যুদ্ধক্ষেত্রে অদম্য সাংবাদিক৷ ‘আ প্রাইভেট ওয়ার’ দেখে লিখছেন প্রতিম ডি গুপ্ত৷
অভিনেতার কেরিয়ারে সব সময় এমন একটা ফিল্ম আসে, যা তাকে এক ধাক্কায় একেবারে অন্য উচ্চতায় নিয়ে ফেলে। গোটা বিশ্বের সামনে তার প্রতিভা মেলে ধরে। সম্মান আর শ্রদ্ধার চিরস্থায়ী বেদিতে তাকে প্রতিষ্ঠা করে। রজামন্ড পাইকের কেরিয়ারে সেই ফিল্ম ‘আ প্রাইভেট ওয়ার’। নাকি পাইকের পারফরম্যান্সই ফিল্মটাকে তার পরিণত রূপ দিয়েছে? ‘আ প্রাইভেট ওয়ার’-কে করে তুলেছে এক সাংবাদিকের মর্মস্পর্শী, মানবিক গল্প। এমন এক সাংবাদিক, যাঁর কাছে মানবিকতা রক্ষা আগে, ভয় পরে।
[‘মানুষটার রুচির সঙ্গে কথাগুলো মেলাতে পারছি না’, অরিন্দম প্রসঙ্গে বিস্ফোরক জয়া]
রজামন্ড পাইকের টু্যর দে ফোর্স পারফরম্যান্স নিশ্চিতভাবে আসন্ন অ্যাওয়ার্ড মরশুমে সাড়া ফেলবে। এখানে তিনি মারি কলভিন-এর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ১৯৮৫-উত্তর বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক যুদ্ধ কভার করেছিলেন ‘দ্য সানডে টাইমস’-এর ওয়ার করেসপন্ডেন্ট মারি কলভিন। প্রথম সাংবাদিক হিসেবে লিবিয়ার জননেতা মুয়াম্মার গদ্দাফির ইন্টারভিউ নিয়ে শিরোনামে আসেন তিনি। তার পর মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে চেচনিয়া, শ্রীলঙ্কা আর পূর্ব টিমর-এর মতো জায়গায় যুদ্ধ কভার করেন।শ্রীলঙ্কায় অ্যাসাইনমেন্টে বাঁ চোখের দৃষ্টি হারান কলভিন। ‘জার্নালিস্ট! জার্নালিস্ট!’ বলে নিজের পরিচয় দেওয়ার সাহসী চেষ্টার পরেও যখন তাঁর দিকে গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়। দৃষ্টিহীন চোখ কালো পাইরেট প্যাচ দিয়ে ঢেকে আবার নিজের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন কলভিন। যেন কিছুই হয়নি!
এভাবেই যুদ্ধের পর যুদ্ধের সাক্ষী থেকেছেন কলভিন। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে কথা বলেছেন অসহায় আক্রান্তদের সঙ্গে। কখনও মাটি খুঁড়ে বের করেছেন লাশ। কখনও হাসপাতালে ছুটে গিয়েছেন সাক্ষাৎকারের খোঁজে। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির বিচার বিশ্বের সামনে তুলে ধরা। বিশেষ করে সে সব আক্রান্তের কথা বলা, যুদ্ধের সঙ্গে যাদের কোনও লেনদেন নেই, তবু তারা দগ্ধ। “সরকারের কাছে যুদ্ধ খুব ভয়ংকর নয়, কারণ তারা সাধারণ মানুষের মতো আহত হয় না, প্রাণ হারায় না।”
[‘সেফ খেলিনি’, ‘অব্যক্ত’ নিয়ে অকপট পরিচালক অর্জুন]
স্বাভাবিকভাবে এই জীবন কলভিনের শরীর-মনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। প্রত্যেক রাতে দুঃস্বপ্নের ঝড় সামলাতে হত তাঁকে। দুঃস্বপ্নের বিষয়বস্তু-সেইসব বীভৎস দৃশ্য যা তিনি চাক্ষুষ করে চলেছেন, “যাতে আপনাদের আর সে দৃশ্য না দেখতে হয়।” শুধু চোখ নয়, অক্ষত থাকেনি তাঁর শরীরও। কিন্তু মানুষের গল্প বলার নেশায় ব্যক্তিগত সব বাধা পেরিয়ে গিয়েছেন কলভিন। ২০১২ সালে সিরিয়ায় তিনি ছিলেন একমাত্র পশ্চিমি সাংবাদিক। হোমস অবরোধে জঙ্গি-নিধনের নামে যে হাজার হাজার মানুষ অবরুদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান, সেই রিপোর্ট লিখেছিলেন কলভিন। আর তার পরেই ঘনিয়ে আসে তাঁর অমোঘ নিয়তি।
[অভিনয় থেকে মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি, সবেতেই এখনও তিনি বাদশা]
আরাশ আমেল লিখিত এবং ম্যাথিউ হেইনেম্যান পরিচালিত ‘আ প্রাইভেট ওয়ার’ এক মুহূর্তের জন্যও সন্তের স্তূতি বলে মনে হয় না। কলভিনের দোষত্রুটি, ব্যক্তিগত জীবনের চাহিদা মেটানোর অক্ষমতা-দর্শকের সামনে বারবার প্রকট হয়ে ওঠে। কিন্তু খুব ন্যায্যভাবে সব কিছু ছাপিয়ে প্রতিফলিত হয় এক সাংবাদিকের অদম্য খিদে। যুদ্ধক্ষেত্র যাদের হাহাকার অবরুদ্ধ করে রাখে, তাদের পক্ষে সরব হওয়ার দায়িত্ব। এসবের কেন্দ্রবিন্দু অবশ্যই পাইকের অভিনয়। ‘গন গার্ল’-এ তিনি দারুণ ছিলেন। কিন্তু এই অভিনেত্রী (ভারতীয় দর্শক যাঁকে প্রথম দেখে ‘ডাই অ্যানাদার ডে’—তে বন্ড গার্ল হিসেবে) শুধুমাত্র কলভিনের মস্তিষ্কের ভিতরেই ঢোকেননি। কিংবদন্তি সাংবাদিকের সর্বশরীরে প্রবেশ করেছেন। গলার আওয়াজ থেকে হাঁটাচলা-কলভিনের চরিত্রে অভিনয় করেননি পাইক, কলভিন হিসেবে বেঁচেছেন। জেমি ডর্নান, টম হল্যান্ডার, স্ট্যানলি টুচি-রা পার্শ্বচরিত্রে অসাধারণ। সিনেমাটোগ্রাফার রবার্ট রিচার্ডসনের (যিনি আর এক অসাধারণ ওয়ার জার্নালিস্ট ফিল্ম, অলিভার স্টোনের ‘সালভাডর’-এ কাজ করেছিলেন ১৯৮৬ সালে) দুর্দান্ত কাজ ফিল্মটাকে দর্শকের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশিয়ে দেয়। ভেঙে পড়া বিল্ডিং, গোলাগুলি নিয়ে তেড়ে আসা সৈনিক, হঠাৎ করে জঙ্গিদের বোমাবর্ষণ-মনে হয় মাল্টিপ্লেক্সের সিটের আরাম থেকে সোজা ছিটকে পড়েছেন শ্রীলঙ্কা বা সিরিয়ার যুদ্ধ-মাঝে। এই অ্যাসাইনমেন্টের সৌজন্যে থিয়েটারে ‘আ প্রাইভেট ওয়ার’ দেখার সৌভাগ্য হল। আজ যদি আপনি এই লেখাটা পড়েন, এই লাইন পর্যন্ত পড়ে থাকেন, তা হলে নিজের একটা উপকার করুন। কাছাকাছি কোনও হলে গিয়ে ‘আ প্রাইভেট ওয়ার’ দেখে আসুন। পাইকের কলভিন বাকি কাজটা করে দেবে।
The post অদম্য সাংবাদিকের গল্প ফুটে উঠল ‘আ প্রাইভেট ওয়ার’-এর পর্দায় appeared first on Sangbad Pratidin.