shono
Advertisement

Breaking News

রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা: হাওয়াবদলের কান্ডারি

‘স্কাই ইজ দ‌্য লিমিট।’ বারবার বলতেন রাকেশ।
Posted: 05:14 PM Aug 19, 2022Updated: 05:14 PM Aug 19, 2022

রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার ব‌্যাপ্তি শুধু স্টকের মূল্যে সীমাবদ্ধ নয়। কোন স্টকে বিনিয়োগ করা উচিত, বা কোন সংশ্লিষ্ট সংস্থার অবদান বাজারে অনন‌্য, এই জাতীয় প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে থাকে যে-প্রজ্ঞায়, তা তাঁর ছিল। এখন বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী যখন দ্রুত কেনাবেচায় বিশ্বাসী, চটজলদি টাকা রোজগারের অভীপ্সায় বাজারে পা রেখেছেন, সেখানে স্টক চিহ্নিত করে ধরে রাখার ধৈর্য কুর্নিশযোগ‌্য। লিখছেন নীলাঞ্জন দে

Advertisement

 

স্কাই ইজ দ‌্য লিমিট।’ বারবার বলতেন রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা। যাঁর সদ‌্য প্রয়াণের পরিপ্রেক্ষিতে ‘নক্ষত্রপতন’ কথাটা সর্বাগ্রে কলমের ডগায় এল। স্টক মার্কেটে কিংবদন্তি-সমান ছিলেন যিনি, তাঁর জন‌্য অন‌্য কোনও শব্দ ঠিক খাটে না, বিশেষত যেখানে সমতুল‌্য আর কেউ নেই। নামী ইনভেস্টর তো অনেকেই আছেন, তাঁদের পোর্টফোলিও নিয়ে যথেষ্ট চর্চাও চলে। কিন্তু ওঁর ধার এবং ভার, এই দুইয়ের কাছাকাছিও কেউ নেই।

হর্ষদ মেহতাকে ভুলিনি নিশ্চয়ই। তবে সে-যুগ ছিল আলাদা, দুই পরিস্থিতির তফাত প্রচুর। কিন্তু তিনিই ছিলেন চিরন্তনী লেজেন্ড। তার কারণ ভিন্ন, নয়ের দশকের প্রারম্ভে হওয়া স্ক‌্যামের সঙ্গে একশ্বাসে সেই ‘বিগ বুল’-এর নাম এখনও উচ্চারিত হয়। হর্ষদ যদি ভারতের সাধারণ বিনিয়োগকারীকে পথের দিশা দেখিয়ে থাকেন, মহাজ্ঞানী মহাজন হিসাবে সে-পথে হাঁটার সাহস জুগিয়েছেন রাকেশ। তাঁর উত্থান এমন এক সময়ে, যখন দেশের আনাচকানাচে দু’টি স্লোগান প্রায়শ শোনা গিয়েছে।

[আরও পড়ুন: মোদির লালকেল্লার ভাষণ ও ভাগবতের ‘অখণ্ড ভারত’ ভাবনার মিল কোথায়?]

‘ফিন‌ানশিয়ালাইজেশন অফ সেভিংস’ এবং ‘ফিন‌ানশিয়াল ইনক্লুশন’। ইচ্ছা করেই বেশি ওজনদার বিষয়টা দ্বিতীয় স্থানে রাখলাম। ‘ইনক্লুশন’ বর্তমানে সরকারিভাবে ঘোষিত এক নীতি। বহুভাবে প্রান্তিক মানুষকে ‘মেনস্ট্রিম ব্যাংকিং’ অথবা স্বীকৃত আর্থিক পরিষেবার মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। নানা ধরনের প্রকল্পের মাধ‌্যমে তা সম্ভবও হয়েছে, যদিও এখনও বহু মাইলের পথ হাঁটা বাকি। ফিন‌ানশিয়ালাইজেশন, অর্থাৎ সুষ্ঠু লগ্নির বৃত্তের বাইরে পড়ে থাকা উদ্বৃত্ত যথাযথভাবে বিনিয়োগ করা, তাও আজ পিছিয়ে নেই। সাবেকি আমানত ছেড়ে স্টক-ফান্ড-ইনসিওরেন্সে আগ্রহী মানুষের সংখ‌্যা ক্রমশই বাড়ছে। সব মিলিয়ে যে অমল ধবল পালে যুগের হাওয়া লেগেছে, সন্দেহ নেই।

রাকেশকে এই হাওয়াবদলের বাতাবরণে ‘নৌকার কান্ডারি’ হিসাবে দেখা যেতে পারে। স্টকে লগ্নি সম্বন্ধে যে দ্বিধা-ভীতি ছিল, তা কাটিয়ে উঠছি আমরা; আরও বেশি বিনিয়োগের জন‌্য প্রস্তুত হয়েছে মানুষ। আর এই ট্রেন্ডের পুরোভাগে তিনি এবং তাঁর অনুগামীরা। তাঁর করায়ত্ত ছিল চিরকালের সেই কাঙ্ক্ষিত সূত্রটি- নেতৃত্ব দেওয়ার কৌশল। অযথা ক্ষমতার দেখনদারি পরাক্রম, যা জনসাধারণ কখনওই চায় না, তাঁর ছিল না। আর, সেজন‌্যই চটুল চর্চার মাঝে তিনি ছিলেন না কখনও। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তাঁর ফুলহাতা সাদা জামা কুঁচকে গেলেও নয়, বা টেলিভিশনে কিঞ্চিৎ মজলিশি ধাঁচের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মুহূর্তেও নয়।

অথচ তাঁর পোর্টফোলিওর মধে‌্য থাকা নির্দিষ্ট কিছু স্টক নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে অনেক কাল ধরেই। পুরনো জমানার ‘টাইটান’ এবং ‘ক্রিসিল’, বা পরবর্তী কালের ‘স্টার হেল্‌থ’ এবং ‘মেট্রো ব্র‌্যান্ডস’ নিয়ে তো অনেকেই জানেন। এসব সংস্থার স্টক ছিল তাঁর হোল্ডিংসের তালিকায়। সামান‌্য কয়েক হাজার টাকার পুঁজি সম্বল করে যিনি বিনিয়োগ শুরু করেছিলেন, তিনি হয়ে উঠেছিলেন দেশের অগ্রণী লগ্নিকারীদের অন‌্যতম। তাঁর পোর্টফোলিওয় এই সমস্ত স্টকের অবদান অসীম।

অসীমের ব‌্যাপ্তি শুধু স্টকের মূল্যে নয়। তার প্রতিফলন লগ্নির ধরনধারণে, দূরদৃষ্টি না থাকলে যা মরুপথে ধারা হারানো নদীর মতো শুকিয়ে যেত। কেন করবেন কোনও বিশেষ স্টকে বিনিয়োগ, বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার অবদান কি বাজারে সত্যিই অনন‌্য? এই জাতীয় প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে থাকে যে-প্রজ্ঞায়, তা রাকেশের ছিল। সেজন‌্যই তিনি কিনেছিলেন অতি বৃহৎ ‘টাটা মোটরস’ বা তুলনায় ক্ষুদ্র ‘কারুর বৈশ‌্য ব‌্যাঙ্ক’। আজ বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী যেখানে দ্রুত কেনাবেচায় বিশ্বাসী, চটজলদি টাকা রোজগারের অভীপ্সায় বাজারে পা রেখেছেন, সেখানে স্টক চিহ্নিত করে ধৈর্য ধরে রেখে দেওয়ার প্রয়াস কুর্নিশযোগ‌্য।

বাজারে যে প্রসঙ্গটি ইটারনাল, তা হল, লগ্নির স্থায়িত্ব। আপনি যদি ‘ডে ট্রেডার’ হিসাবে পরিচিত হতে চান, তাহলে আপনার কার্যকলাপ হবে এক ধরনের। কোনও পজিশন পরেরবারের জন‌্য রেখে না দিয়ে, চটপট ছেড়ে দেওয়াই আপনার ধর্ম। আবার যদি পায়ে বল রেখে প্রতিপক্ষকে (পড়ুন: প্রতিকূলতা বা রিস্ক) এড়িয়ে কাটাতে কাটাতে গোল করতে চান, তাহলে আপনার চরিত্র অন‌্যরকম। আবার মধ‌্য বা দীর্ঘমেয়াদ ছাড়া ভাবতেই পারেন না যিনি, তাঁর শৈলী সম্পূর্ণ ভিন্ন। এত বৈচিত্রে‌র মধ্যে অবশ‌্য মূল সুর একই- লগ্নির মাধ‌্যমে আর্থিক সাফল‌্য আনা। সার্বিক মঙ্গল যে সে-পথেই আসে!

সদ‌্যপ্রয়াত রাকেশকে নিয়ে অতি-সক্রিয় সমাজমাধ‌্যমে চোখ রেখে দেখা গেল, অনেকেই নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছেন। ‘ওয়েল্‌থ’ বড় না ‘হেল্‌থ’, এই অমোঘ প্রশ্নও উঠেছে। সেই মানুষটি কি ‘স্বাস্থ‌্যই সম্পদ’ এই আপ্তবাক্যে বিশ্বাসী ছিলেন? গল্প-কোট-স্মৃতিচারণা ইত‌্যাদির ছড়াছড়িতে ঠিক বোঝা গেল না, তবে এক আপাত-লঘু কিন্তু ব‌্যঞ্জনাময় উক্তি দেখতে পেলাম। ‘অর্থ কী দিয়েছে আপনাকে?’ এই প্রশ্নের উত্তর তিনি বলেন, “আজ অর্থ আছে, তাই ‘মার্সিডিজ’ চড়ি, ‘মারুতি’ নয়। পাঁচ হাজার স্কোয়্যার ফুটের ফ্ল‌্যাটে থাকি, হাজার স্কোয়্যার ফুটের নয়। ‘ফোর স্কোয়্যার’ সিগারেট ছেড়ে ‘ইন্ডিয়া কিংস’ খাই। ‘ব্লু লেবেল’ হুইস্কি খাই, ‘ডিপ্লোম‌্যাট’ নয়। এর বাইরে অর্থ আর তেমন কোনও পরিবর্তন আনেনি আমার জীবনে।”

এই উত্তরেই পরিস্ফুট এক চিরকালীন শিক্ষা। আধুনিক প্রজন্মের জন‌্য সবিশেষ উল্লেখ‌্য। অতীতে আমাদের মন ছুঁয়ে গিয়েছেন যাঁরা, তাঁরাও কি এমনই শেখাননি? হ্যাঁ, নব‌্য গুরুরাও তো একই বার্তা দিয়ে থাকেন ইদানীং। যত পারুন অর্থ রোজগার করুন, সৎ পথে করুন। নিজের জন‌্য খরচ করতেও কসুর করবেন না। কিন্তু অর্থগৃধ্নু হবেন না, অর্থের জন‌্য অনৈতিক পরিকল্পনা করবেন না, বরঞ্চ দীন-হীনকে যথাসম্ভব সাহায‌্য করুন।

রাকেশ দিতে কার্পণ‌্য করেননি, এ-কথাও মনে রাখবে মানুষ দীর্ঘকাল। সেতুবন্ধনে কাঠবিড়ালীর অবদান ছিল সামান‌্য, খেয়াল করুন। আমাদের করে যেতে হবে নিজস্বভাবে, সামান‌্যটুকুই সম্বল করে। অন‌্য যে রাকেশরা আগামী দিনে আসবেন, তাঁদের পায়ের আওয়াজ শোনা যাবে অচিরেই। তাঁদের চলার রাস্তা সুগম। দৃঢ় পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছনোর মহিমা যে কী, তা যিনি বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, সেই তিনি আজ তমোনাশ।

[আরও পড়ুন: পৃথিবীতে কত মশা আছে? কতদিন ধরেই বা চলছে মশার মস্তানি]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement