টক সৃজনশীল বিষয়, সরকারি ও বেসরকারি সব আওতার অতীত। তবু যে-সমস্ত দলের আর্থিক সামর্থ্য ক্ষীণ তাদের অনুদান দিয়ে নিজেদের সংস্কৃতি সমাজের কোষে কোষে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে কেন্দ্র। তবে অনুদানের অর্থ কখনওই শাসক দলের বাধ্যতামূলক স্তুতি নয়। জয়ন্ত ঘোষাল।
হিটলার যখন তাঁর সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে রাজপথ দিয়ে যেতেন তখন নিয়ম ছিল পথ-মধ্যে নাগরিক সমাজ দু’দিকে চলচ্চিত্রের ফ্রিজ্ড শটের মতো দাঁড়িয়ে যাবে এবং মহানায়ক গোচরে এলেই দু’-হাত তুলে সকলকে বলতে হবে, ‘হেইল হিটলার, হাই হিটলার।’ জনশ্রুতি, সে-সময়ে শহরের কতিপয় অধ্যাপক হিটলারের প্রতিনিধিদের বলেন, তাঁদের পক্ষে এ প্রথা মানা সম্ভব হচ্ছে না কারণ, কলেজে পড়াতে যাওয়ার সময়, আবার ফেরার পথেও তাঁদের হাতে বিস্তর বই থাকে। সে-কথা শুনে হিটলার প্রশাসন নাকি রেগে গিয়ে জানায়– বই ছুড়ে ফেলে দিন, কিন্তু হাত তুলে হিটলারের জয়ধ্বনি দিতেই হবে।
এখানে মনে হয়, ‘হিটলার’ আসলে কোনও ব্যক্তি নয়। হিটলার একটি রাজনৈতিক ফেনোমেনন। যেন ডিসটোপিয়ার কল্পিত পৃথিবীর এক বিগ ব্রাদার। ‘ইউটোপিয়া’ থেকে ‘ডিসটোপিয়া’ এক দীর্ঘযাত্রা। স্যর টমাস মুর দিলেন ইউটোপিয়ার তত্ত্ব। ১৫১৬ সালে। ভারতে আমরা বলি, সত্যযুগ। রামরাজ্য। অন্যায়-অসততা-স্বৈরাচার নেই, আছে মানুষের সার্বভৌমিকত্ব। ইউটোপিয়া হয়ে গেল ডিসটোপিয়া। জন স্টুয়ার্ট মিল বর্ণিত রাষ্ট্রের সামূহিক নিয়ন্ত্রণবাদের ডিসটোপিয়ায় ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য’ বিষয়টি হল প্রতিবাদস্বরূপ।
[আরও পড়ুন: তিনদিন পর হাসপাতাল থেকে ছুটি সুকান্তর, জাতীয় অধিবেশনে যোগ দিতে দিল্লিতে দিলীপ-শমীক]
১৯৪৯ সালে এল জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ উপন্যাস– সরকার নাগরিকের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কায়েম করছে ডিসটোপিয়া। হালে কেন্দ্রের নির্দেশ আসে– বাংলার নাট্যগোষ্ঠীকে বাংলা নাটিকা মঞ্চস্থ করতে হবে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সরকারের গুণকীর্তন করে। যেসব নাট্যগোষ্ঠী সরকারি অনুদান গ্রহণ করে, ‘ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’ থেকে, তাদের কাছে ফরমান জারি করা হয়, ২১ ফেব্রুয়ারি এই নাটক মঞ্চস্থ করা বাধ্যতামূলক। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের নাট্য দলগুলোর কাছে এই নির্দেশ। তিনটি নাটক দিল্লির ‘ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’ থেকে অনুদানপ্রাপ্ত– ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’, ‘পাঁচপ্রাণ’ এবং ‘বিকশিত ভারত’। নাটকগুলো হিন্দিতে পাঠানো। বাংলায় অনুবাদ করে ২১ ফেব্রুয়ারি অভিনয় করার নির্দেশ দেওয়া হয়। মাতৃভাষা দিবসে নাটকগুলি অভিনয় করার পাশাপাশি অভিনীত নাটকের ভিডিও তোলার ফরমানও জারি করা হয়। সেই ভিডিও প্রতিটি নাট্যদলের পক্ষ থেকে এনএসডি-র অফিশিয়াল লিঙ্কে আপলোড করা বাধ্যতামূলক ঘোষিত হয়।
বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে অজস্র ধন্যবাদ। তিনি যদি তাঁর ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে এই ফরমানের কথা না জানাতেন, তাহলে আমরা এত বড় ডিসটোপিয়ার কাহিনি জানতেই পারতাম না! এ খবর কোনও সাংবাদিক ব্রেক করেনি। যারা মোদি সরকারের অনুদান গ্রহণ করে, সেসব নাট্য গোষ্ঠীও জানায়নি। ব্রাত্য জানিয়েছেন। প্রতিবাদ করেছেন। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী অবশ্য শিক্ষামন্ত্রীর প্রতিবাদের জেরে কেন্দ্রের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, নির্দেশিত তিনটি নাটক মঞ্চস্থ করায় কোনও বাধ্যবাধকতা থাকছে না, নাট্যদলগুলি চাইলে তাদের পছন্দের নাটকে অভিনয় করতে পারে।
[আরও পড়ুন: চলন্ত বাস থেকে পয়সার বৃষ্টি হাওড়ায়! কাড়াকাড়ি পথচলতি মানুষের]
ব্রাত্য বসুর দল ‘কালিন্দী ব্রাত্যজন’ দশ বছর আগে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কেন্দ্রের অনুদান নেয় না। এটা অনেকেই জানেন, তবু সকলের জ্ঞাতার্থে বলি, এনএসডি কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীন। ১৯৫৯ সালে ভারত সরকার ‘সংগীত নাটক অকাদেমী’-র অধীনে এই প্রতিষ্ঠান চালু করে। ১৯৭৫ সালে এটি একটি স্বাধীন স্কুলে পরিণত হয় এবং তা অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই ছাত্রছাত্রীদের মেধার উৎকর্ষের জন্য সুনাম অর্জন করে। ঠিক যেমন তথ্য মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট’।
নাটক সৃজনশীল বিষয়, সরকারি ও বেসরকারি সব আওতার অতীত। তবু সরকার এই স্কুল স্থাপন করে যাতে দেশের রাজ্যে রাজ্যে নাট্যচর্চা ছড়িয়ে পড়ে। উদ্দেশ্য: নাটক শেখানো শুধু নয়, যাদের আর্থিক সামর্থ্য নেই, তাদেরও অনুদান দিয়ে সংস্কৃতিকে সমাজের কোষে কোষে ছড়িয়ে দেওয়া। অনুদান দেওয়ার অর্থ কিন্তু কখনই এমন নয় যে, শাসক দলের স্তুতি করতে হবে। হীরক দেশের রাজার জয়গানই এই সংস্কৃতির উৎকর্ষের মানদণ্ড হতে পারে না।
আসলে নাটকের জন্য এই ফরমান জারি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই স্বৈরতন্ত্র যে শুধু ‘জরুরি অবস্থা’ অথবা সামরিক শাসনে হয়, এমনও নয়। সাংবিধানিক গণতন্ত্র কায়েম হলেও সেখানে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার নামাবলি জড়িয়ে সরকার বাহাদুর দেশের মানুষের উপর তাসের দেশের হুইপ জারি করতে পারে। এনএসডি-র বর্তমান চেয়ারম্যান বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ গুজরাটের প্রতিনিধি পরেশ রাওয়াল বাবুর চেয়ে পারিষদগণ অনেক সময় বেশি হঠকারী হয়ে ওঠেন। সূর্যের চেয়ে তখন বালুর তাপ বেশি হয়ে ওঠে। শুধু বাংলা নয়, ভারতের সব রাজ্যের বিবিধ নাট্যগোষ্ঠীর কাছেও এই ফরমান পাঠানো হয়েছিল। আসলে মূল বিষয়টি হল ‘ডিসটোপিয়া’।
শাসক দলের রাজনৈতিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন হল সাংবিধানিক গণতন্ত্রের বাস্তবতা। কিন্তু এখন নরেন্দ্র মোদি নামের ব্যক্তিত্ব ও তাঁর জয়গাথাকে এ-দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাতেই শুধু নয়, রাজ্যে-রাজ্যে, গ্রামে-গ্রামে দেশীয় সামাজিক সংস্কৃতির সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত করার চেষ্টা চলছে যাতে মানুষের সাংস্কৃতিক ভিন্নতাই না থাকে। সেই প্রথা মেনে, ধর্ম মানেই যেমন হিন্দুত্ব, ঠিক সেভাবে প্রত্যেক মানুষের বিচারবুদ্ধির মধ্যেও বৈচিত্র থাকার প্রয়োজন নেই। কারণ ভারত ও এ-দেশের রাষ্ট্রনায়ক ‘বিশ্বগুরু’; কাজেই কোনও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর থাকতে পারে না। অন্য কোনও ভাবনাও থাকতে পারে না। বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে যখন বিরোধী বলে কিছু থাকার জো নেই, এমনকী, বিরোধী শিবিরেরই যেখানে ছত্রভঙ্গ অবস্থা– সেখানে জোর যার মুলুক তারই হবে, বলা বাহুল্য। তাই শুধু সংসদ বা প্রশাসন নয়, ‘সাহিত্য অকাদেমি’, ‘সংগীত নাটক অকাদেমি’ সর্বত্রই রাষ্ট্রবাদ।
দেশ এগোচ্ছে। তাই গান-সিনেমা-কবিতা সব রাষ্ট্রশক্তি নির্ধারণ করে দেবে। ফিল্মের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের নাম থেকে ইন্দিরা বা নার্গিস দত্তর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অতএব, এ তো নীতি এবং ন্যায্য। এ হল ‘বিশ্বগুরুর সিদ্ধান্ত’।
[আরও পড়ুন: ‘এখনই পথে নামুন, নষ্ট করার মতো সময় নেই’, ভারচুয়াল বৈঠকে লোকসভার সুর বাঁধলেন অভিষেক]
অর্থনীতি যদি এ সমাজের ভিত্তি হয়, তবে সংস্কৃতি উপরি কাঠামো। রাষ্ট্র ও সরকার তার নীতি প্রণয়নের মাধ্যমে অর্থনীতির গতিমুখ নির্ধারণ করে। আবার দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বা পশ্চাদগমন দু’ক্ষেত্রেই প্রভাব পড়ে সমাজের সংস্কৃতির উপর। এখন এই সাবেক দ্বান্দ্বিকতার ভাবনাতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন এই মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া এবং কৃত্রিম মেধার যুগে এক অদ্ভুত সামাজিক মনস্তত্ত্ব তৈরি হয়েছে। এখন বাস্তবের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে পরাবাস্তব– এক মোহজাল। আর তাই জিডিপি, চাকরি এসবের চেয়েও এখন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতির হেজেমনি। শাসককে কায়মনোবাক্যে সমর্থন করার যে-সংস্কৃতি, তা জুড়ে গিয়েছে সর্বত্র। শুধু ‘ভারতরত্ন’ বা ‘পদ্মবিভূষণ’-এ নয়, প্রতিদিনের যাপনে, এমনকী, সিলেবাস থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাস বাদ যাওয়া থেকে শুরু করে সংযুক্ত আমিরশাহীতে প্রধানমন্ত্রীর হিন্দু মন্দির স্থাপন, তাজমহলের নিচে হিন্দু মন্দির খুঁজে পাওয়া– সর্বত্রই। আর তাই তারা চাইছিল, নাটকের আখ্যানেও প্রধানমন্ত্রীর সাফল্য বর্ণিত হোক।
ছোটবেলায় সিনেমা হলে ফিল্ম শুরুর আগে কেন্দ্রীয় তথ্য ও প্রচার মন্ত্রকের ছবি দেখতাম। বাধ্যতামূলক। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দৌড়ে দৌড়ে বিমান থেকে অবতরণ করছেন। সে সাদা-কালো ছবি এখন সরকারকে দেখিয়ে করতালি পেতে হয় না আলাদা করে। কারণ, এখন সমাজের সর্বস্তরেই এই জয়ধ্বনি আপসে ধ্বনিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
[আরও পড়ুন: মহাকীর্তির দিনে মায়ের অসুস্থতা, রাজকোট টেস্টে আর নেই অশ্বিন]