পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা শুনলেন শুভঙ্কর চত্রবর্তী।
মনিব ভানুদাকে জিজ্ঞেস করছেন, “তুমি ওখানে গিয়েছিলে কি না?” এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ হলে কী হবে আর ‘না’ হলে কী হবে, ভানুদা মনে মনে রিড করছেন। তারপর ‘হ্যাঁ’ বলার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর বদলে বললেন, “না।” কেন? কারণ ভানুদা ততক্ষণে নিজের অর্ধ অভিব্যক্তি প্রকাশে ধরে ফেলেছেন মনিবের মুখের পরিবর্তন! এরকম মুহূর্ত কোনও সৃজনশীল শিল্পী ছাড়া কেউ তৈরি করতে পারবে? পারবে না।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শুনে অনেকের হাসি পায় হয়তো। আমার পায় না। কারণ আমার কাছে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কমেডিয়ান নন। কৌতুকাভিনেতা নন। তিনি শুধু মানুষ হাসাতে পারেন, তা-ও নয়। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় একজন পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা।
‘ভানু পেল লটারি’, ‘নির্ধারিত শিল্পীর অনুপস্থিতিতে’ কিংবা ‘টাকা আনা পাই’-এই ছবিগুলো যারা দেখেছে তারা বুঝতে পারবে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কমেডিয়ান নন। অভিনয়ের জোরে তিনি দর্শককে কাঁদিয়েও ছাড়তে পারেন। অভিনয়শক্তিতে ভর করে তিনি এমন কিছু করে দেখাতে পেরেছেন, বহু শিল্পী শত চেষ্টাতেও যা পারেননি।
[ আরও পড়ুন: মহাকাব্য থেকে ধর্মবিশ্বাস, জানুন কৃষ্ণ জন্মকথার অন্তর কাহিনি ]
একটা গল্পে পড়েছিলাম, যে মানুষ সারা জীবন দর্শককে হাসিয়ে গেল, সে যখন গোপনে, নিভৃতে, নির্জনে বসে দুঃখে চোখের জল ফেলে, তা দেখেও দর্শক বলে, ‘লুক, দ্য ক্লাউন ইজ ক্রাইং!’ আমার মনে হয় ভানুদাকে যারা কমেডিয়ান বলে, তারা তাঁর অভিনয়কে এক শব্দে ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। তারা জানে না। বোঝে না। তাই ভানুদা কথা বললে মানুষ হাসে। ভানুদা হাসলে মানুষ হাসে। ভানুদা কাঁদলে তারা আরও হাসে।
বাকিদের কাছে যিনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার কাছে তিনি ভানুদা। ভানুদাকে আমি নিজের বাড়ির লোক ভাবতাম। নিজের লোক ভাবতাম। মনে হত, আরে এ তো আমার মতোই একজন। তারপর ভাবলাম, কেন আমি ওঁকে শুধু নিজের বলে আগলে রাখব? উনি তো সমস্ত বাঙালি দর্শকের নিজের লোক। কোনও এক রসের ভাণ্ডে জন্ম ভানুদার। রস-মাখামাখিতে ওঁর বড় হওয়া। যত বয়স বেড়েছে, রসে আরও টইটুম্বুর হয়েছেন তিনি। রসে ডুবিয়েছেন নিজের সবটুকু।
ভানুদার সঙ্গে প্রথম আলাপ কীভাবে হয়েছিল, এত বছর পরে আমার ঠিক মনে নেই। তবে যতবার আমাদের দেখা হয়েছে, ততবারই এমন কিছু ঘটেছে যে আমার হাসতে হাসতে দাঁতকপাটি লেগে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। এখানে বলে রাখি, ভানুদা আর আমি কখনও একসঙ্গে কোনও ছবিতে অভিনয় করিনি। তবে রেডিওতে একসঙ্গে বহু নাটক করেছি।
সে সময়ে রেডিওতে অভিনয় ছিল বিশাল বড় ব্যাপার। কোনও অভিনেতা যদি নাটকে শুধু ‘বাবু, চা এনেছি’ বলার সুযোগ পায়, ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করে। তার গলা গম্ভীর হয়ে যায়। ব্যারিটোন ভয়েস চলে আসে তার কণ্ঠে। নেহাত মাধ্যাকর্ষণ বলে কিছু আছে তাই তার পা মাটিতে পড়ে। নচেৎ সে নির্ঘাত উড়তে শুরু করত! কারণ সে তখন ‘রেডিও আর্টিস্ট’!
তো যাই হোক, এরকম এক নতুন ছোকরা এসেছে পাঠ করতে। রিহার্সাল শেষ হওয়ার পর আমি, সাবুদি, (সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) ভানুদা আর কয়েকজন বসে আছি। সে ছোকরার চুল আবার উপর দিকে শিঙাড়ার মতো তোলা। ডানদিকের চুলে ডান হাত বোলাতে বোলাতে ভানুদাকে জিজ্ঞেস করেছে, “ঠিক আছে ভানুদা?”
ভানুদা ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকালেন। তারপর আমার দিকে ফিরে বললেন, “বুঝলা পরাণ, আমাগো পাড়ায় একবার শাহজাহান হইব…” আমি ভাবলাম কী হল? ওর কথার উত্তর না দিয়ে আমাকে কী বলছেন? ভানুদা তখনও বলছেন, “যে শাহজাহান করব, সে হেব্বি ডোনেশন দিসে। আর আমার মামা হইল গিয়া খুব গম্ভীর কিন্তু দারুণ ক্রিটিক। বুঝলা? ওঁকে অনেকবার পোলাপান বলসে রিহার্সালে আইতে। ও আসে নাই। কথা দিসে শো-এর দিন আইবে। তো কথামতো মামা গ্যাসে গিয়া। শাহজাহান চলতাসে। মামা দ্যাহে আর মাথা নিচু করে…”
ভানুদা যখন গল্পটা বলছেন, আমি ছেলেটাকে দেখছি। ছেলেটা মিচকি মিচকি হাসছে আর কথাগুলো গিলছে। ভানুদা আবার বললেন, “নাটক যখন ভাইঙ্গা গেল, মামা বাড়িমুখো হইব হইব। এমন সময় যে শাহজাহান করতাসিল সে গ্রিন রুমে না গিয়া মামাকে অ্যারেস্ট করসে। জিগাইসে, ‘কেমন দেখলেন মামা?’ মামা উত্তরে কইল, ‘ভানু রে চিনো?’ শাহজাহান কইল হ্যাঁ। মামা কইল, ‘ও তোমার থেইক্যা শাহজাহানের ক্যারিকেচার আরও ভাল করে।’” তারপর বললেন, “চলো, পরাণ চা খাইয়া আসি।”
ছোকরার মুখ তখন বেগুনি। ও ততক্ষণে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে গেল। ভানুদার অ্যান্টেনা মানে ব্রহ্মতালু ছিল ভীষণ স্ট্রং। কোন কথা অন্তরঙ্গের, কোনটা বহিরঙ্গের, খুব ভাল বুঝতে পারতেন। একবার দূরদর্শন দপ্তরে আড্ডা হচ্ছে। একজন এসে বলল ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ আরেকবার করলে কেমন হয়? অন্য একজন বলল, “ভানুদা এরকম বস্তাপচা কাজ এখন আর চলে?” সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন ভানুদা, “বস্তাটা পইচ্যা গ্যাসে। ভিতরের সোনাটা তো নষ্ট হয় নাই।”
[ আরও পড়ুন: জাতীয় পুরস্কার আমার আগেই পাওয়া উচিত ছিল: আয়ুষ্মান খুরানা ]
সাংঘাতিক কোনও কথা বলে আপনি তাঁকে আক্রমণ করতে পারবেন না। উলটে ওঁর কথাতেই আপনি ধরাশায়ী হয়ে মাটিতে লুটোপুটি খাবেন। ভানুদা ঠোঁট ফাঁক করলেই যুক্তি প্রস্তুত থাকত। ভীষণ উইটি ছিলেন।
আরেকবার জাতীয় নাট্যশালা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। শম্ভুবাবু (মিত্র) হঠাৎ ভানুদাকে বললেন, “আপনি এ ব্যাপারে আবার নাক গলাচ্ছেন কেন?” সটান উত্তর ভানুদার, “আমি নাক গলাইতে যামু ক্যান। আপনার নাকের যা অবস্থা, আপনি চেষ্টা করার আগেই তা গইল্যা যাবে গিয়া।”
ওঁকে কেউ একটু আঁচড়ে কিংবা চুলকে দিয়ে রেহাই পাবেন, এমন কখনও হয়নি। আর এরকম উইটি কথাবার্তা ওরকম বাঙাল অ্যাকসেন্টে। ওপারের ভাষায় একটা মিষ্টত্ব আছে। তাতে উইট মিশে মিষ্টি আরও গাঢ় হত। এখন অভিনয় করতে এসে অনেকে বাঙাল ভাষায় কথা বলতে চেষ্টা করে কিন্তু শেষমেশ ভীষণ ধ্যাড়ায়।
ভানুদা সাদামাটা মানুষ ছিলেন। পোশাক ছিল চমকহীন। আগাগোড়া ধুতি-পাঞ্জাবিতেই দেখেছি। মানুষ হিসেবে এতটা সহজ না হলে বোধহয় ওরকম মাপের স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় হত না। তিনি অভিনেতা নন। তিনি সৃজনশীল শিল্পী। শিল্প সৃষ্টি করতেন। ভানুদা এমন একজন মানুষ যাঁর প্রতি আমি খুব দুর্বল। ওঁর অভিনয় নিয়ে কিছু বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। আমার কাছে ভানুদা মাত্রাহীন মাধুর্যে ভরপুর এক মানুষ।
আজ ভানুদার জন্মদিন। ভানুদা নেই। কিন্তু আমার রোজ ভানুদাকে মনে পড়ে। শুধু জন্ম কিংবা মৃত্যুদিনে নয়। আমার কাছে ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ আজীবন জীবন্ত!
The post ‘কমেডিয়ান নন, ভানুদা পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা’, স্মৃতি রোমন্থন পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের appeared first on Sangbad Pratidin.