বিশ্বদীপ দে: শুরুতেই উল্লেখ করা যেতে পারে বাংলা ব্যান্ড ‘চন্দ্রবিন্দু’র একটা গানের লাইন। ‘কিছু কিছু বস্তু আছে শুরুতেই শেষ’। দাবদাহে পুড়তে থাকা এক শুক্রবারে ‘আদিপুরুষ’ (Adipurush) দেখে বেরনোর পর আচমকাই এই গানটার কথা মনে পড়ে গেল। যদিও একেবারে শুরুতে ক্রেডিটের সময় মন্দ লাগছিল না। এমনকী রাবণের ফার্স্ট এন্ট্রিও। তবে তপস্যারত লঙ্কেশকে যিনি বর দিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা হিসেবে তাঁকে চিনে ওঠা কঠিন। কিন্তু ‘রামায়ণ’ মানে তো আসলে রাম। তিনিই শেষ কথা। মহাকাব্যের সেই অপ্রতিরোধ্য নায়কের দেখা যখন মিলল জলের তলায় ধ্যানরত অবস্থায়, সেই দৃশ্যের ভিএফএক্সই বুঝিয়ে দিয়েছিল ওম রাউত কী ‘খেল’ দেখাতে চলেছেন পরবর্তী ঘণ্টা তিনেক সময়ে। এরপরও দর্শক হিসেবে হলের ভিতরে বসে থাকার শেষে চন্দ্রবিন্দুর গান মনে পড়াই স্বাভাবিক। শুরুতেই তো বোঝা গিয়েছিল শেষটা কী হবে।
এই ছবিকে এককথায় প্রকাশ করতে গেলে লালমোহনবাবুর ভাষায় বলাই যায় ‘হরেন্ডাস ব্যাপার মশাই!’ যাঁরা গত শতকের আটের দশকে রামানন্দ সাগরের ‘রামায়ণ’ দেখেছেন, তাঁরা জানেন প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কী অপূর্ব ভাবেই বাল্মীকির মহাকাব্যকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল স্রেফ নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রমের সাহায্যে। বছর তিনেক আগে লকডাউনের সময়ও নতুন প্রজন্ম দূরদর্শনে ভিড় করে দেখেছিল সেই সিরিয়াল। অথচ এমন ব্যাপক বাজেট নিয়ে এটা কী বানালেন পরিচালক ওম রাউত? কেবল দুর্বল ভিএফএক্স নয়, গল্পটাই বাঁধতে পারেননি তিনি। প্রভাসরাও কেউ চরিত্র হয়ে উঠতে পারেননি। এই ছবি ঘিরে শুরু থেকেই নানা বিতর্ক। কিন্তু সব বিতর্ককে পেরিয়ে শেষমেশ সবকিছুকে যেন ঢেকে দেয় ছবির দুর্বল মেকিং।
[আরও পড়ুন: ‘মার খেয়েছে ওরা’, ৬০ BJP প্রার্থীর মনোনয়নের সময়সীমা বাড়াল হাই কোর্ট]
প্রভাসের (Prabhas) অভিনয় দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল অরুণ গোভিলের কথা। এক সাক্ষাৎকারে রামানন্দ সাগরের ‘রাম’ জানিয়েছিলেন, মেকআপ সম্পূর্ণ হওয়ার পরও তাঁর চেহারায় দেবত্বের ভাবটা ফুটে উঠছিলেন না। সেই সময় তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন তাঁর মুখের হাসিকে। একেক আবেগে একেক রকম হাসি। রাম তো বিষ্ণুর অবতার। তিনি সবই জানেন। এই মানব জনম আসলে তাঁর লীলাখেলা। তাই তাঁর মুখে হাসি। প্রভাসের মুখে এমন কোনও দৈবী ভাব ফোটানো যায়নি। তিনি এক পেশিবহুল যোদ্ধা হয়ে উঠতে পেরেছেন ঠিকই। কিন্তু সেই হয়ে ওঠাটুকুও আসলে অমরেন্দ্র বা মহেন্দ্র বাহুবলীরই রিমেক মাত্র। এর বেশি কিছু তিনি করে উঠতে পারেননি।
বরং আপ্রাণ করেছেন কৃতী (Kriti Sanon)। তাঁর এক্সপ্রেশন মোটামুটি ভালই লেগেছে। যদিও হরণের দৃশ্যে যে আতঙ্ক থাকার কথা, সেটা একেবারেই ছিল না। বাকি দৃশ্যগুলিতে তিনি উতরে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি বা প্রভাস যেটুকু পেরেছেন, তার ধারেকাছেও পৌঁছতে পারেননি বাকিরা। তাঁরা আরও খারাপ। সইফ আলি খান (Saif Ali Khan) চেষ্টা করেছেন। কিন্তু রাবণের মতো চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে পারার শক্তি তাঁকে আসলে চিত্রনাট্যই দেয়নি। তিনি নিজেও অভিব্যক্তিতে ভয় ধরাতে পারেননি। কেনই বা সামান্য ঝুঁকে হাঁটছিল রাবণ, তাও বোঝা গেল না।
[আরও পড়ুন: পঞ্চায়েতে ‘গৃহযুদ্ধ’! TMC প্রার্থী শাশুড়ি, বিজেপির প্রতীকে লড়ছেন বউমা]
এদিকে ইন্দ্রজিৎ ‘ফ্ল্যাশ’-এর মতো শোঁ শোঁ ছোটেন। কিন্তু মেঘের আড়ালে তাঁর যুদ্ধ করা, প্রবল বিক্রম সেসব কিছুই নেই। একই ভাবে নিষ্প্রভ বিভীষণও। ঠিক যেমন লক্ষ্মণ। পুতুলের মতো তাঁর নড়াচড়া। এবং বেচারা কুম্ভকর্ণ! তাঁর কিছুই করার ছিল না। ঘুম থেকে উঠে আচমকাই যুদ্ধে যাওয়া আর চট করে মরে যাওয়া ছাড়া। ‘রামায়ণ’ বা যে কোনও মহাকাব্যেই চরিত্র হল আসল সম্পদ। রাম-সীতা, রাম-লক্ষ্মণ কিংবা রাবণ-ইন্দ্রজিৎ, কোনও সম্পর্ককেই বুনে তুলতে পারেননি পরিচালক। আর সেসব না পেরে তিনি চেষ্টা করেছেন নতুন কিছু দিক ফুটিয়ে তোলার। যেমন, রাবণের দশ মাথার পরস্পরের সঙ্গে কথা বলা কিংবা এক বাদুড়সদৃশ প্রাণীর পিঠে চেপে দশাননের ঘুরে বেড়ানো। লঙ্কার পরিবেশও তিনি নিজের মতো গড়েছেন। অনেকটা ‘হ্যারি পটারে’র ডিমেন্টরদের মতো ছায়াশরীরীদের আমদানি করেছেন দণ্ডকারণ্যে! আইডিয়া হিসেবে খারাপ নয়। কিন্তু কেবল আইডিয়াই যে যথেষ্ট নয়, তার প্রয়োগটাও ঠিক ভাবে করা দরকার, সেটা কে বোঝাবে পরিচালককে। ফলে ব্যাপারগুলো দাঁড়ায়নি। বেশির ভাগ এক্সপেরিমেন্টই হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছবির একমাত্র ভাল দিক হল গান ও আবহসংগীত। গানগুলি ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে। আবহও দৃশ্যের মেজাজ বুঝে বেশ ভালভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। কিন্তু কেবল এইটুকুর উপর নির্ভর করে কোনও ছবির সাফল্য পাওয়া কঠিন। ‘আদিপুরুষ’ এরপরেও সফল হলে পরিচালক লটারির টিকিট কেটে ফেলতে পারেন। রামের নামমাহাত্ম্য এই ছবিকে দুর্দান্ত একটা ওপেনিং দিয়েছে। কিন্তু সেই প্রাথমিক উৎসাহটুকু নিভে গেলে তারপর দর্শককে এই ছবি দেখার জন্য হলমুখী করাটা বোধহয় ‘মুশকিল হি নেহি না-মুমকিন হ্যায়’।