লোন এখন সহজলভ্য। যুগটা ডিজিটাল যে! কিন্তু লাগামছাড়া খরচ এবং বাহুলতা মানুষের ব্যয় করার ক্ষমতাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। এর ফলে ক্ষতির মুখে পড়ছি আমরাই। নিজেদের নিজেরাই ফেলে দিচ্ছি প্রবল চাপের মুখে। কারণ লোন মেটানোর সঙ্গে সঙ্গেই দিতে হচ্ছে চড়া হারে সুদও। এই জাল কেটে বেরোনোর উপায় কী? বিশদে আলোচনা করলেন সুমন্ত চক্রবর্তী
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় চিন্তায়? যে কর্পোরেট জবটা চলে গেলে লোনের ইএমআই দেব কী করে? ক্রেডিট কার্ড পেমেন্ট কী করে হবে? হ্যাঁ, যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এটা কিন্তু বাস্তব। ‘নাইন্টিস কিড’, যাঁদের আজকে চল্লিশ-পয়তাল্লিশের কোঠায় বয়স, সকলেই প্রায় বেসরকারি ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, বা অনেকেই উচ্চপ্রতিষ্ঠিত, প্রতিনিয়ত এই চিন্তা নিয়েই বাঁচছেন সবাই।
আসলে, গত কুড়ি-তিরিশ বছরে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে একটা নিঃশব্দ বিপ্লব হয়ে গিয়েছে। মুক্ত অর্থনৈতিক কাঠামোয় চাকরি প্রায় সকলের জন্য, সব ক্ষেত্রেই তৈরি হয়েছে। যেটা খুব ভাল একটা দিক। আপনি পড়াশোনায় খুব ভাল না-ই হতে পারেন, কিন্ত খুব ভাল ছবি আঁকেন। মাল্টিমিডিয়ার ভাল একটি কোর্স করে নিলে আপনার জন্য রয়েছে গ্রাফিক্স ডিজাইনার এর চাকরি। এটা উদাহরণ মাত্র, এ রকমই সম্ভাবনা রয়েছে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে। আইটি সেক্টরে আর শুধু ওই চার-পাঁচটি বড় কোম্পানি না, ছোট বড় স্টার্ট আপের যুগে, আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী একটি চাকরি আপনি খুঁজে নিতেই পারবেন। সমস্যা সেখানে না, সমস্যাটা হল আজকের ভোগবাদী দুনিয়ার রংচংে বিজ্ঞাপনে মানুষ ভুলে গিয়েছে যে, একটা চাকরি থাকা মানেই সকলের ক্রয়ক্ষমতা একরকম হয়ে যাচ্ছে না। সব পণ্যের বিজ্ঞাপন সকলের জন্য না।
আর, এই অসম ক্রয়ক্ষমতার মেলবন্ধন করে সকলকে একই ব্র্যাকেটে নিয়ে আসার কাজটা করে লোন। লোন এখন সহজলভ্য। তিন মাসের পে স্লিপ, এক বছরের আইটি আর, মোটামুটি একটা স্যালারি–ব্যস! আপনি যা চান সেটাই আপনার ক্রয়ক্ষমতার মধে্য!! .. দামী স্মার্ট ফোন কিনবেন, লোন কোম্পানি বসে আছে দোকানেই। বিদেশ যাবেন? ট্র্যাভেল এজেন্সি নিজেরাই লোনের ব্যবস্থা করে দেবে। সোনা বন্ধক রেখে গোল্ড লোন নিয়ে বিদেশ ঘুরতে যাচ্ছেন লোকজন। পাড়ার দোকানে বা বাজারে গিয়ে মার্কেটিং এখন আউট-ডেটেড, অনলাইন বা নিদেন পক্ষে শপিং মলে ছাড়া আমরা কিছু কিনি না। এই অনলাইন শপিং বা মলের ঊইন্ডো শপিংয়ে পছন্দ হওয়াটাই বড় কথা, সেটার দাম কত এটা এখন গৌণ। কারণ? মানুষ জানেন, ক্ষমতার মধে্য থাকলে ঠিক আছে, আর না থাকলেও কুছ পরোয়া নেই, হাতের মুঠোয় তো আছেই লোন, শুধুই একটা ক্লিক!! আর ডিজিটাল লেনদেনের এই সমাজে হাজার টাকা বের করতেও একটা ক্লিক্, লাখ টাকাতেও ওই একটা ক্লিক-ই! আগের মত নোট গুনে গুনে দেওয়ার ব্যাপার তো নেই, তাই পকেট থেকে ঠিক কতটা চলে গেল, চোখে দেখা যাচ্ছে না ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট না দেখলে! তাই চলছে লাগামছাড়া খরচ বা টেকনিক্যাল পরিভাষায় যাকে বলে Impulsive Buying. এটি এমন একটি কেনাকাটা যা কোনও পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই আমরা করি, আমার সেই জিনিসটি কতটা দরকার সেটা তলিয়ে না দেখে, ইচ্ছা হল তো সেটি কিনে ফেললাম।
ফিনান্সিয়াল মার্কেটে এই বদলটা আসার ভাল দিক হল, কোনও এক বা এক শ্রেনীর ব্যাঙ্ক বা লোনদাতাদের মৌরসীপাট্টা ভেঙে গেছে। এসেছে প্রতিযোগিতা আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে ভাল হয়েছে পরিষেবার মান। পান থেকে চুন খসলেই কমপ্লেন্ট আর কাস্টমার চলে যাবে অনে্যর কাছে। তটস্থ সব কোম্পানি। ব্যাঙ্কে গিয়ে আ্যাকাউন্ট খোলার জন্য হতে্য দিয়ে পড়ে থাকার দিন শেষ। কিন্তু, এর সঙ্গে সঙ্গেই, লোনের সহজলভ্যতা, মানুষের ব্যয়ক্ষমতাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। ফিনান্সিয়াল ফ্রিডমের চক্করে কোনটা প্রয়োজনীয় কোনটা অপ্রয়োজনীয়, এটা ভুলে যাচ্ছি আমরা।
আর, তার ফলে, নিজের অজান্তেই আমরা নিয়ে ফেলছি প্রানান্তকর চাপ! লোন নিয়ে বিদেশ ঘোরা তো হল, ফিরে এসে, সুদে-আসলে শোধ তো আপনাকেই দিতে হবে। হাচব্যাক গাড়ী কিনলেই কাজ চলে যায়, কিন্তু অমুকের বড় SUV আছে, আমার গাড়ী ছোট হলে চলবে কী করে! তাই আমারও অত বড়ই SUV চাই, মুশকিল আসান হল লোন। লোনের মেয়াদ বাড়িয়ে দিচ্ছি ৫ বছর থেকে ৭ বছর, ইএমআই কমানোর জন্য, বদলে নিচ্ছি আরও ২ বছর লোন পরিশোধের মেয়াদ, গুণছি অতিরিক্ত সুদ!
জীবনে চিন্তামুক্ত থাকতে চাইলে, এই প্রবণতা কমান। ভোগবাদী দুনিয়ায় ভোগ করার অধিকার সবার আছে, কিন্তু ততটাই ভোগ করুন যতটা আপনার সামর্থ। কিপটে হতে বলছি না, কিন্তু Impulsive Buying আর Rational Buying-এর পার্থক্যটা বুঝুন। কর্মজীবনের প্রথম দিন থেকে disciplined investment-এর অভ্যাস তৈরি করুন। আজকের দিনে শুধু ব্যাঙ্কে এফ.ডি করে সঞ্চয় করতে হয় না। সময় পাল্টে গেছে। মিউচুয়াল ফান্ডে সিপ-সহ আরো হাজার একটা পথ রয়েছে উদ্বৃত্ত অর্থ সঠিকভাবে ইনভেস্ট করে ভবিষ্যতের পুঁজি তৈরির। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। আপনি নিজেই সব জানেন সেটা নাও হতে পারে। নিয়ে নিজের জন্য একটা লাম্পসাম পুঁজি তৈরির নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক রোডম্যাপ বানান, ছোট ছোট কিছু মাইলস্টোন রেখে, যেগুলি সঠিক সময়ে স্পর্শ করতে পারলে নিজেকে নিজে একটা চিট ট্রিট দেবেন–ছোট্ট একটা কিছু কিনে, লোন না নিয়ে।
একটা জিনিস মনে রাখতে হবে- লোন কিন্ত ধার। ধার শোধ বা ধার বাকি, রাতের ঘুম এরাই কাড়ে। অনিশ্চিত বেসরকারি ক্ষেত্রে আপনার রক্তচাপ বাড়ায়। আর পুঁজি হল আপনার শক্তি। জীবনে যত তাড়াতাড়ি কেউ একটা বলার মত পুঁজি বানিয়ে নিতে পারবেন, আপনার দুশ্চিন্তা সেদিন আপনিই দূর হয়ে যাবে। নিজের অজান্তেই দেখবেন আপনার চিন্তা-ভাবনা বা ডিসিশন মেকিং কত স্বচ্ছ হয়ে গেছে।
কনসিউমার লোন ছেড়ে দিন! এখন তো অনেক বিশেষজ্ঞ, জীবনে খুব কম বয়সে বিশাল হোম লোন নিয়ে বাড়ী কেনার প্রবণতাকেও প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন। আপাতত এবার সেই আলোচনা থাক, কারণ এর পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি-তর্ক আছে। পরে কোনওদিন এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে, অঙ্কের সাহায্য নিয়ে।
যাই হোক, নতুন বছর আসতে আর বেশি দেরী নেই। মাস খানেকের অপেক্ষা। এবারের নিউ ইয়ার রেসলিউশন হোক না যে, খরচ ততটাই করব যতটা দরকার? বাকি মন দেব সঞ্চয়ে। রাতের ঘুম খুব দামি। কোন পরিস্থিতিতেই তার সাথে আপোস করা যায় কি?
লেখক: প্রাক্তন সিনিয়ার ব্যাঙ্কার ও ব্যাঙ্কিং প্রশিক্ষক
