গুরুর কাছে শিষ্য খেলা শেখেন, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সহজ, সরল ব্যাপার। কিন্তু গুরু-শিষ্য যদি একই টুর্নামেন্টে নামেন? পদক জিততে? সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা ব্যতিক্রমী তো বটেই। প্যারিস প্যারা অলিম্পিকে (Paris Paralympics 2024) তাই হল। গুরু অমিত কুমার সারোহা নামলেন। তাঁর শিষ্য ধরমবীর নাইন নামলেন। ছাত্র সোনা জিতলেন। গুরু পদক পেলেন না। কিন্তু দু'জনকে ঘিরে এক বিস্ময়-বৃত্ত সৃষ্টি হল। প্যারিসে দু'জনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে যার খোঁজ পেলেন শিলাজিৎ সরকার।
অমিত কুমায় সারোহা প্যারিস প্যারা অলিম্পিকে অংশ নিলেও পদক পাননি। কিন্তু একই অলিম্পিকে পদক জিতেছেন ভাগ শিষ্য ধরমনীর নাইন। এবং শিষ্যের পদক জয় নিয়ে অমিত কুমার সারোহা যা বললেন 'সংবাদ প্রতিদিন'কে...।
"...সবাই ইভেন্ট শেষে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। বলছেন, “মন খারাপ করবেন না আপনি।” আরে আমি মন খারাপ করতে যাব কেন? আমার ভাই, আমার বন্ধু, আমার সতীর্থ ধরমবীর সোনা জিতেছে। ওর এই সাফল্য তো আমারও সাফল্য!
আসলে দশ বছর আগে আমি ‘ক্লাব থ্রো’ শুরু করি। তখন ভারতে তেমন কেউই ইভেন্টটার নাম শোনেনি। এমনকি ফেডারেশনের কর্তাদেরও বোঝাতে বোঝাতে আমার কালঘাম ছুটেছিল। তখন কীভাবে অনুশীলন করেছি, কীভাবে তার খুটিনাটি জেনেছি- তা শুধু আমিই জানি। অন্য অ্যাথলিটদের থেকে আমাদের ‘সক্ষমতা’ অনেকটাই কম। ফলে প্রথম দিকে কেউই বিশ্বাস করতে পারত না যে আমরা ‘ক্লাব থ্রো’-র মতো কঠিন খেলায় সাফল্য পাব। সবাই তখন নৈরাশ্যের সুরে কথা বলত আমাদের সঙ্গে। বলত, আমরা পারব না। আগে দেশের কেউই খেলেনি এমন খেলা। এমনকি আমরা মরেও যেতে পারি বলে আশঙ্কা প্রকাশ করত। তবে আমি কাউকে দোষ দিতে চাই না। কারণ তখন ওঁরা এই খেলা নিয়ে ওয়াকিবহাল ছিল না। কিন্তু আমি শুরু করছিলাম। আর তার ফলাফল সবার সামনে। আমরা প্যারা এশিয়াডে ‘ক্লিন সুইপ’ করেছি, প্যারালিম্পিকে সোনা-রুপো পেলাম। এবার সবাই এই ইভেন্ট নিয়ে খোঁজখবর নেবে।
এবার ধরমবীরের সোনার প্রসঙ্গে আসি। আমি খুব খুশি। আমাদের দেশে ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস। সেখানে ও আমাকে শ্রেষ্ঠ উপহারটা দিল। শুধু শিক্ষক দিবসেরই নয়, এটা আমার কাছে এতদিনের পরিশ্রমের ফসল। পদক হয়তো আমার গলায় ওঠেনি। তবে আমার ছাত্রই তো সেটা জিতেছে। তাতেই তো আমার জয়! আমি তো ১২ বছর ধরে একা রাজত্ব করেছি এই খেলায়। এক যুগ আমার এশিয়ান রেকর্ড ছিল। আজ আমারই ছাত্র সেই রেকর্ড ভাঙল! এর থেকে সুখের মুহূর্ত আর কিই বা হতে পারে? নিজে সোনা জিতলে যতটা খুশি হতাম, ধরমবীরের সাফল্যে আমি তার থেকে হয়তো একটু বেশিই খুশি হয়েছি। ওর প্রথম চারটে ‘থ্রো’ ফাউল হওয়ায় আমি একটু চাপে পড়ে গিয়েছিলাম। তবে শেষ পর্যন্ত ও নিজের সেরা ‘থ্রো’-টা করতে পেরেছে...।"
[আরও পড়ুন: প্যারালিম্পিকে দুরন্ত সাফল্য, সমাপ্তি অনুষ্ঠানে ভারতের পতাকা বহনের দায়িত্বে প্রীতি ও হরবিন্দর]
বুধবার গভীর রাতে তিনি কথা বলার সময় গলায় আনন্দের চেয়ে গুরু অমিতের প্রতি কৃতজ্ঞতার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল বেশি। ‘ক্লাব থ্রো-র এফ৫১’ ক্যাটেগরিতে সোনা জয়ী প্যারা অ্যাথলিট ধরমবীর নাইনের বয়ান নিচে হুবহু তুলে দেওয়া হল।
"...প্যারালিম্পিকে সোনা জেতা আমার সবসময়ের একটা লক্ষ্য ছিল। আজ সেটা পূরণ হয়েছে। সেজন্য অত্যন্ত গর্ব অনুভব করছি। এই সোনার জন্য আমি দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানাই। আর ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার গুরু, আমার সতীর্থ অমিত কুমারকে। আমার এই পদক আমি অমিতজিকেই উৎসর্গ করছি। শুরু থেকেই ওঁর আশীর্বাদ আমার সঙ্গে ছিল। এটা আমার জন্য
বড় বিষয়।
[আরও পড়ুন: কেকেআরের মেন্টর হচ্ছেন বিশ্বখ্যাত অলরাউন্ডার? ক্রিকেটারের সঙ্গে শুরু আলোচনা]
আজকে আমার প্রথম চার ‘থ্রো’ ফাউল হয়েছে। পঞ্চম থ্রোয়ে সোনা জেতার পাশাপাশি এশিয়ান রেকর্ডও গড়েছি। আসলে আমাদের আঙুল কাজ করে না। বিশেষ ধরণের আঠা হাতে লাগিয়ে আমরা থ্রো করি। আজ ঠাণ্ডার জন্য সেই আঠা হাতেই জমে যাচ্ছিল। তাই প্রথম চারটে থ্রো আমার ভালো হয়নি। এমন অবস্থায় মানসিক চাপ বেড়ে যায়। আমারও বেড়ে গিয়েছিল। তবে এমন পরিস্থিতিতে আমি সবসময় কোচের দিতে তাকাই। কোচ চোখের ইশারায় অনেক কিছু বুঝিয়ে দেন। আজও তাই হয়েছে। পঞ্চম থ্রোয়ে আমি সেরাটা দিই। পদকের সঙ্গে এশিয়ান রেকর্ড গড়তে পেরে আমি খুশি। এর আগে ৩৩ মিটারের বেশি রেকর্ড ছিল, সেটা প্রণব ভেঙেছিল। আমি ওর রেকর্ড ভাঙলাম। এভাবেই চলতে থাকবে। অমিতজির পর আমি, প্রণব উঠে এসেছি। আমাদের পর আরও অনেকে উঠে আসার জন্য তৈরি হচ্ছে। আশা করছি এভাবেই ‘ক্লাব থ্রো’ ইভেন্টে ভারতীয়দের দাপট অব্যহত থাকবে...।"