বিশ্বদীপ দে: আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। সংক্ষেপে এআই। বাংলা করলে যা দাঁড়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কয়েক বছর আগেই ওয়াকিবহাল মানুষজন ছাড়া এই বিষয়ে তেমন হেলদোল ছিল না কারও। কিন্তু চ্যাটজিপিটি থেকে ডিপফেক এখন দৈনন্দিন চর্চায় জড়িয়ে গিয়েছে। যার শুরুয়াৎ গত বছরের নভেম্বরে চ্যাটজিপিটির জন্মলগ্ন থেকে। সবাই কার্যত থ হয়ে দেখল এআই কতটা শক্তিশালী হতে পারে! যে সংস্থা এটা বানিয়েছে সেই ওপেনএআই রাতারাতি বিশ্বখ্যাত হয়ে গেল। প্রযুক্তি দুনিয়ার নয়া আইকন হয়ে গেলেন সংস্থার কর্ণধার স্যাম অল্টম্যান। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাঁর চাকরি গেল। তিনি ফিরেও এলেন নাটকীয় ভাবে। তা নিয়ে হইহইয়ের মধ্যে শোনা গেল এসবের পিছনে রয়েছে এক রহস্যময় এআই। যার নাম কিউ-স্টার। যা নাকি সভ্যতার জন্য বড় ঝুঁকি হয়ে উঠতে চলেছে!
বিখ্যাত ব্রিটিশ কমেডিয়ান এডি ইজার্ডের একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ”বন্দুক মানুষ মারে না। মানুষই মানুষকে মারে। এবং হনুমানও, যদি তাদের হাতে একটা বন্দুক তুলে দেওয়া হয়।” এই মুহূর্তে এআই নিয়ে যাবতীয় আশা ও আশঙ্কার মধ্যে নতুন করে ফিরে আসছে সেই উক্তিই। আসলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কীভাবে ব্যবহার করা হবে সেটা যে মানুষকেই ঠিক করতে হবে। অন্যথায় বিপদ বাড়বে। ‘বন্দুক’ তথা এআই যদি নিজেই নিজের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে! ভুলে গেলে চলবে না বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং কী বলে গিয়েছিলেন। ‘লাস্ট উইক টুনাইট’ নামের এক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন তিনি। আর সেখানে সটান জানিয়ে দিয়েছিলেন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (Artificial Intelligence) কারণেই নাকি বিলুপ্তি ঘটতে পারে মানব সভ্যতার!প্রায় একদশক আগে তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন। আজ সেই সতর্কবাণী যেন আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
[আরও পড়ুন: চাকরিপ্রার্থীদের বিভ্রান্ত করতে গল্প সরকারের! টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার বিকাশের]
ChatGPT-র স্রষ্টা অল্টম্যান, যিনি ‘ওপেন এআই’ (OpenAI) সংস্থার সিইও তাঁর চাকরি চলে যাওয়ার খবরে চমকে উঠেছিল বিশ্ব। এর কয়েক দিন আগেই নাকি সংস্থার গবেষকরা বোর্ড অফ ডাইরেক্টরদের একটা চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে ছিল সতর্কবার্তা। সেখানে পরিষ্কার বলা হয়েছিল, একটা অত্যন্ত শক্তিশালী এআই আবিষ্কার করে ফেলেছেন তাঁরা। এই এআই এতটাই ক্ষমতাবান, যে তা সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠতেই পারে। যার নাম আপাতত রাখা হয়েছে কিউ-স্টার। যে আসলে এআই নয়, এজিআই হয়ে উঠতে পারে। ব্যাপারটা খুলে বলা যেতে পারে।
চ্যাটজিপিটি বা মিড জার্নি যতই জনপ্রিয় হোক, বিজ্ঞানীদের কাছে এরা ‘দুর্বল’ AI। কেননা যে কাজের জন্য বানানো হয়েছে, তার বেশি কিছু করার ক্ষমতা এদের নেই। সুতরাং নিজের কাজ যতই ভালো করে করুক এই সব সফটওয়্যার, শেষপর্যন্ত তা সীমাবদ্ধ। এজিআই এখানেই অনেক এগিয়ে। তারা একসঙ্গে নানা কাজ করতে পটু। কতটা পটু? মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। এই প্রোজেক্ট কিউ-স্টার আসলে সেদিকেই এগচ্ছে। আর গোলমাল সেখানেই। অন্তত গুঞ্জন তেমনই। ঠিক কেন অল্টম্যানকে সরানো হল তা নিয়ে নানা কথাই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি করে শোনা গিয়েছে ওই চিঠির কথা।
[আরও পড়ুন: রবিবার টেট, ‘আইনি জট কাটলেই নিয়োগ’, পরীক্ষার্থীদের আশ্বাস ব্রাত্যর]
আসলে ২০১৫ সালে যখন ওপেনএআই স্থাপিত হয়, তখন সেই সংস্থাকে অলাভজনক হিসেবেই দেখানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল এই সংস্থার একটাই মিশন। এমন একটা এজিআই তৈরি করা যেটার একমাত্র লক্ষ্য মানবকল্যাণ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা ধীরে ধীরে বাণিজ্যের দিকে এগিয়েছে। অল্টম্যান শিবির বাণিজ্যিকীকরণের পথে যেতে চায়। তারা কিউ-স্টারের পক্ষে। অন্যদিকে রয়েছে এমন এক শিবির যারা চায় না এমন এআইকে আরও আপডেট করতে, যেটা একদিন মানুষেরই গলায় ফাঁস পরাবে! মনে করা হচ্ছে এই গোলমালের কারণেই অল্টম্যানের পদ নিয়ে টালবাহানা। একটি ব্লগ পোস্টে বোর্ড সাফ জানায়, অল্টম্যানের উপর আস্থা নেই। প্রতিষ্ঠানকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা নেই তাঁর। শোরগোল পড়ে যায় এই ঘোষণায়। এমনকী সংস্থার অধিকাংশ কর্মীরাই ছিলেন স্যামের পক্ষে। শেষপর্যন্ত সিইও পদে প্রত্যাবর্তন ঘটে স্যাম সাহেবের। এখনও পরিষ্কার নয়, ঠিক কী ঘটেছিল। কিন্তু নানা তত্ত্ব ঘুরে বেড়াচ্ছে। যার মধ্যে অবশ্যই রয়েছে কিউ-স্টার নিয়ে মতান্তরের গুঞ্জন।
কিন্তু সত্যিই কি এজিআইয়ের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছেন গবেষকরা? গত জুনেই অল্টম্যানকে এই বিষয়ে বলতে শোনা গিয়েছিল, ”আমি মনে করি আমরা খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। কিন্তু একটা জিনিস আমাদের বুঝতে হবে। এসবই টুল। কোনও জীবন্ত প্রাণী নয়।” এটা বলা সম্ভব নয়, অল্টম্যান আদৌ কিউ-স্টারের কথা বলছিলেন কিনা। কিন্তু এটুকুই ভরসা, যেটাই হোক সেটা শেষ পর্যন্ত প্রযুক্তি মাত্র, কোনও স্বশাসিত ব্যবস্থা নয়- এই আশ্বাসটুকু অন্তত অল্টম্যান দিয়েছেন। আসলে কোনও একটা যন্ত্র, যার মধ্যে এজিআই থাকবে, সে তো আর বুঝবে না তার অস্তিত্ব কেমন। তার সীমাবদ্ধতাও সে জানবে না। তাকে যা তথ্য দেওয়া হয়েছে সেটা নিয়ে মানুষের বেঁধে দেওয়া অ্যালগরিদম অর্থাৎ চলন বিধির মধ্যেই সে কাজ করবে। সুতরাং ‘গেল গেল’ রব না তুলে সতর্ক থাকা দরকার। আর বিশ্বাস রাখা দরকার সেই সব মানুষদের উপরে যাঁরা প্রতিনিয়ত এই সব অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে নতুন নতুন দিশা পেরিয়ে যেতে সাহায্য করছেন।
বহু বিজ্ঞানীই বলেছেন, পরমাণু বোমা কিংবা অন্য কিছুই নয়, সভ্যতার সবচেয়ে বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। অর্থাৎ যন্ত্রের বুদ্ধি। সারা বিশ্বের কল্পবিজ্ঞান লেখকরাও তাঁদের লেখায় এই আশঙ্কা করেছেন। আর হকিংয়ের মতো বিজ্ঞানীদের কথা তো শুরুতেই বলা হয়েছে। সুতরাং আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। তবু শেষ পর্যন্ত মানুষের শুভবুদ্ধির উপরে ভরসা করাই বোধহয় শ্রেয়। যুগে যুগে যে শুভবুদ্ধি সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রেখেছে নানা বিপদের হাত থেকে।