প্রথম এবং দ্বিতীয় দফার ভোটের পর বিজেপি স্বস্তিকর অবস্থায় নেই। বেগতিক দেখে মেরুকরণকে হাতিয়ার করছে কেন্দ্রীয় সরকার। রামমন্দিরের আবেগ আর কাজ করছে না? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেই বিজেপি মেরুকরণের হাতিয়ার বের করে। এটা ভারতীয় রাজনীতিতে খুব চালু ধারণা। অতীতে একাধিক ভোটের ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে যে, মেরুকরণের হাতিয়ার প্রয়োগ করে বিজেপি কঠিন অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে। কখনও ব্যর্থও হয়েছে। প্রথম দফার ভোটের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (PM Narendra Modi) রাজস্থানের বাঁশওয়াড়ার জনসভায় মেরুকরণের অস্ত্রটি ব্যবহার করার পর ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, বিজেপি এবার মোটেই স্বস্তিকর অবস্থায় নেই।
প্রথম ও দ্বিতীয়, দু’-দফার ভোটেই ভোটদানের হার উল্লেখযোগ্যরকম কম। ভোটদান কম হলে বলা হয়ে থাকে যে, স্থিতাবস্থার পক্ষেই ভোট পড়ছে। কিন্তু এবার ভোট বিশেষজ্ঞরা উল্টোটাই ধরে নিচ্ছেন। মোদির পক্ষে সমর্থনের ঢেউয়ে ভাটা পড়াতেই ভোটদানের হার কম বলে মনে করা হচ্ছে। গত নির্বাচনে মোদির পক্ষে জনসমর্থনের একটা ঢেউ ভারতের বড় অংশে প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল। ওই ঢেউয়ের উপর দাঁড়িয়েই মোদি ৩০০ পার করেছিলেন। এবার এখনও পর্যন্ত সেরকম কোনও ঢেউ দেখা যাচ্ছে না। বরং নির্বাচন নিয়ে দেশের জনতা নির্লিপ্ত রয়েছে। জনতাকে তাতাতেই মোদি তাঁদের বহু ব্যবহৃত চিরাচরিত ধর্মীয় মেরুকরণের অস্ত্রটি প্রয়োগ করেছেন বলে রাজনৈতিক মহলের ধারণা।
[আরও পড়ুন: ভারী বৃষ্টি ও তুষারপাতের জেরে উপত্যকায় ভূমিধস, বিপর্যস্ত জনজীবন]
আদিবাসী অধু্যষিত রাজস্থানের বাঁশওয়াড়াতে মোদি তঁার ভাষণে যে-কথাগুলি প্রথমে বলেছিলেন, সেগুলির পুনরাবৃত্তি তিনি দ্বিতীয় দফার ভোটের দিন মালদহের সভাতে এসেও করেছেন। মোদি বারবার বলছেন, কংগ্রেস নাকি জিতলে বিদেশ থেকে এক্স-রে মেশিন নিয়ে আসবে। যে-মেশিনে মহিলাদের আলমারির সোনাদানা, এমনকী মঙ্গলসূত্রর ছবিও তুলে নেওয়া হবে। তারপর সেসব সম্পদ বণ্টন করে দেওয়া হবে কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কের মধ্যে। কংগ্রেসের ‘ভোটব্যাঙ্ক’ বলতে তিনি মুসলিম সম্প্রদায়কেই ইঙ্গিত করেছেন।
কংগ্রেসের ইস্তেহারে দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা রয়েছে।
আর্থিক বৈষম্য কমাতে কংগ্রেস কী-কী পদক্ষেপ করতে চায়, সে-কথাও বলা আছে। তবে কংগ্রেস এক্স-রে মেশিন লাগিয়ে ধনীদের সম্পদের ছবি তুলে তা কোনও একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যে বিলিয়ে দেবে, এমন কথা বলা নেই। কংগ্রেসের ইস্তাহারে দেশের সম্পদের পুনর্বণ্টনের কথাও নেই। তাহলে মোদি এই বিষয়গুলি পেলেন কোথায়? ইস্তাহার প্রকাশ করতে গিয়ে হায়দরাবাদের একটি সভায় কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এক্স-রে’র কথাটি বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দেশের সম্পদ কংগ্রেস এক্স-রে করবে। ২০০৬ সালের ‘সাচার কমিটি’-র রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একটি বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন, দেশের সম্পদের উপর অগ্রাধিকার দলিত, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের। মনমোহন বস্তুত দেশের আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশকে বোঝাতে এই শব্দগুলি ব্যবহার করেছিলেন। সাচার কমিটির রিপোর্টে মুসলিম সম্প্রদায়ের দুর্দশার কথা তুলে ধরা হয়েছিল।
মোদি তাঁর প্রচারে দুইয়ে দুইয়ে চার করে নিয়েছেন। তিনি রাহুল গান্ধীর এক্স-রে’র কথাটি তুলে নিয়েছেন। তার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন মনমোহন সিংয়ের ১৮ বছর আগের বিবৃতিটিকে। ওই বিবৃতির দলিত ও আদিবাসীকে বাদ দিয়ে শুধু সংখ্যালঘুদের কথা তিনি বলছেন। মোদি এর সঙ্গে যোগ করেছেন প্রয়াত রাজীব গান্ধীর অন্যতম উপদেষ্টা সাম পিত্রোদার একটি মন্তব্যকে। পিত্রোদা এখন আমেরিকায় থাকেন। কংগ্রেসের বৈদেশিক শাখার প্রধান। ইস্তেহারে কংগ্রেস যে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির কথা বলেছে, সেগুলির অর্থ কোথা থেকে আসবে, তা জানাতে গিয়ে পিত্রোদা উত্তরাধিকার করের কথা বলেছেন। এই উত্তরাধিকার কর আমেরিকা-সহ বেশ কিছু দেশে রয়েছে। আমেরিকায় সম্পত্তি উত্তরসূরিকে দিয়ে যাওয়ার সময় রাষ্ট্রকে ৫৫ শতাংশ কর দিতে হয়। বৈষম্য কমাতে ও আয় বাড়াতে এই ধরনের কর দেশে ফের চালু করা উচিত বলে পিত্রোদা মন্তব্য করেন। পিত্রোদার এই মন্তবে্যর দায় গ্রহণ করেনি কংগ্রেস। কিন্তু মোদি এই উত্তরাধিকার করের দায় কংগ্রেসের উপর চাপিয়ে প্রচার করছেন।
[আরও পড়ুন: নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাত্রীবাহী গাড়ির উপর উলটে পড়ল বালির ট্রাক, মৃত ৬]
মোদি তঁার এই মেরুকরণের প্রচারে ভারতীয় জীবন বিমা সংস্থার একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনের স্লোগানকে ধার করেছেন। ওই স্লোগানে বলা হয়েছে, ‘জিন্দেগিকে সাথ ভি, জিন্দেগিকে বাদ ভি’। তিনি বলছেন, কংগ্রেস বেঁচে থাকতেও আপনার সব সম্পত্তি নিয়ে বণ্টন করে দেবে। আবার, আপনি মরে গেলেও উত্তরাধিকার করের মাধ্যমে আপনার সব সম্পত্তি নিয়ে নেবে। মোদির এই প্রচারে বিন্দুমাত্র কোনও সত্যতা নেই বলে কংগ্রেস বারবার দাবি করছে। কংগ্রেস একদিকে যেমন বলছে, কোনও মানুষের সম্পত্তি কবজা করে বণ্টন করে দেওয়ার কোনও লক্ষ্য তাদের নেই। উত্তরাধিকার কর বসানোরও কোনও পরিকল্পনা নেই। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ১৯৫৪-’৫৫ সালে জওহরলাল নেহরু ‘উত্তরাধিকার কর’ বসিয়েছিলেন। কিন্তু ওই কর আদায় যথেষ্ট নয় বলে ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর আমলে সেটি বাতিল করে দেওয়া হয়। ক্ষমতায় এলে আবার সেই কর ফেরানোর কোনও পরিকল্পনা তাদের নেই। কংগ্রেসের ইস্তেহারে ফরাসি অর্থনীতিবিদ থমাস পিকেটি-র সদ্যপ্রকাশিত ভারতের অসামে্যর রিপোর্টটির উল্লেখ রয়েছে। দেশের জনসংখ্যার এক শতাংশ ধনীর হাতে ৪০ শতাংশ সম্পদের মালিকানা থাকা কিংবা ৫০ শতাংশের হাতে সম্পদের মাত্র সাড়ে ৬ শতাংশ থাকা– এই বিষয়টিরও উল্লেখ কংগ্রেসের ইস্তেহারে রয়েছে।
[আরও পড়ুন: ‘প্যালেস্টাইনপন্থী’ JNU! বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ ‘প্রত্যাখ্যান’ ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের]
কংগ্রেস সম্পদ পুনর্বণ্টন ও উত্তরাধিকার কর চাপানোর বিষয়টি যতই অস্বীকার করুক না কেন, মোদি প্রচারে এই কথাগুলি বলতে ছাড়ছেন না। রামমন্দিরের আবেগ সেভাবে কাজ করছে না দেখেই যে-মেরুকরণের এই নতুন হাতিয়ার মোদি গ্রহণ করতে চাইছেন, তা বলা বাহুল্য। প্রথম দু’-দফায় উত্তরপ্রদেশের ১৭টি আসনে ভোটগ্রহণ হয়ে গিয়েছে। সব আসনেই ২০১৯-এর তুলনায় ৭-৮ শতাংশ ভোট কম পড়েছে। এই কম ভোটদান থেকে বোঝাই যাচ্ছে রামমন্দির আবেগ নিয়ে মোটেই আন্দোলিত নয় উত্তরপ্রদেশের ভোটাররা। বাকি দেশের তো প্রশ্নই নেই। ‘সিএসডিএস’-এর সমীক্ষাও সে-কথা বলে দিয়েছে। তারা বলেছে বেকারত্ব, দারিদ্র, অসাম্য, মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি নিয়ে দেশের মানুষ বেশি ভাবিত। তাই মোদিও অর্থনীতির মোড়কে ধর্মকে প্রচারে এনেছেন। বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ গিয়েছে। কমিশন বিজেপির সভাপতিকে শোকজ করেছে। শোকজের জবাবও দিয়েছেন বিজেপির সভাপতি। তাতে কী বলা হয়েছে জানা যায়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে এই প্রচার থেকে নিরস্ত করা এখনও সম্ভব হয়নি। মোদির এই মরিয়া ভাব কিন্তু বিজেপি মহলে আশঙ্কার মেঘকে ঘনীভূত করে চলেছে।