ডা. অর্পিতা রায়চৌধুরি: বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য জরুরি। তা বলে যা পাবেন তাই খাবেন? এটা কিন্তু ঠিক নয়। বুদ্ধি করে সঠিক খাবার মুখে তোলার মধ্যেও আছে বিশেষ আর্ট। এটা যাঁরা জানেন ও মানেন তাঁরা সুস্থতার সঙ্গে যাপনও করেন। বিশেষত, কিছু অসুখ রয়েছে যেগুলির ক্ষেত্রে বাকিদের মতো স্বাভাবিক খাওয়া-দাওয়া করা যায় না। যার প্রথমেই রয়েছে কিডনির অসুখ। এক্ষেত্রে সঠিক ডায়েট থেরাপির মতো কাজ করে। শুধু মাত্র অসুখ করলেই নয়, আগাম সতর্কতাতেও পুষ্টির একটা ভূমিকা রয়েছে। তবে, কিডনির অসুখ কার কোন পর্যায়ে রয়েছে তার উপরে নির্ভর করবে একজন কী খাবেন, কী খাবেন না।
প্রথমেই নুন বর্জন করুন
কিডনি ডিজিজ প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও প্রথমেই কাঁচা নুন খাওয়া ছাড়ুন। অনেকে মনে করেন, নুনের পরিবর্তে রকসল্ট বা সন্ধক লবণ খেলে হয়তো ক্ষতি কম হয়। তা কিন্তু একেবারেই নয়। যেকোনও ধরনের কাঁচা নুনই কিডনির রোগীদের জন্য মারাত্মক হতে পারে। সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দেয় ফাস্টফুড বা প্রসেসড ফুড, পাঁপড়, আচার ইত্যাদি যেগুলিতে নুনের মাত্রা বা সোডিয়াম বেশি, তা কিডনির জন্য একেবারেই ভাল নয়। সেই সঙ্গে আপনার ওজন কমানো দরকার কিনা বা ডায়াবেটিস আছে কিনা তার ওপর নির্ভর করবে ভাতের পরিমাণ। ক্রনিক কিডনি ডিজিজের (সিকেডি) প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের রোগীর যদি ডায়াবেটিস না থাকে তাহলে তাকে কিছু খেতে বারণ না করে হেলদি ডায়েট মেনে চলার পরামর্শ দিই।
[আরও পড়ুন: দিন দিন ত্বক জেল্লা হারাচ্ছে? ক্রিম না মেখে, স্বাস্থ্যকর খাবার খান, টিপস দিলেন বিশেষজ্ঞ]
অ্যাডভান্সড সিকেডি রোগীদের প্রোটিন পুরো বাদ নয়
কিডনির অসুখে সিকেডির তৃতীয় পর্যায় থেকে পঞ্চম পর্যায়, ডায়ালিসিস শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত আমরা অ্যাডভান্সড সিকেডি বলতে পারি। অনেকে মনে করেন, কিডনির অসুখ মানেই প্রোটিন বাদ দিতে হবে। এ ধারণা বদলের সময় এসেছে। প্রোটিন পুরোপুরি বন্ধ করলে শরীরের প্রাত্যহিক ক্ষয় পূরণ হবে না উলটে কমে যাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং কাজ করার স্ফূর্তি। অ্যানিমাল প্রোটিন খেতে হবে, তবে সীমিত মাত্রায়, কিছু বর্জন করে। আমিষাশী হলে মাছ, ডিমের সাদা অংশ এবং সপ্তাহে ১-২ দিন মুরগির মাংস খেতে হবে। সঙ্গে সল্প পরিমাণে দুগ্ধজাত প্রোটিন অর্থাৎ দুধ, ছানা অথবা টকদই খাওয়া উচিত। নিরামিষাশীরা দুগ্ধজাতীয় ও সোয়াবিনজাত খাবার থেকে প্রোটিন পেতে পারেন।
তবে আমিষাশিদের জন্য ডাল, মটন, পর্ক বা বিফ বারণ থাকবে। স্বাভাবিক প্রোটিনের পরিমান নির্দিষ্ট হবে ০.৬ থেকে ০.৮ গ্রাম প্রতি কেজি ওজন হিসেবে।
আর একটা ব্যাপার হল একজন মানুষ কতটা ক্যালোরি ইনটেক করছেন সেটাও খেয়াল রাখা দরকার। যাঁরা বসে কাজ করেন তাঁদের ক্যালোরি শরীরে বেশি প্রবেশ করলে মুশকিল। সে তুলনায় যাঁদের পরিশ্রম বেশি তাঁদের একটু বেশি ক্যালোরি গেলেও ক্ষতি নেই। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যাঁর পরিশ্রম কম তাঁর প্রাত্যহিক ১৬০০ ক্যালোরি দরকার। অর্থাৎ ৩০-৩৫ ক্যালোরি প্রতি কেজি শরীরের ওজনে। সঠিক ক্যালোরি কিডনির সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
ফ্যাট অল্প পরিমাণে
খাদ্যের মাধ্যমে খারাপ ফ্যাট শরীরে প্রবেশ করলে তা সমস্যা তৈরি করে। কিন্তু কিছু ভাল ফ্যাটও রয়েছে যেগুলি আমাদের ভাল থাকতে দরকার। তবে খাদ্যাভ্যাসে ডালডা, চর্বি, বাটার, মার্জারিন রাখা যাবে না। কিন্তু রান্নায় অল্প মাত্রায় সানফ্লাওয়ার অয়েল, ভেজিটেবল অয়েল ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে তেলে ভাজা এড়িয়ে চলুন।
পটাশিয়াম বুঝে খান
খাদ্যে উপস্থিত পটাশিয়াম শরীরের অনেক কিছুর জন্যই প্রয়োজন। তবে যাঁদের উচ্চরক্তচাপ ও কিডনির সমস্যা রয়েছে তাঁদের জন্য পটাশিয়ামে নিয়ন্ত্রণ দরকার। কারণ শরীর থেকে পটাশিয়াম বের করার মূল রাস্তা হল কিডনি। যখনই কিডনি বিকল হয় তখনই পটাশিয়াম আর পরিস্রুত হতে পারে না। তখন শরীরেই তা বাড়তে থাকে। কিছু ওষুধ রয়েছে যেগুলি কিডনির অসুখে খুবই উপকারী, কিন্তু সেইসব ওষুধগুলি শরীরে পটাশিয়ামের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু সেই ওষুধ খুবই প্রয়োজনীয়। তাই ওষুধ শুরু হলে কিডনি রোগীদের পটাশিয়াম নিয়ন্ত্রিত খাবার খেতে বলা হয়। এতে পটাশিয়ামের মাত্রা কিছুটা হলেও ব্যালান্স হয়। পটাশিয়াম নিয়ন্ত্রণ করতে নিয়মিত সবজি দু’বার করে ফুটন্ত জলে ১০ মিনিট রেখে ধুয়ে নিয়ে তারপর রান্না করা উচিত। এতে পটাশিয়াম বেরিয়ে যায়। কিডনির উপরে চাপ পড়ে না।
শত্রু কামরাঙা ও ক্যালশিয়াম ট্যাবলেট
কিডনি দিয়েই শরীরের যাবতীয় ধাতু-অধাতুর পরিস্রুতি ঘটে। এই ভারসাম্য নষ্ট হলেই কিডনিতে পাথরের প্রবণতা বাড়তে পারে। মূলত ক্যালশিয়াম আর ইউরিক অ্যাসিড পাথর জমার অন্যতম উপাদান। ক্যালশিয়াম অক্সালেটের সঙ্গে মিশে ক্রিস্টাল হয়ে জমা হয়। তা মূত্রনালির মুখে ছোট ছোট পাথরের আকারে জমে পথ আটকায়। সাধারণত যে যে খাবার ক্যালশিয়ামের উৎস যেমন দুধ বা দুগ্ধজাতীয় খাবার সেগুলি খেলে অতটাও ক্ষতি হয় না। কিন্তু এর বদলে ভিটামিন সি, ডি বা ক্যালশিয়ামের ঘাটতি মেটাতে মুঠো মুঠো ট্যাবলেট পাথরের সমস্যাকে বাড়িয়ে দেয়।
কিডনির জন্য আরও একটি বিপজ্জনক জিনিস হল কামরাঙা। এই ফলে অক্সালেট বেশি থাকে। ফলে এটি বেশি খেলে পাথর জমে মূত্রনালির মুখ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সেই কারণে ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এছাড়া রেডমিট খেলে ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধি পায়। এগুলি সবই পরোক্ষভাবে কিডনিতে স্টোনের সমস্যা ডেকে আনে। প্রসেসড চিজ বা পিৎজায় যে চিজ দেওয়া থাকে তাও কিডনির জন্য অস্বাস্থ্যকর।
খাবেন ও খাবেন না
পাথরের সমস্যায় প্রথম ওষুধ বা প্রতিষেধক হল জল। ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে ও কিডনিতে পাথর হওয়া আটকাতে প্রচুর জলপান প্রয়োজন। সবজির মধ্যে বিট, পালং শাক, আলু, অ্যাভকাডো, কলাতে অক্সালেটের মাত্রা বেশি থাকে। পরিবর্তে আপেল, পেয়ারা, নাশপাতি, তরমুজ, পাকা পেপে, জামরুল খেতে পারেন। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, কিডনির কিছু সমস্যায় অতিরিক্ত জল পান করা যায় না। বিশেষত ডায়ালিসিস চললে সেক্ষেত্রে নুন ও জলপানে নিয়ন্ত্রণ দরকার। এছাড়া ডায়ালিসিস চলাকালীন রোগীর ডায়েটে প্রোটিনের পরিমাণ বেশি থাকা দরকার। তবে রেটমিট চলবে না। মাছ, ডিম ও চিকেনের সঙ্গে কিছুটা দুগ্ধজাত খাবার চলতে পারে।
অধ্যাপক ডা. অর্পিতা রায় চৌধুরি নর্থবেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান।
[আরও পড়ুন: শরীরে রক্তের ঘাটতি? কীভাবে দূর হবে সমস্যা? সুস্থ থাকার টিপস দিলেন চিকিৎসক]