অনেক দিন ধরেই চলছে পঞ্চকর্মের জন্যে দাক্ষিণাত্য অভিযান। ভরকেন্দ্র কেরল। শরীরের বর্জ্য অপসারণে মোটা টাকা খরচ। প্রায় ২ লাখি প্যাকেজ। কিন্তু অনেকেই জানেন না, মাত্র দু’টাকাতেই এই পঞ্চকর্ম থেরাপি পেতে পারেন। জানালেন ডা. এ কে দাস ও ডা. বিশ্বজিৎ ঘোষ। শুনলেন গৌতম ব্রহ্ম।
কেরল যাওয়ার দরকার নেই। দু’টাকা খরচেই কলকাতায় মিলবে পঞ্চকর্ম (Panchakarma)থেরাপি। রাজাবাজারে রয়েছে শ্যামাদাস বৈদ্যশাস্ত্রপীঠ। এই সরকারি আয়ুর্বেদ মেডিক্যাল কলেজে রয়েছে বিশ্বমানের পঞ্চকর্ম ইউনিট। অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের নেতৃত্বে জুনিয়র চিকিৎসকরা এখানে থেরাপি দেন। পঞ্চকর্মের পাঁচ কর্ম হল – বমন, বিরেচন, বস্তি, রক্তমোক্ষণ, নস্য। এছাড়া ৮০ রকমের উপকর্ম রয়েছে। অনেকটা রাগ-রাগিণীর মতো। সব থেরাপিই দেওয়া হয় রাজাবাজারে (Rajabazar)।
কী কী রোগের চিকিৎসা
গুলেনবেরি সিনড্রোমের মতো বেশ কিছু স্নায়ুরোগে পঞ্চকর্ম খুবই কার্যকর। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অস্টিওআর্থ্রাইটিস, সোরিয়াসিস, বন্ধ্যাত্ব-সহ বহু রোগ সারিয়েছে এই বৈদিক অস্ত্র। নিয়মানুসারে করা শোধনে, শরীরের সর্বপ্রকার মলের বহির্নির্গমন হয়। রোগমুক্ত হয়ে সুস্থতা ফিরে আসে। শারীরিক ও মানসিক বল, বর্ণ ও মেধাজনক ও পঞ্চইন্দ্রিয়ের বলকারক ও ধাতুর পুষ্টিকারক। জঠরাগ্নির প্রদীপ্ত হয় ফলে বিবিধ পেটের রোগ থেকে খুব সহজেই রেহাই পাওয়া যায়। তারুণ্য বজায় রাখতে শোধন চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
তবে এখানে ভরতি হতে গেলে রোগীকে হাসপাতালে ভরতি হতে হবে। দশ-বারো দিন থাকতে হবে। এখানে আলাদা কেবিনের ব্যবস্থা নেই। তবে, হাসপাতালের ওয়ার্ড যথেষ্ট পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন। মেদবহুল রোগী, অনিদ্রা বা অতি নিদ্রাতুর রোগী, দুর্বলরোগী, পাণ্ডুরোগী, বিবিধ ত্বকজ বিকার, উৎসাহহীনতায় ভুক্তভোগী রোগী সর্বোপরি রোগের মূলোৎপাটনের ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা বিকল্পহীন।
নিখরচায় ওষুধ
থেরাপির জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ হাসপাতাল থেকেই দেওয়া হয়। তবে কয়েকটি বিরল অসুখের ক্ষেত্রে বাইরে থেকে ওষুধ আনাতে হয়। আসলে আয়ুর্বেদে (Ayurveda) ৩ লক্ষ ৩০০ ওষুধের উল্লেখ আছে। যদিও বাজারে খুব বেশি হলে ৩০০ ওষুধ পাওয়া যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে কম্বাইন্ড থেরাপি চালু ছিল। ১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ তৈরির পর আয়ুর্বেদের উপর রাজকর্মচারীদের নির্ভরতা কমে। তখন থেকেই শুরু হয় দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার অবক্ষয়। বাজপেয়ী সরকার এসে প্রথম চাকাটা উলটোদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করে।
কেরল বনাম বঙ্গ
অনেকের ধারণা, কেরলের পঞ্চকর্ম বোধহয় ভিনগ্রহের। বিদেশি মহিলাদের ছবি সুশোভিত বিজ্ঞাপন, সরকারি পৃষ্ঠাপোষকতা, পর্যটনের সঙ্গে আয়ুর্বেদকে মিশিয়ে দেওয়া। সবকিছুর জন্য কেরল আর পঞ্চকর্ম সমার্থক হয়ে উঠেছে। কিন্তু, মাথায় রাখতে হবে আয়ুর্বেদের আঁতুড়ঘর কিন্তু এই বাংলা। পঞ্চকর্ম নিয়ে সব থেকে গ্রহণযোগ্য টিকাটি রচনা যিনি করেছেন তিনিও একজন বাঙালি। চরক সংহিতার টিকাকার চক্রপাণি দত্ত। তাঁর মতে, রোগের সমূলে উৎপাদনের লক্ষ্যে শোধন চিকিৎসা। যা পাঁচ ভাগে বিভক্ত তাই এটির আরেক নাম পঞ্চকর্ম চিকিৎসা। রোগীর রোগ, রোগের তীব্রতা, রোগীর দেহবল, দোষের প্রাবল্য ইত্যাদির উপর নির্ভর করে আয়ুর্বেদ চিকিৎসক ঠিক করে থাকেন কোন ক্ষেত্রে কোন প্রকার চিকিৎসা উপযোগী হবে।
[আরও পড়ুন: রাজ্যে বিপুল বিনিয়োগ করছে দুই শিল্পগোষ্ঠী, তৈরি হবে প্রচুর কর্মসংস্থানও]
রাজাবাজারের শ্যামাদাস বৈদ্যশাস্ত্রপীঠের পাশাপাশি শ্যামবাজারের জে বি রায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, গ্রে স্ট্রিটের বিশ্বনাথ আয়ুর্বেদ কলেজেও পঞ্চকর্ম থেরাপির ব্যবস্থা রয়েছে। এই তিনটি হাসপাতালই সরকারি। তাই থেরাপি মেলে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।
পঞ্চকর্মের ইতিহাস
আসলে পঞ্চকর্ম হল একধরনের শোধন চিকিৎসা (ডিটক্সিফিকেশন)। বৈদিক চিকিৎসা-বিজ্ঞানের মূল সূত্রই হচ্ছে সুস্থ মানুষের সুস্থতা রক্ষা করা এবং রোগাক্রান্ত মানুষকে রোগমুক্ত করা। চরক সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতা ও অষ্টাঙ্গ হৃদয়ের মতো আয়ুর্বেদের গুরুত্বপূর্ণ মূল গ্রন্থসমূহ ছাড়াও অন্যান্য অনেক গ্রন্থে রয়েছে এই শোধন চিকিৎসার গুণকীর্তন।
বমন চিকিৎসা: চরক মতে ‘দোষ হরণম ঊর্ধ্বভাগম বমন সঙ্ককম’ অর্থাৎ শরীরের উপরিভাগ দ্বারা দূষিত দোষের অপসারণকে এককথায় বমন চিকিৎসা বলে। এতে পাকস্থলীর দূষিত পদার্থসমূহ শরীরের বাইরে বেরিয়ে আসে।
বিরেচন চিকিৎসা: দেহের বিবিধ প্রকার দূষিত আবর্জনা ও পক্বাশয়ের মল দূষিত পিত্তকে মলের সঙ্গে নির্গমনকে বিরেচন বলে।
বস্তি চিকিৎসা: এই চিকিৎসাকে শোধন চিকিৎসার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বা অর্ধ চিকিৎসা বলা হয় যেখানে বিভিন্ন প্রকার ঔষধি দ্রব্য সহযোগে ও ক্ষেত্রবিশেষে একক স্নেহ ও তরলকে মলদ্বার দ্বারা প্রবেশ করিয়ে শরীরকে শুদ্ধ করা হয়।
নস্য চিকিৎসা: বিভিন্ন প্রকার আপার ক্লাভিকুলার ডিজিজে নস্য শ্রেষ্ঠ চিকিৎসা। যেখানে ভেষজ সমৃদ্ধ তেল বা চূর্ণ নাকের দ্বারা বিশেষ পদ্ধতিতে দেওয়ার বিধান রয়েছে।
রক্তমোক্ষণ: এককথায় এটি হল শরীরের বিভিন্ন জায়গা থেকে বেশ কয়েকটি উপায়ে পরিমাণ মতো রক্তকে বের করে বিভিন্ন কঠিন থেকে কঠিনতম রোগের সুচিকিৎসার পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে জোঁক বা জলৌকা ব্যবহার করা হয়। চলতি ভাষায় যাকে ‘লিচ থেরাপি’ বলে।
পঞ্চকর্মের সুবিধা: দোষা কদাচিৎ ক্যুপন্তি জিতা লঙ্ঘন পাচনে। জিতা সংশোধনৈয় তু নং তেশাং পুনরুদ্ভব। (চরক সংহিতা, সূত্র স্থান : ১৬/২০) অর্থাৎ লঙ্ঘন, পাচন ইত্যাদি ঔষধ প্রয়োগে শরীরের দূষিত দোষকে শমন করা গেলেও তা পুনরায় দেহে রোগ আকারে প্রকাশ পেতে পারে কিন্তু শোধন চিকিৎসার ফলে শুদ্ধ হওয়া শরীরে রোগের পুনরুদ্ভব ঘটে না।
নিষেধ: দোষের তারতম্য ও দেহের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে বমন, বিরেচন, বস্তি, নস্য, রক্তমোক্ষণ জাতীয় শোধন চিকিৎসার বিধিনিষেধ রয়েছে তবে মূলত অবাধ্য রোগী, ক্রুদ্ধ মনোভাবাপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে এই চিকিৎসার বিধান নৈব নৈব চ।