল টিপের সুখকে লহমায় ছাই করে দেয়। চালের কলসিতে লুকিয়ে রাখা টাকা। অত্যাচারী স্বামীর নজর এড়িয়ে গুছিয়ে ছিলেন সদ্য গৃহিনী। তাও ঝলসে যায় লকলকে আগুনের শিখায়। কর্মচঞ্চল জনপদকে মুহূর্তে উত্তেজনায় ডুবিয়ে দিতে পারে আগুন। তা বাস্তবের হোক বা মনের। এক্ষেত্রে বাহ্যিক আগুন আলোর মালায় ভরিয়ে দেয় আপাত অন্ধকার ঝুপড়িকে। টিনের শেড, প্লাস্টিকের পর্দা, দরমার বেড়া পেরিয়ে ঝুলকালি মাখা বাল্ব প্রতিদিন যে হলদে আলো ছড়ায়, তার থেকে অনেক বেশি আলো। তবে এ আলোতে আনন্দ নয়, হাহাকারে ভরে যায় গোটা পাড়া। প্রথমে বালতি বালতি জল, তারপর প্রশাসনের হাঁকডাকে টনক নড়ে দমকলের। ততক্ষণে ছোট ছোট স্বপ্নগুলোকে গিলে নিয়েছে আগুন। যত রূপ ছড়াচ্ছে, ততই বাড়ছে হাহাকার। আগুন নিভলে কালো ছাই যেন বিদ্রূপের দৃষ্টি হেনে শাপশাপান্ত করছে। না না ছাই কেন, সেই তো সস্তার ড্রেসিং টেবিল। যার আয়নায় আটকে লাল টিপ। পূব আকাশের গোল সূর্যটার মতো। নতুন বউকে বেশ মানিয়েছিল। পথভুলে ঘরে (এখন ধ্বংসস্তূপ) ঢুকতে গেলে ছাই চাপা আগুন জানান দেয়। এভাবেই কোনও একসময় পোড়া স্মৃতি বুকে নিয়ে নতুন করে বাসা বাঁধে ঝুপড়িবাসী।
আর্মেনিয়ান ঘাটের সদ্য আগুনে খাওয়া ঝুপড়ি কিন্তু অন্য ছবি দেখল। ড্রেসিং টেবলের লাল টিপ উঠল দুই কনের কপালে। সেই লালের ছোঁয়া পড়ল লজ্জাবনত গালেও। রবিবারের বারবেলায় বেনারসী, কনের সাজে ময়না বিবির দুই মেয়ে পৌঁছল ছাই হয়ে যাওয়া ঝুপড়ির ঘরে। এখনও ঝুলছে আড়ার বাঁশ। সেখানেই হয়তো কাপড় ভাঁজ করে রাখত পরম যত্নে। সঙ্গে দুজনের নতুন বর। কেমন যেন ফিনিক্স পাখির জীবনচক্রের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। ফুরিয়ে যাওয়া আগুন থেকেই নতুন সংসারে যাত্রাপথ সূচিত হল দুই কন্যার। সৌজন্যে নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়।
[বেহালায় অকাল ক্রিকেট! বাইশ গজের লড়াইয়ে তাক লাগালেন পুজোপাগলরা]
ছবি- অরিজিৎ সাহা
The post পোড়া ঘরে বাজল বিয়ের সানাই, ছাইয়ের স্তূপে দাঁড়িয়ে হাসিমুখ নবদম্পতিদের appeared first on Sangbad Pratidin.
