বিশ্বদীপ দে: খুব সামান্য জিনিসই রয়েছে যা ছেলে-বুড়ো সবাইকে সমান আমোদ দেয়। তালিকা তৈরি করতে বসলে ম্যাজিককে বাদ দিয়ে সেই তালিকা সম্পূর্ণ হতেই পারে না। ঝলমলে পোশাকে মঞ্চে তাক লাগানো জাদু থেকে মাদারি কা খেল- জাদু যুগে যুগে সমাজের সব স্তরের মানুষেরই চূড়ান্ত মনোরঞ্জন করে এসেছে। আর তাই কিংবদন্তি হয়ে ওঠা জাদুকরদের ঘিরে সব সময়ই থাকে বিস্ময়ের কুয়াশা। আমাদের পি সি সরকার জুনিয়র বা সিনিয়ররা (P C Sorcar) তো আছেনই। আলোচনা আজও অব্যাহত প্রায় একশতক আগে প্রয়াত এক জাদুকরকে নিয়েও। তিনি হ্যারি হুডিনি (Harry Houdini)। জাদু দেখিয়ে, বিশেষ করে ‘এস্কেপ আর্টিস্ট’ হিসেবে তিনি বিশ্বজয় করেছিলেন। অথচ জাদুই শেষপর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল। কীভাবে? সেই করুণ ইতিহাস বলার আগে জানিয়ে দেওয়া দরকার হুডিনি তাঁর জাদু দেখিয়ে ঠিক কোন অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিলেন।
মার্কিন-হাঙ্গারিয়ান বংশোদ্ভূত হুডিনির মূল খ্যাতি এস্কেপ আর্টিস্ট হিসেবেই। অর্থাৎ তাঁকে যতই কঠোর বাঁধনে বাঁধা হোক, তিনি নিজেকে ঠিক মুক্ত করে নিতে পারতেন। তাঁর স্টান্টও ছিল তাক লাগানো। কালে কালে তাঁর গায়ে জুড়ে যেতে থাকে অলৌকিকের তকমা। তাঁর এই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ক্যারিশ্মার জন্ম বিংশ শতকের গোড়ায়। এর আগে ১৮৯১ সাল থেকে কিশোর বয়সেই জাদুকর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেও বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি তিনি। কিন্তু ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়সে লন্ডনের এক জেলারের সঙ্গে দেখা করে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন। কেমন চ্যালেঞ্জ? হুডিনিকে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতকড়া পরিয়ে সবচেয়ে সুরক্ষিত লক আপে ঢুকিয়ে দেওয়া হোক। তিনি বেরিয়ে আসবেন! যেমন কথা তেমন কাজ। সত্য়িই নিজেকে অতি দ্রুত বন্ধনমুক্ত করে জেলের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন হুডিনি। দেখে তাক লেগে গেল সকলের। কিন্তু পাশাপাশি সন্দেহও দানা বাঁধল। নির্ঘাত কোনও রকম ছলচাতুরি করেই এই কাজ করছে ছেলেটা! এরপর আনা হল এমন হাতকড়া, যাকে চাবি দিয়ে খোলাও বেশ কসরতের। খুলে ফেলা হল তাঁর সমস্ত পোশাক, যাতে কোনও ভাবেই তার আড়ালে চাবি লুকিয়ে না রাখতে পারেন আগে থেকে। রাখা হল এমন জেলে, যেখানে একটা নয়, তিনটে লক। লোকেরা ভাবল, পড়েছে এইবার হুডিনি প্যাঁচে! কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল হুডিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন মুক্ত হয়ে!
[আরও পড়ুন: ভিন্দ্রানওয়ালের স্মৃতি উসকে ফের অশান্ত পাঞ্জাব, কেন শুরু হয়েছিল খলিস্তানি আন্দোলন?]
সেই শুরু। রাতারাতি খ্যাতির মধ্যগগনে পৌঁছে গেলেন হুডিনি। জীবনে আর কখনও তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এমনকী, মৃত্যুর প্রায় একশো বছর পরেও তাঁকে নিয়ে গল্পগাছার শেষ নেই। একের পর এক জেলে নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দি করে সেখান থেকে মুক্ত হয়ে হুডিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি অপ্রতিরোধ্য। হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি। তাঁর শো দেখতে উপচে পড়ত ভিড়। মঞ্চে নানা রকম অদ্ভুত খেলা দেখাতেন তিনি। এর মধ্যে একবার তো আস্ত হাতিই ভ্যানিশ করে বসলেন! খ্যাতির পারদ সব সময়ই তুঙ্গে। এখানে বলে রাখা ভাল, হুডিনি কিন্তু কেবল জাদু দেখাননি। চলচ্চিত্রও বানিয়েছেন। তবে সেসব তেমন চলেনি। অস্ট্রেলিয়ায় সেই সময় সদ্য আবিষ্কৃত এরোপ্লেন চালিয়েও নজির গড়েছিলেন। সেই সঙ্গে আবিষ্কারকও ছিলেন তিনি। তাঁর আবিষ্কার করা যন্ত্রপাতি সেযুগে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল।
কিন্তু ইতিহাসের পাতায় হুডিনির ঝলমলে উপস্থিতি আসলে জাদুকর হিসেবেই। যে কোনও প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে তিনি যেভাবে নিজেকে মুক্ত করে নিতেন তা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করে উঠতে পারতেন না প্রত্যক্ষদর্শীরা। চঞ্চল লাহিড়ীকে মনে পড়ে? ‘ম্যানড্রেক’ হিসেবেই বাঙালি ওই জাদুকর ছিলেন পরিচিত। কিন্তু গঙ্গায় ‘ডেথ ডাইভ’ ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে তলিয়ে যান। বছর চারেক আগের সেই মর্মান্তিক ঘটনায় অনেকেরই মনে পড়েছিল হুডিনির কথা। এই জাদু যে মৃত্যুর কতটা গা-ঘেঁষা, কীরকম ঝুঁকিপূর্ণ তা নতুন করে বুঝতে পারা গিয়েছিল। অথচ এহেন জাদুকরের জীবনের শেষটা হয়েছিল অতি করুণ ভাবে। আর সেখানেও রয়েছে ম্যাজিকই! এবার সেই কাহিনি।
[আরও পড়ুন: ‘সাভারকার নই, আমি গান্ধী, ক্ষমা চাইব না’, বিতর্ক আরও উসকে হুঙ্কার রাহুলের]
কানাডার মন্ট্রেলে প্রিন্সেস থিয়েটারে সেদিন শো ছিল হুডিনির। শো শুরুর আগে ড্রেসিংরুমে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সারছেন হুডিনি। সেই সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করেন জোসেলিন গর্ডন হোয়াইটহেড। জানতে চান, হুডিনির পেটে যত জোরেই ঘুষি মারা হোক তাঁর কিস্যু হবে না- এটা কি মিথ নাকি সত্য়ি? ঘটনা হল, হুডিনির শোয়ের এটা একটা জনপ্রিয় খেলা। বিরাশি সিক্কার ঘুষি বেমালুম হজম করে ফেলতেন হুডিনি। আচমকা হোয়াইটহেডের এমন প্রশ্নে তিনি জানিয়ে দেন, এটা কোনও মিথ নয়, সত্য়ি। এরপরই ওই ড্রেসিংরুমেই তাঁর পেটে একের পর এক ঘুষি মারতে থাকেন হোয়াইটহেড। জাদুকররা মঞ্চে যেটা করেন, সেটা আসলে অভিনয়। একথা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। হুডিনিও বিশেষ শারীরিক কৌশলে ঘুষিগুলিকে হজম করতেন। কিন্তু ড্রেসিংরুমে প্রস্তুতিহীন অবস্থায় সেদিন ওই ঘুষিগুলিকে সামলাতে পারেননি বিশ্বশ্রেষ্ঠ জাদুকর। চারটি ঘুষির পর যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে পঞ্চম ঘুষি মারতে উদ্যত হোয়াইটহেডকে তিনি হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেন। কার্যতই লুটিয়ে পড়েন মেঝেতে। জানিয়ে দেন, তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। পাশাপাশি ভাবতেও পারেননি হোয়াইটহেড এত জোরে ঘুষি মারবেন।
কথায় আছে শো মাস্ট গো অন। পেটের যন্ত্রণা নিয়েই সেদিন শো করেন হুডিনি। রাতে ঘুম এল না। পরের দু’দিনও একই অবস্থা। ডাক্তার দেখালেন। গায়ে তখন ধুম জ্বর। দেখা গেল অ্যাপেন্ডিসাইটিস বাঁধিয়ে বসেছেন তিনি। ডাক্তার দ্রুত অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেন। কিন্তু হাতে তখন পরপর শো। হুডিনি এড়িয়ে গেলেন অস্ত্রোপচার। পরে অবশ্য রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ২৪ অক্টোবর শেষ শো করেছিলেন হুডিনি। মঞ্চেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে এক সপ্তাহ পরে তাঁর মৃত্যু হয়।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, পরপর ঘুষির ফলে তৈরি হওয়া ট্রমা ও অ্যাপেন্ডিসাইটিসের মধ্যে সম্পর্ক খুবই অনিশ্চিত। ফলে হলফ করে কি বলা যায় ওই ঘুষিই তাঁর মৃত্যুর কারণ? কিন্তু হুডিনির উপরে হোয়াইটহেডের ঘুষি-আক্রমণের দুই সাক্ষী প্রাইস ও স্মিলোভিৎজকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বিমা কোম্পানি মেনে নেয় হুডিনির মৃত্যুর পিছনে আসল কালপ্রিট ড্রেসিংরুমের ঘটনাটাই। মাত্র ৫২ বছরেই শেষ হয়ে যায় এক কিংবদন্তির জীবন। বেঁচে থাকলে আরও নতুন নতুন কীর্তি গড়তেন নিঃসন্দেহে। কিন্তু যা রেখে গিয়েছেন তাও কম নয়। ২৪ মার্চ, শুক্রবার ছিল হুডিনির জন্মদিন। সার্ধশতবর্ষে পা দিচ্ছেন তিনি। তাঁর জাদু-কীর্তির সঙ্গে সঙ্গেই দুর্ভাগ্যজনক অকালপ্রয়াণও যে বারবার ফিরে আসবে আলোচনায়, তা নিশ্চিত। যে ম্যাজিক তাঁকে সব কিছু দিয়েছিল, পরোক্ষে সেটাই হয়ে উঠেছিল মৃত্যুর পটভূমি- একে মর্মান্তিক ছাড়া আর কীই বা বলা যায়!