সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ঈশ্বর হয়ে কি কোনও মানুষ জন্মায়? হয়তো না। তবু এই মানুষের সাধারণ অরণ্যেই থাকে সেই পোস্টম্যান, যিনি ফিরি করতে পারেন ঘাম-রক্তে গড়া এক অসম্ভবের দুনিয়ার স্বপ্ন। মানুষ নির্বিকল্পভাবেই তাঁকেই বসায় ঈশ্বরের আসনে। বিশ্বায়ন উত্তর ভারতবর্ষ সাক্ষী থেকেছে বহুকিছুর। দেখেছে, তার চোখের সামনে দিয়েই কতকিছুতে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে গিয়েছে বাকি বিশ্ব। কত ক্ষেত্রে যে অনেক চেয়েও পিছিয়ে পড়তে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। তবু এই নব্য ভারত অতি গোপনে লালন করেছে এক পরম শ্লাঘাকে। গোটা বিশ্বের আর যাই থাক, শচীন তেন্ডুলকর নেই। সেই শচীন, যিনি কোটি ভারতবাসীর হয়ে ব্যাট হাতে নামতেন বাইশ গজে। শুধু কী ক্রিকেট! সে তো নিছক এক খেলামাত্র। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে ভারতের প্রতিটি কোণ জানে, শচীন শব্দের অর্থ কী। শচীন মানে আত্মমর্যাদার কোন শিখরে পৌঁছনো। তিনি এমন দেশে জন্ম নিয়েছেন যেখানে ক্রিকেট ধর্মেরও উর্ধ্বে। আর তাঁর সেই ধর্মের ঈশ্বর হয়ে ওঠার কাহিনিই বলল এই ছবি।
ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তির সেই জীবন, বলা ভাল সে রূপকথার আখ্যানই বড় পর্দায় তুলে এনেছেন পরিচালক জেমস এরস্কিন। তা কেমন হল সে ছবি?
আসলে ভারতবাসীর কাছে শচীন নামের এই মহাকাব্যের কোনও পৃষ্ঠাই যেন অজানা নয়। ব্যাট-প্যাড নামিয়ে রেখেছেন তো বেশ কিছুদিন হয়ে গেল। তবু আজও যে কেউ চোখ বুঝলেই দেখতে পান, উইলো হাতে দুনিয়া শাসন করছেন লিটল মাস্টার। প্রতিবেশী পাকিস্তানের পেস আক্রমণকে ছিন্নভিন্ন করে তাঁর বাউন্ডারি উড়ে যাচ্ছে, অজানা এক যুদ্ধজয়ের দিকে। অষ্ট্রেলিয় ঔদ্ধত্যে লাগাম পরাচ্ছেন ওয়ার্ন নামক এক গ্রহকে শাসন করে। ক্রিকেট খেলিয়ে এমন কোনও দেশ নেই, যা তাঁর ব্যাটের ঔদ্ধত্যের সামনে বশ্যতা স্বীকার করেনি। আদ্যন্তে লাজুক মানুষটি যেন এক্ষেত্রে চরমতম নিষ্ঠুর, প্রহারপ্রবণ, সংহারী। এতটুকু রেয়াত নেই, এতটাই নির্দয়। সেই সঙ্গে নিরাসক্তও। গোটা দেশকে বিনোদন উপহার দিতে দিতে নিজের জন্য এক মুহূর্তও রাখেননি। বাবার মৃত্যুর পরদিনই তাই ফিরে গিয়েছেন বিশ্বকাপের ময়দানে। সেঞ্চুরি করেছেন, দেশকে জিতিয়েছেন, তারপর স্বভাবসিদ্ধভাবে মুখ তুলে তাকিয়েছেন আকাশের দিকে। আর ভারতবাসী সেই মুদ্রায় সেদিন দেখেছিল, এমন এক আকাশ যার উদাহরণ অন্তত বিগত কয়েক দশকে তার হাতের সামনে ছিল না। দেশ নায়ক পেয়েছে অনেক, কিন্তু স্বাধীনতাত্তোর ভারতে নায়কের স্বীকৃতিটি তাই তাঁর জন্য তুলে রাখতে এতটুকু দ্বিধা করেনি ভারতবাসী। সেই জেদ, সেই অধ্যবসায়কেই ফিরিয়ে এনেছেন পরিচালক। ফ্রেমে ফ্রেমে তাই রাখা আছে নস্ট্যালজিয়ার রসদ।
১৬ নভেম্বর ২০১৩-এদিন চোখের কোণ ভিজে ওঠেনি এমন ভারতবাসী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ২২ গজের সাধনক্ষেত্রকে শেষবার প্রণাম করে ফিরে গিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের সন্ন্যাসী রাজা। রাজার মেজাজ লেগে আছে তাঁর গোটা কেরিয়ারে, অথচ ততটাই নির্লিপ্তি তাঁর আয়ত্তাদীন। জীবনের যাবতীয় সুখ থেকে মুখ ফিরিয়ে ক্রিকেটের জন্য যেন তিনি বলিপ্রদত্ত। আসলে তো দেশের জন্য। এও তো এক যুদ্ধ। জয় গোস্বামীর সেই কবিতার স্মৃতি ফিরে আসে। সত্যি শচীন তো শুধু নিজের জন্য খেলেননি। প্রতিটি বল তাঁর সঙ্গে খেলেছে কোটি কোটি দেশবাসী। আর কোটি দেশবাসীর হয়ে জয় ছিনিয়ে এনেছেন তিনি। ২৬ মে সেই স্মৃতিই ফিরে এল ‘শচীন: দ্য বিলিয়ন ড্রিমস’ ছবির হাত ধরে। আর চোখের সামনে ফিরল ভারতীয় ক্রিকেটের সুবর্ণ যুগের বেশ কিছু মুহূর্ত। যে মুহূর্তের পরতে পরতে রয়েছে মাস্টার ব্লাস্টারের কীর্তি। ক্রিকেট কেরিয়ারে তিনি দেশকে দিয়ে যাননি, এমন কিছু নেই। আর তাই তো তাঁকে মনের মণিকোঠায় স্থান দিয়েছে গোটা বিশ্ব।
[আইনি গেরোয় সুশান্ত-কৃতির ‘রাবতা’]
‘আজহার’ অথবা ‘এমএস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ বায়োপিকের মতো পরিচালক জেমস এরস্কিনের ছবিতে শচীনের ভূমিকায় কেউ আলাদা করে অভিনয় করেননি। হয়তো প্রয়োজনই হয়নি। কারণ তিনি একাই একশো। তাই ডকুমেন্ট্রিতে মধ্যবিত্ত মারাঠি পরিবারের ক্রিকেটারের ‘ঈশ্বর’ হয়ে ওঠার কাহিনি পরিচালক বলিয়েছেন গোটা বিশ্বের কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের মুখ দিয়ে। হ্যাঁ, ছোটবেলার দুষ্টু, বেয়াদব শচীনকে ফুটিয়ে তুলতে অবশ্য খুদে অভিনেতাদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন তিনি। তবে ভারতীয় দলে জায়গা করে নেওয়া থেকে অবসর নেওয়া পর্যন্ত পরিচালক ব্যবহার করেছেন শচীনের রিয়েল লাইফের বেশ কিছু দুর্মূল্য ছবি ও ভিডিও। যেখানে দর্শকরা টাইম মেশিনে চড়ে পৌঁছে গিয়েছেন ১৮৮৯ সালে। যখন প্রথমবার দেশের জার্সি গায়ে মাঠে নেমেছিলেন ১৬ বছরের শচীন। গ্যালারিতে বসে যেন আরও একবার বাইশ গজে তাঁর সুখ-দুঃখ, হাসি, ঠাট্টা, পরিশ্রমের কাহিনি দেখলেন তাঁরা। কীভাবে আবদুল কাদির, ওয়াসিম আক্রম, শেন ওয়ার্নদের চোখে ঠাট্টার বদলে শ্রদ্ধা কেড়ে নিয়েছিলেন। কীভাবে দলের খারাপ পারফরম্যান্স অধিনায়ক শচীনকে রাতের পর রাত জাগিয়ে রেখেছিল। মাত্র ২৩ বছর বয়সে দলের নেতৃত্বের ভার দেওয়া হয় তাঁর কাঁধে। তখন দলে ছিলেন একাধিক সিনিয়র খেলোয়াড়। সেই কারণেই দলগতভাবে ভাল খেলত না ভারত। এভাবেই ছবিতে শচীনের উপর হওয়া রাজনীতিকেও এড়িয়ে যাননি পরিচালক। একবিংশ শতকের গোড়ার দিকে ম্যাচ গড়াপেটা ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল শচীনের মনকে। স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে নিজের সঙ্গে লড়াই চালিয়েছিলেন প্রতিনিয়ত।
[১৫০০ কোটির মাইলস্টোন পেরোল ‘দঙ্গল]
শচীন শুধু একজন কিংবদন্তি ক্রিকেটারই নন। তিনি ১৩০ কোটি ভারতবাসীর অনুপ্রেরণা। তাঁকে দেখে জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর রসদ খুঁজে পান ভেঙে পড়া আম আদমি। বাবা রমেশ তেণ্ডুলকর প্রয়াত হওয়ার পরের দিনই বিশ্বকাপে কেনিয়ার মুখোমুখি হয়ে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। অনুপ্রেরণা জোগানোর জন্য এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী-ই বা হতে পারে! প্রতিটি ক্রিকেটারকে তিনি বুঝিয়েছেন, নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য খেলতে হবে। আর তাই দীর্ঘ ২৫ বছরের কেরিয়ারে টেস্ট ও ওয়ান ডে মিলিয়ে ১০০টি শতরানের একমাত্র মালিক, ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত শচীনের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মুহূর্ত ২০১১ সালে বিশ্বজয়ী হওয়া।
এত বছরে শচীনের খুঁটিনাটি প্রায় সবই জেনে গিয়েছেন তাঁর অনুগামীরা। তা সত্ত্বেও বায়োপিক দেখে একঘেয়ে লাগবে না। ইন্টারনেটের দৌলতে youtube-এ অনেক ভিডিওই চেনা। কিন্তু পরিচালক যেভাবে একের পর এক ঘটনাকে এক সুতোয় বেঁধে তুলে ধরেছেন, তাতে দিব্যি ২ ঘণ্টা ১৮ মিনিটের ছবি উপভোগ করবেন সিনেপ্রেমীরা। ক্রিকেটের বাইরে ছেলে, স্বামী ও বাবা মাস্টার ব্লাস্টারকে আরও বিষদভাবে জানলেন দর্শকরা। শচীনের জন্য কম আত্মত্যাগ করেননি অঞ্জলি। তাই তো সিনেমা শেষে তাঁদের প্রেমকাহিনিকে কুর্নিশ জানালেন দেশবাসী।
দেশে ক্রিকেটের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করেছেন শচীন। দেশকে অনেকটা দিয়েছেন, উল্টে দেশের থেকে পেয়েওছেন অনেকটা। তাই কেরিয়ারের ছোটখাটো অপ্রীতিকর মুহূর্তগুলি নিয়ে আর বিষন্ন নন তিনি। তবে সোনু নিগমের সঙ্গে শচীনের যে গানটি জনপ্রিয় হয়েছিল, তা ছবিতে নেই। তাছাড়া শচীন কার সঙ্গে জুটি বাঁধতে বেশি পছন্দ করতেন বা কার নেতৃত্বে টেস্টে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল টিম ইন্ডিয়া, এসব খুঁটিনাটি ডকুমেন্ট্রিতে অব্যক্তই থেকে গেল। শচীন ভক্তদের অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না। হল থেকে বেরিয়ে তাঁদের মুখে নতুন করে একটিই ধ্বনি উচ্চারিত হল। ‘শচীন… শচীন…’।
পরিচালক: জেমস এরস্কিন।
সঙ্গীত পরিচালক: এ আর রহমান।
রেটিং: ৩.৫/৫
The post শিশু থেকে ‘ঈশ্বর’ হওয়ার কাহিনি বলল ‘শচীন: দ্য বিলিয়ন ড্রিমস’ appeared first on Sangbad Pratidin.