‘হাসি-কান্না হীরা-পান্না’য় শেষ হচ্ছে আরও একটা বছর। বিগত হতে চলা ২০২৪ সালে শিরোনামে কখনও উঠে এসেছে বেদনাদায়ক ঘটনা কখনও বা সুখস্মৃতি। গোটা বিশ্বে যুদ্ধের করাল ছায়া। আগামী বছরও সেই ছায়া বজায় থাকার সম্ভাবনা সমূহ। এই অস্থির পরিস্থিতিতে কেমন থাকবে শেয়ার বাজার? খতিয়ে দেখল সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল।
দেখতে দেখতে আরও একটা বছর শেষ। আসছে ২০২৫। গোটা বিশ্বে যুদ্ধের করাল ছায়া। আগামী বছরও সেই ছায়া বজায় থাকার সম্ভাবনা সমূহ। এই অস্থির পরিস্থিতিতে কেমন থাকবে শেয়ার বাজার? এই নিয়ে এখন থেকে চর্চা তুঙ্গে।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রথম আলোচনা করা যেতে পারে দেশীয় শেয়ার বাজার নিয়ে। গত এক বছরে সেনসেক্স ১২০০০ পয়েন্ট ও নিফটি ৩৭০০ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কেমন যাবে নতুন বছরের শেয়ার বাজার? ব্রোকারেজ সংস্থা সিএলএসএ বলছে, আগামী বছর বিনিয়োগকারীদের জন্য খুব একটা লাভজনক নাও হতে পারে। ফলে আগামী বছর শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের জন্য কিছুটা হলেও ঝুঁকির হতে পারে। তবে মর্গান স্টেনলি নামের বহুল জনপ্রিয় ব্রোকারেজ সংস্থার দাবি, ভারত বিশ্বের মধ্যে এমন একটি জায়গায় নিজেকে তুলে ধরেছে যে বিনিয়োগের বাজারে তাকে হারানো মুশকিল। ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে সেনসেক্স। এই সংস্থার তরফে সেনসেক্সের সর্বোচ্চ টার্গেট দেওয়া হয়েছে ১,০৫০০০ এবং ন্যূনতম টার্গেট দেওয়া হয়েছে ৭০০০০। এদিকে আগামী বছর যে সংস্থাগুলি বড় লাভ দিতে পারে তার আভাস দিয়েছে ম্যাককুয়ারি নামের এক সংস্থা। সেগুলি হল, টিসিএস, এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক, সান ফার্মা, এম অ্যান্ড এম, পিএফসি। পাশাপাশি যে সব শেয়ার বড় একটা লাভের মুখ দেখবে না সেগুলি হল, টেক মহিন্দ্রা, জোম্যাটো, এসবিআই, অ্যাপোলো হাসপাতাল, বাজাজ ফিনান্স।
এ তো দেশীয় বাজারের পরিস্থিতি। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে গোটা বিশ্বের বাজারে কেমন হবে শেয়ার বাজারের ছবিটা? এক অর্থনীতি সংক্রান্ত ওয়েবসাইটের দাবি, ২০২৫ সালে বিশ্বের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি অন্তত ২.৫ শতাংশ বাড়বে। ফলে অতিমারী যে ক্ষতি করেছিল, সেটাকে টপকে আরও একটু ভালো পরিস্থিতি আশা করাই যায়। উন্নত অর্থনীতিগুলি ঘোরাফেরা করবে ১.২৫ শতাংশ থেকে ১.৭৫ শতাংশের মধ্যে। অন্যদিকে উদীয়মান অর্থনীতিতে বৃদ্ধি থাকবে ৩.৫ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে। সুতরাং বলাই যায়, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কার্যকলাপের প্রধান চালক হবে উদীয়মান বাজার, যা পণ্য রপ্তানিতে দৃঢ় কিন্তু সংযত বৃদ্ধি দেখতে পাবে।
এক্ষেত্রে আলাদা করে বলতেই হবে ইউরোপের কথা। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের ধাক্কা পড়বেই সেখানকার বাজারে। রুশ তেল ও গ্যাস বয়কট করার ফলে জ্বালানি খরচ একই ভাবে বাড়বে। পাশাপাশি আমেরিকার চাপানো উচ্চ শুল্কের আশঙ্কাও রয়েছে। তবে এর মধ্যেই আশার কথা, মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি সুদের হার কমাতে সক্ষম হয়েছে। যা ইঙ্গিত দিচ্ছে, বিশ্বময় মন্দার কবল থেকে ধীরে ধীরে মুক্তি মিলছে।
কিন্তু শেয়ার বাজারের ঘাড়ের উপরে জেগে রয়েছে যুদ্ধের কালো মেঘ। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সংঘাতে দূরপাল্লার মিসাইল ব্যবহার থেকে পুতিনের পরমাণু বোমা-হুমকির পাশাপাশি লেবানন কিংবা গাজাতেও সংঘাতের আবহ পুরোদস্তুর। অনেকেরই আশঙ্কা ইউরোপের আরও দেশগুলিতে কিংবা ইরানের নতুন করে যুদ্ধের হুঁশিয়ারি বাজারকে প্রভাবিত করতে পারে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই লড়াই চললেও বাজারকে ঘিরে আশঙ্কায় তা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারবে না। কেননা ইউক্রেনের জিডিপি বিশ্ব জিডিপির মাত্র ০.১৬ শতাংশ। এদিকে ইজরায়েল-হামাস সংঘর্ষেও কিন্তু স্টক স্বাভাবিক চেহারাই বজায় রেখেছে। ফলে সব মিলিয়ে একথা বলাই যায়, যে শেয়ার বাজারের যাবতীয় ঝুঁকি সত্ত্বেও এই ধরনের আঞ্চলিক সংঘর্ষ সামগ্রিক ভাবে বিরাট কোনও প্রভাব কিন্তু ফেলবে না। ফলে বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাসে নির্ভর করে এগোতে হবে।
এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প। নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসের দখল নেবেন ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে। তবে তার আগেই তিনি যে ধরনের আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলছেন, তা থেকে ওয়াকিবহাল মহল নিশ্চিত আগামী সময়ে বিশ্বের শেয়ার বাজারে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন ট্রাম্প সাহেব। বাইডেনকে সরিয়ে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিত হয়েছে চিন ও আমেরিকার ‘বাণিজ্য যুদ্ধ ২.০’। এই লড়াইয়ে শেষ হাসি কে হাসবে? চলছে চর্চা।
বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা জিতলে তিনি কঠোর অবস্থানেই থাকবেন, এটা মনে করা হচ্ছিল। তিনি তো বলেই দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে বেজিংয়ের উপরে ৬০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সত্যিই কি ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে ‘ভয়’ পাচ্ছে চিন? বিশেষজ্ঞদের মত, বিষয়টা এবার অন্য। প্রথম থেকেই কিন্তু বেজিং প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। সিএনএনের সঙ্গে কথা বলার সময় বিশেষজ্ঞ ডেক্সটার রবার্টস বলছেন, ”বেশ কিছুটা সময় আগে থেকেই চিন এই দিনটার জন্য তৈরি হচ্ছিল। আগের চেয়ে এখন তাদের বাণিজ্য নেটওয়ার্কে আমেরিকার গুরুত্ব অনেকটাই কমে গিয়েছে।” আর এটাই সত্যি। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরও চিনের উপরে আরোপিত শুল্ক বহাল রেখেছিলেন। আবার এবছরের সেপ্টেম্বরে তাঁর প্রশাসন কিছু চিনা পণ্যের শুল্ক বৃদ্ধি করারও সিদ্ধান্ত নেয়। তাই চিন ইতিমধ্যেই আমেরিকার উপরে বাণিজ্য-নির্ভরতা কমাতে শুরু করেছে। ২০২২ সালেও চিন-আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল রেকর্ড-উচ্চতায়। কিন্তু গত বছরের হিসেব দেখাচ্ছে চিনকে টপকে গিয়েছে মেক্সিকো। আমেরিকার সঙ্গে বেজিংয়ের বাণিজ্য হ্রাস পয়েছে ২০ শতাংশ। ২০২৩ সালে জি৭ তথা ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ ধনী দেশগুলিতে চিনের রপ্তানি ছিল ৩০ শতাংশেরও নিচে। যা ২০০০ সালে ছিল ৪৮ শতাংশ। ফলে চিন যে আমেরিকার চাপানো শুল্কের বোঝা সয়ে নিজেদের বাণিজ্যের দিকটিকে শক্তিশালী করে তুলতে বদ্ধপরিকর তা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। তবু দুই দেশের মধ্যে এই শুল্ক-সংঘাত বাকি দেশগুলির বাজারেও প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এখানেও একটা বিষয় রয়েছে। হতেই পারে, সেভাবে শুল্ক না বাড়িয়েও স্রেফ চাপে ফেলতে কূটনৈতিক চাল চালতে চাইছেন ট্রাম্প। তবে শেষপর্যন্ত কী হয় তার জন্য আপাতত অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই। তাই ট্রাম্পের প্রভাবে ২০২৫ সালে শেয়ার বাজারের পরিস্থিতি কী হবে তা দেখতে হলে আপাতত অপেক্ষা করতেই হবে।