স্টাফ রিপোর্টার: ‘চিকিৎসা করার নামে আমি কারও ক্ষতি করব না।’ পেশায় প্রবেশের আগে গ্রিক দার্শনিক হিপোক্রেটসের নামে এমনই ভাবনাঘেরা শপথ নেন চিকিৎসকরা। বহু যুগ ধরে চলে আসা এই রেওয়াজে বদল এনে হবু ডাক্তারদের আয়ুর্বেদের আদিপুরুষ চিকিৎসক মহর্ষি চরকের নামে শপথ নিতে বলল ন্যাশনাল মেডিক্যাল কাউন্সিল (NMC)। এহেন প্রস্তাবে অনেকেই সংঘ পরিবারের চাপিয়ে দেওয়া গেরুয়া নীতির ছায়া দেখতে পাচ্ছেন। গৈরিকীকরণের অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ। তাঁদের দাবি, স্বদেশিয়ানার ধুয়ো তুলে দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানকে পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। বিতর্কে ইন্ধন জুগিয়েছে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের (Mohan Bhagwat) ‘হিন্দু হিত মানেই রাষ্ট্রীয় হিত’ মন্তব্য। বৃহস্পতিবার এনএমসি-র বৈঠকে শপথের বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, এবার থেকে হবু ডাক্তারদের সার্টিফিকেট নেওয়ার সময় ‘মহর্ষি চরক শপথ’ নিতে হবে।
এনএমসি-র এই সিদ্ধান্তকে ঘিরেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। দেশের একদল চিকিৎসক যেমন প্রস্তাবের বিরোধিতায় নেমেছেন, তেমনই আরেকদল স্বাগত জানিয়েছেন। নামে ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ হলেও এখন যে শপথবাক্য পাঠ করা হয়, তার সঙ্গে গ্রিক চিকিৎসকের লেখার তেমন যোগ নেই। আধুনিক শপথের রচয়িতা আমেরিকার (US) টাফ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাবিজ্ঞানের অধ্যাপক লুই লাসাগ্না। আধুনিক সময়ের উপযোগী করে ১৯৬৪ সালে নতুন শপথবাক্য তৈরি করেন তিনি। তবু, ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ কথাটা চিকিৎসাবিজ্ঞানের শপথের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। সেই শপথের নির্যাস হল, “চিকিৎসা করার নামে আমি কারও ক্ষতি করব না। রোগীর স্বার্থকে অগ্রাধিকার ও তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়কে গোপন রেখে জীবনরক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাব।” তবে এই শপথ বাধ্যতামূলক নয়। আর এখানেই বিতর্ক। আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি দেশে এমবিবিএসের (MBBS)নতুন শিক্ষাবর্ষের পঠনপাঠন শুরু হচ্ছে। নতুন চিকিৎসকদের জন্য একগুচ্ছ প্রস্তাব দিয়েছে কাউন্সিল। যার অন্যতম চরকের নামে শপথ।
[আরও পড়ুন: সাবধান! ভুয়ো ই-ওয়ালেট অ্যাকাউন্ট খু্লতে সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপে OTP কিনছে জালিয়াতরা]
উল্লেখ্য, এদিনই হায়দরাবাদে একটি অনুষ্ঠানে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বলেছেন, “হিন্দু হিত মানেই রাষ্ট্রীয় হিত। এই ভাবনাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এই ভাবনার মধ্যেই শক্তিশালী যোগ্য দেশ হয়ে উঠতে পারব আমরা।” একধাপ এগিয়ে ভাগবতকে যোগ্য সঙ্গত করেন কর্নাটকের পঞ্চায়েত মন্ত্রী কে এস ঈশ্বরাপ্পা। এদিন তিনি বলেন, “আগামী দিনে তেরঙ্গার বদলে ভারতের জাতীয় পতাকা হবে গেরুয়া। কয়েকশো বছর আগে ভগবান রামচন্দ্রের রথে গেরুয়া পতাকাই উড়ত। তখন তেরঙ্গা ছিল না।”
এনএমসি’র প্রস্তাবে পড়ুয়াদের যোগাভ্যাসের বিষয়টিও বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবে উল্লেখ, সকালে খালি পেটে দশদিন বাধ্যতামূলক যোগাভ্যাস। ২১ জুন আন্তর্জাতিক যোগ দিবসকে সামনে রেখে প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজে বছরে অন্তত ১০ দিন একঘণ্টা করে যোগব্যায়াম, প্রাণায়াম, সূর্য নমস্কার অভ্যাস করতে হবে। মেডিক্যাল কাউন্সিলের যুক্তি, পড়ুয়াদের মধ্যে অবসাদ, আত্মহত্যা, র্যাগিংয়ের প্রবণতা থেকে বিরত রাখবে। যদিও এই যুক্তি মানতে নারাজ কলকাতার চিকিৎসকদের সিংহভাগ। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম’এর দাবি, ‘‘চরক-সুশ্রুতের প্রতি আমাদেরও শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু কাউন্সিল যেভাবে মূল সমস্যা থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে সংঘের নীতি চাপিয়ে দিচ্ছে তা নিন্দনীয়।’’
[আরও পড়ুন: নিজেকে গুটিয়ে নিতে চান অভিমানী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়! সিদ্ধান্ত সোমবার]
ডা. অভিজিৎ চৌধুরী, ডা. কৌশিক লাহিড়ীর মতো চিকিৎসক নেতা জানিয়েছে, ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ বাদ দিয়ে চরক শপথকে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা আসলে দেশকে পিছনদিকে টেনে নিয়ে যাওয়ারই চেষ্টা। স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ফাঁকফোকর থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা। সংঘ-ঘনিষ্ঠ ন্যাশনাল মেডিকোস অর্গানাইজেশনের অবশ্য দাবি, ব্রিটিশরা এ দেশে গ্রিক চিকিৎসকের নামে শপথ দেওয়ানোর প্রথা চালু করেছিল। কিন্তু আমাদের দেশেই চরক-সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতা রয়েছে। দেশীয় ঐতিহ্য ছেড়ে কেন বিদেশি অনুকরণ করা হবে? বিশেষ করে দু’টি শপথই যখন সমান স্বাস্থ্য সেবার কথা বলে।” মেডিক্যাল কাউন্সিলের প্রস্তাবকে সমর্থন করে আইসিএমআর-এর সহ-অধিকর্তা ডা. সমীরণ পণ্ডা বলেন, “যা কিছু মানুষের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করবে তা গ্রহণ করেই চিকিৎসাবিজ্ঞান এগিয়ে চলে। এই প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক করা অনর্থক।” সবমিলিয়ে ‘চরক বনাম হিপোক্রেট’ বিতর্ক তুঙ্গে।