ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: করোনার (Coronavirus) মতো সংক্রামক। দীর্ঘ সময়ের জন্য বিছানায় পেড়ে ফেলতে জুড়ি নেই, কখনও প্রাণঘাতীও। গত তিন বছরে রীতিমতো উদ্বেগ তৈরি করেছে চিকেন পক্স তথা জলবসন্ত। ভাইরাসঘটিত রোগটি গত বছর শুধুমাত্র কলকাতায় নয় নয় করে ৩৫ জনের প্রাণ কেড়েছে। গত এক মাসে মহানগরে মৃত্যু হয়েছে সাত জনের, আক্রান্ত প্রায় দু’হাজার। শুক্রবারও একজন সংকটজনক অবস্থায় আইডি হাসপাতালে ভরতি হয়েছেন। বাঁকুড়া, উত্তরবঙ্গ থেকেও সংক্রমণ ও মৃত্যুর খবর আসছে।
ঘটনা হল, চিকেন পক্সের এহেন বাড়বাড়ন্ত নতুন কিছু নয়। কিন্তু গত বছর দুয়েক তা করোনার ছায়ায় আড়ালে চলে গিয়েছিল। স্মল পক্স বা গুটিবসন্তের মতো সাংঘাতিক না হলেও জলবসন্তের সাম্প্রতিক দাপট দেখে চিকিৎসকদের কপালে ভাঁজ। কেন? কারণ, রোগটি প্রচলিত সব ধ্যানধারণাকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। বলা হত, ছোটবেলায় একবার চিকেন পক্স হয়ে গেলে আর হবে না, শরীরে জীবনভরের জন্য তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়ে যাবে। কিন্তু গত তিন বছরে ভিজেডভি (ভারিসেলা-জোস্টার ভাইরাস, যা কিনা চিকেন পক্সের জন্য দায়ী) সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে। তথ্য বলছে, রাজ্যের একমাত্র সংক্রামক ব্যাধির হাসপাতাল বেলেঘাটা আইডি’তে ভরতি জলবসন্ত রোগীদের ৯০ শতাংশই আগে এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিল। এ দিকে ডিএনএ ভাইরাস হওয়ার সুবাদে ভিজেডভি-র দ্রুত মিউটেশন হয় না। কাজেই কুড়ি বছর আগে যে সব অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ দেওয়া হত, সেভাবেই চিকিৎসা চলছে।
[আরও পড়ুন: ‘মমতার মতো লড়াই কোথায়!’, বিজেপির কর্মসমিতি বৈঠকে মুখর শুভেন্দু]
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বেলেঘাটা আইডিতে সাত জন চিকেন পক্সের উপসর্গ নিয়ে ভরতি। দু’জনের অবস্থা সংকটজনক। চিকিৎসকদের অভিমত, রোগীর সংস্পর্শে আসা অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষ জলবসন্তে আক্রান্ত হতে পারে। তাই সচেতনতা ও সাবধানতাই আসল দাওয়াই। রোগ চিহ্নিত হলেই রোগীকে আলাদা করে রাখতে হবে। চিকেন পক্সের জীবাণু বায়ুবাহিত। রোগীর থুতু, কফ বা শুকনো চামড়া থেকে রোগ ছড়ায়। তাই সুস্থ থাকতে হলে রোগীর থেকে দূরে থাকতেই হবে। তবে গুটিবসন্ত ১৯৭৭ সালে বিশ্ব থেকে নির্মূল হয়েছে। চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, চিকেন পক্সের মূল লক্ষণ বলতে জ্বর, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শরীরময় র্যাশ বা ফোস্কার মতো গুটি ও গোটা দেহে অসহ্য যন্ত্রণা। আইডি-র বিশেষজ্ঞ ডা. বিশ্বনাথ শর্মা সরকারের কথায়, ‘‘গায়ে র্যাশ বা দানার মতো জলভরা গুটি দেখা দিলেই আলাদা ঘরে রাখতে হবে। রোগীর ব্যবহৃত সামগ্রী কেউ ধরবে না। দেখা গিয়েছে, শুরুর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তার দেখিয়ে পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খেলে চিকেন পক্স নিয়ন্ত্রণে আসে। যাঁরা হাসপাতালে ভরতি হয়েছেন বা যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগেরই চিকিৎসা শুরু হয়েছিল দেরিতে।’’
প্রতিরোধের কী উপায়? চিকেন পক্স ঠেকাতে জন্মের ১০ বছরের মধ্যে টিকা নিতে হয়। তবে পোলিও, ডিপিটি-র মতো টিকাকরণের জাতীয় কমর্সূচি নেই। বেসরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টিকা দেওয়া হয়। দু’বছর বয়সের আগে দু’টি ডোজ, ২ বছরের পরে একটা। এই তিনটি ডোজ দশ বছর বয়সের মধ্যে নিতে হবে। ‘‘দেখা গিয়েছে, তিনটে টিকা নেওয়ার পরে জলবসন্ত হলেও অতটা মারাত্মক হয় না।’’, বলেন বিশ্বনাথবাবু। জলবসন্তে মৃত ও আক্রান্তদের কেস হিস্ট্রি পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, অধিকাংশের তীব্র শ্বাসকষ্ট হয়েছে অর্থাৎ, ফুসফুসে সংক্রমণ। ফুসফুসের কোষগুলো রসস্থ হয়ে পড়ায় অক্সিজেন ফুসফুসে ঢুকতে পারে না। একইভাবে মস্তিষ্কেও অক্সিজেন পৌঁছতে বাধা পায়। রোগী ক্রমশ নিস্তেজ হতে থাকে। কিডনি, প্যাংক্রিয়াস, ফুসফুসের স্বাভাবিক ক্ষমতা নষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় রোগীর। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. অনির্বাণ দলুইয়ের হুঁশিয়ারি, ‘‘অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ। মূলত আবহাওয়ার পরিবর্তনের সময় ছড়ায়। বেশি বয়সী বা কোমর্বিডদের নিউমোনিয়া থেকে মাল্টি অর্গান ফেলিওর হতে পারে। তাই উপসর্গ দেখলেই চিকিৎসা করতে হবে।’’ পুরনো কিছু প্রথা সম্পর্কেও সতর্ক করেছেন অনির্বাণবাবু। বলেন, ‘‘জলবসন্তের রোগীর বিছানায় নিমের পাতা-ডাল রাখা হয়, কিন্তু তাতে ক্ষতিরই সম্ভাবনা। ফুসকুড়ি ফেটে সংক্রমণ হতে পারে।’’ বাড়িতে থাকা জলবসন্তের রোগীকে মাছ, মাংসের মতো প্রোটিন জাতীয় খাবার না দেওয়ার পক্ষেও যুক্তি খুঁজে পাননি চিকিৎসকরা।