ডা. গোপালকৃষ্ণ ঢালি: সেই বিখ্যাত বিজ্ঞাপনকে একটু এদিক-ওদিক করে যদি বলি, গ্যাস, অম্বল, বুকজ্বালা / বঙ্গ জীবন ঝালাপালা। তাহলে কি ভুল বলা হবে? সম্ভবত না। দীর্ঘ চিকিৎসক জীবন ও মেডিক্যালের ছাত্র হিসাবে দেখে আসছি বিভিন্ন রোগজ্বালা নিয়ে যত রোগী আসেন তাঁদের ৭০ শতাংশই কোনও না কোনও পেটের সমস্যায় ভুগছেন।
এর জন্য কোনও সমীক্ষার দরকার পড়ে না। কেউ অম্বল, কেউ বা গ্যাস্ট্রিকে ভুগছেন। তো কারও খাবারই হজম হতে চায় না। খাওয়ার পরেই বড় বড় ঢেকুর। আবার কারও দিনভর পেটে জ্বালা, ব্যথার সমস্যা। তেমনই বদহজমের সমস্যাও রয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই সব সমস্যার নেপথ্যে রয়েছে অনিয়মিত এবং অসময়ে দুষ্পাচ্য খাবার খাওয়া এবং দীর্ঘ সময় খালি পেটে থাকা। তাই দৈনন্দিন জীবনচর্যা যদি একটি সামঞ্জস্য মানিয়ে চলতে পারে, তবে আলসার থেকে বুকজ্বালা সব নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
এই সুযোগে প্রাতরাশ থেকে নৈশভোজ, সবটাই আলোচনা করব। তার সঙ্গে আরও একটা কথা বলব, পোশাক-আশাকের বিষয়। খাবারের আলোচনায় পোষাকের বিষয় আনলে যে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, সম্পর্কটা কী? আমার উত্তর ঢিলেঢালা পোশাক পরলে খাবার দ্রুত হজম হয়। এটা কিন্তু পরীক্ষিত সত্য। উলটো দিকে টাইট জিন্স, স্কিনটাইট শার্ট পরে দীর্ঘক্ষণ এক জায়গায় বসে কাজ করলে খাবার হজম হতে দেরি হয়। ফলে গ্যাস-অম্বল-বুকজ্বালার মতো সমস্যা যেন আর ছাড়তেই চায় না।
অনেকেই বলেন, বারবার খাও কিন্তু কম খাও। কথাটা সঠিক নয়। কারণ আমরা যখনই কিছু খাই সেই সময় গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল নালি দিয়ে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড নিঃসরণ হয়। এখানে মনে রাখতে হবে, আমাদের পেটের ভিতরের অংশ অত্যন্ত নরম। তাই যত বেশি এই ধরনের অ্যাসিড নিঃসরণ হবে ততই ক্ষত তৈরি হবে। যা আলসার ডেকে আনে।
তাহলে কী করতে হবে? চলতে ফিরতে বারবার না খেয়ে দিনে চারবার খাওয়াই যথেষ্ট। তবে সকাল আর দুপুরের খাবার কিছুটা বেশি করে খেলেও রাতের খাবারের পরিমাণ কম রাখাই ভাল। পেট কিছুটা খালি রেখে খেতে হবে। আর খাওয়ার পরেই শুয়ে না পড়ে অন্তত ৪০ মিনিট থেকে একঘণ্টা পর শুতে যেতে হবে।
[আরও পড়ুন: ভুল জুতো পরলেই বিপদ, হতে পারে নানা সমস্যা, সাবধান করলেন বিশেষজ্ঞ]
যদি বলেন কেন? উত্তর হল, আমরা যা খাই, তার সবটা খাদ্যনালি দিয়ে পাকস্থলিতে যাওয়া এবং পাচন ক্রিয়া শুরু করার সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে খাবার হজম হবে না। রাতে বারবার উঠতে হবে। জল খেতে হবে। আর সেই সমস্যা পরের দিন পর্যন্ত চলতে থাকবে।
এখন প্রশ্ন কী খাব? আমরা রোজ যা খাই তারমধ্যে সবুজ শাকসবজি ও ফলের গুরুত্ব অপরিসীম। সবুজ শাকসবজিতে সেলুলয়েডের পরিমান বেশি থাকে। দ্রুত হজম হয়। পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। অন্যদিকে মাংস বিশেষ করে রেডমিট, অতিরিক্ত ভাজা খাবার যতটা কম খাওয়া যায় ততই ভাল। যে কোনওরকমের মরশুমি ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, হজমশক্তি বাড়ায়। তাই বিভিন্ন রঙের মরশুমি ফল, সবজি পরিমাণ মতো খেতে হবে। আর কে না জানে, যার পেট ভাল তার সব ভাল। তবে মাথায় আঘাত, হৃদরোগ বা সেরিব্রাল স্ট্রোকে দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভরতি বা বাড়িতে শয্যাশায়ী রোগীর ক্ষেত্রে হাঁটাচলা বন্ধ থাকায় হজমশক্তি কমতে থাকে।
আবার এটাও দেখা গিয়েছে নিয়ম মেনে খাদ্যাভ্যাসের পরেও অনেকে আলসারে ভোগেন। সমীক্ষায় দেখা গেছে পেটের আলসার অনেকের ক্ষেত্রে বংশগত। তবে এ নিয়ে দ্বিমত আছে।
দেখুন, শরীর কিভাবে ভাল রাখা যায় তা আমরা প্রায় সবাই জানি। কিন্তু সমস্যা হল, রসনা পূর্তি করতে গিয়ে এমন কিছু খাবার রোজ খেয়ে থাকি যার ফল অত্যন্ত মারাত্মক। অতিরিক্ত তেল-মশলা যুক্ত খাবার যত কম খাওয়া যায় ততই ভাল। অনেকের অভ্যাস, নেমন্তন্ন বাড়ি ছুটির দিনে বাড়িতে ভালমন্দ খাওয়ার আগে বা পরে মুড়ি-মুড়কির মতো হজমের বড়ি খেয়ে নেন। এটা অনেকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন। তাঁরা নিজেও জানেন না অজান্তে কতবড় ক্ষতি করছেন। শরীরের নিজস্ব হজম ক্ষমতা আছে। সেই ক্ষমতাকেই নষ্ট করে ফেলে অ্যান্টাসিড। একটা সময় দেখা যাবে খাবার টেবিলে সবাই ভালমন্দ খাচ্ছে আর আপনার জন্য বরাদ্দ একটু নরম ভাত আর হালকা মাছের ঝোল। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া হজমের গুলি খাওয়া একবারে বন্ধ রাখতে হবে।
পেটের আলসার ডেকে আনে জিন-হুইস্কি। জিন বা হুইস্কিতে যে পরিমাণ ক্ষার থাকে তা পেটের নরম অংশে ফুটো করে ফেলে। তাই এমন পানীয় খাওয়ার সঙ্গে স্ন্যাক্স জাতীয় খাবার খাওয়া দরকার। আবার বিয়ার কিন্তু পেটের পক্ষে উপকারী। পেট ভাল রাখতে সাহায্য করে। তাই রসনাকে নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক খাবারে ভরসা রাখলেই আলসার থেকে দুরে থাকবেন।
অধ্যাপক ডা. গোপালকৃষ্ণ ঢালি এসএসকেএম হাসপাতালের স্কুল অফ লিভার অ্যান্ড ডাইজেস্টিভ ডিজিজেস বিভাগের প্রধান।