ধীমান রায়, কাটোয়া: কথায় আছে, ঠুঁটো জগন্নাথ। কথাটা নেতিবাচকভাবে প্রয়োগ করা হলেও সবসময় তা সঠিক নয় মোটেও। রথযাত্রার পুণ্য তিথিতে পূর্ব বর্ধমানের দেখা মিলল সাক্ষাৎ রক্তমাংসের জগন্নাথের! দেবতার মতো তাঁরও দুটি হাত নেই। তাতে কী? জগতের নাথ যেমন হাত দুটি ছাড়াই গোটা বিশ্বকে ধারণ করে রয়েছেন, ঠিক তেমনই দুই হাতের অভাবে দুই পায়ের ভরসাতেই সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ায় ব্রতী হয়েছেন জগন্নাথ বাউড়ি।
পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রাম থানার বেলুটি গ্রামের জগন্নাথ বাউড়ির জন্ম থেকেই দুটি হাত নেই। তাই আদর করে বাবা-মা নাম রেখেছিলেন - জগন্নাথ। কিন্তু দুই হাতের অভাব তাঁকে কখনও প্রতিবন্ধকতায় আটকে রাখতে পারেনি। মনের জোরে আর পাঁচজন স্বাভাবিক ছেলেমেয়ের মতো তিনি পড়াশোনা করেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন শিক্ষক হয়ে কচিকাঁচাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার। হাতের বদলে ছোট থেকেই পায়ে লিখে পড়াশোনা করেছেন। এভাবেই পড়াশোনা করেছেন উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত।
আউশগ্রামের শিক্ষক জগন্নাথ বাউড়ি। নিজস্ব ছবি।
২০১০ সাল থেকে শুরু করেন শিক্ষকতা। বর্তমানে তিনি আউশগ্রামের জয়কৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। ক্লাসের মধ্যে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনেও তিনি সমান সাবলীল। পায়ের আঙুলের খাঁজে চক-ডাস্টার ধরে কচিকাঁচা পড়ুয়াদের পাঠদান করেন। বেলুটি গ্রামের জনমজুর পরিবারের সন্তান জগন্নাথের বাড়িতে রয়েছেন বাবা, মা, স্ত্রী, দুই সন্তান। এক দিদির মৃত্যুর পর থেকে ছোট ছোট ভাগ্নে, ভাগ্নির দায়িত্বও তিনিই সামলান। জগন্নাথের কথায়, ''রথের সময় আমারও ইচ্ছা হয় সবার সঙ্গে নিজের হাতে রথের দড়ি টানি। কিন্তু প্রভু জগন্নাথদেবের যেমন দুই হাত নেই, ভগবান আমাকেও তেমন জন্ম থেকে হাত দেননি। তাই মনের ইচ্ছা মনেই থেকে যায়।"
বাবা লক্ষ্মণ বাউড়ি জনমজুরি করতেন। যদিও জগন্নাথের চাকরি পাওয়ার পর ছেলের ইচ্ছাতেই সেসব ছেড়ে দিয়েছেন। জগন্নাথের এক মেয়ে ঋত্বিকা ও ছেলে অষ্টম স্কুল পড়ুয়া। জগন্নাথের মা সুমিত্রাদেবী জানান, ছেলের জন্ম থেকেই হাত নেই। তাই তার নাম রাখা হয় জগন্নাথ। কিন্তু নিজের চেষ্টায় ছোট থেকেই পায়ে পেন-পেনসিল ধরে লেখালেখি শুরু করে। পায়েই এখন চক ডাস্টার ধরে ছাত্রছাত্রীদের পাঠ দেয় জগন্নাথ। জয়কৃষ্ণপুর প্রাথমিক স্কুলের জগন্নাথের সহকর্মী চন্দন মণ্ডল, রুমানা মণ্ডলরা বলেন, "জগন্নাথদা দেখিয়ে দিয়েছেন শারীরিক প্রতিবন্ধকতা কীভাবে মনের জোরে অতিক্রম করতে হয়। একজন আদর্শ শিক্ষক তিনি।"
