রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় : সন্দীপ রায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। কিন্তু তাঁকে ২৬ জানুয়ারি সন্ধেবেলা মোবাইলেই ধরা গেল। ইতিমধ্যেই সপরিবার দু’বার কোভিড-আক্রান্ত হয়েও সেই একইরকম প্রাণময়, আনন্দময় এবং আন্তরিক কণ্ঠস্বর, বাক্যের সেই একই রকম সহজ অনর্গলতা, উচ্চারণে একই স্পষ্টতা। বহু বছর পরে কথা হল সন্দীপের সঙ্গে। মনে হল, এত বছর কোনও যোগাযোগ না থাকলেও এবং মাঝখানে বিছিয়ে তিন বছরের মহামারী, তবু সুতোটা যেখানে ছেড়ে গিয়েছিলাম আমরা, সেখান থেকেই সুতোটা তুলে নিতেও পারলাম। প্রথমেই বললাম, একটি মাত্র প্রশ্ন-তাড়িত এই ফোন : গুপী বাঘা কি সত্যিই মরে গেল? আর কি ফিরবে না ওরা? গুপী-বাঘাকে তো আপনিই ফিরিয়ে এনেছিলেন। আরও একবার ওদের ফিরিয়ে আনার ভাবনা মাথায় নেই?
[আরও পড়ুন: নয় দশক পরে পালটে গেল মিনি মাউসের পোশাক, প্যান্ট-স্যুটে সাজল জনপ্রিয় কার্টুন]
সন্দীপ রায়ের হাসি এবং তৎপর উত্তর– মাথার একেবারে সামনে আছে এই ভাবনা, তা বলতে পারছি না। তবে মাথার মাঝখানে যে এই ভাবনা নেই, তা-ও বলছি না কিন্তু।
শুধু এইটুকুই যথেষ্ট। মানুষের সৃজন ও সংস্কৃতির ইতিহাসে ‘মিডব্রেন’ বা মধ্য-মস্তিষ্কের অবদান ‘ফোরব্রেন’ এবং ‘হাইন্ডব্রেন’-এর থেকে কিছু কম নয়, বিশেষ করে মিডব্রেন তো আমাদের দৃষ্টি এবং বোধের অনেকটাই চালাচ্ছে! আর সেখানেই বসে আছে ‘গুপী-বাঘার’ আবার ফিরে আসার ব্যাপার! শুনে যে কী আহ্লাদ হল কী বলব! প্রশ্ন করলাম, তাহলে যত তাড়াতাড়ি পারেন ওদের ফিরিয়ে আনছেন না কেন? এই মুহূর্তে গুপী-বাঘাকে বাঙালির খুব প্রয়োজন। ওদের যাথার্থ্য বাঙালির কাছে এখন কিন্তু নিঃসন্দেহে খুব বেশি।
–এই বিষয়ে আমি একমত। কিন্তু প্রশ্ন হল, গুপী আর বাঘা করবেন কে? গুপী-বাঘা মানেই তপেন চট্টোপাধ্যায়-রবি ঘোষ। ওঁরাই রূপকথাটার অঙ্গ হয়ে গিয়েছেন। ওই রূপকথাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। রূপকথাটা মরে গেলে চলবে না কিন্তু।
সন্দীপ যা বললেন, তার মূল্য অনস্বীকার্য। উনি যে কাউকে ভাবেননি, তা তো নয়। কিন্তু যাঁর কথাই উনি ভাবুন না কেন, একটি সন্দেহ থেকে রেহাই পাননি সন্দীপ। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে যে-রূপকাহিনি তৈরি করে গিয়েছেন তপেন চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, তার মান মেজাজ মাধুর্য ক্ষুণ্ণ হবে না তো?
সন্দীপ সামান্য ভেবে বলেন, তপেন চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষের জায়গা কেউ নিতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু একটা ব্যাপার, উপেন্দ্রকিশোর রায়ের কপিরাইট তো চলে গিয়েছে।
–হ্যাঁ, তা তো গিয়েছেই।
–তাহলে, গুপী গাইন বাঘা বাইনের কথা ভুলে গিয়ে ওদের ছেলেপিলেদের কথা তো ভাবা যেতেই পারে। ধরুন, ওদের ছেলেপিলেরা ভূতের রাজার বর পেল! তাহলে কেমন হয়?
আমি সত্যি চমকে উঠি। এ তো দারুণ আইডিয়া। সন্দীপকে বলি, করবেন গুপী-বাঘার সন্তানদের নিয়ে মিউজিক্যাল? এই যুগের নতুন রূপকথা? আমার তো মনে হয়, গুপী-বাঘাকে একবার তো ফিরিয়ে এনেছেন আপনি। আবার তাদের ফিরিয়ে আনার থেকে তাদের বংশধরদের নিয়ে ছবি আরও ইন্টারস্টিং হবে। তারা তো একেবারে এ-যুগের। তবু তারা তো রূপকথারই চরিত্র। তাই তো?
–তা তো বটেই, বলেন সন্দীপ।
–আমি বলি, কিন্তু তারা তো দুই রাজার সন্তান। রাজকন্যা কম পড়বে না তো?
সন্দীপ রায়ের প্রাণখোলা হাসি।
–আমি বলি, তারা তো ধনীর সন্তান। তাদের যদি ভূতের বরের প্রয়োজন, সেটা হবে একেবারে অন্য ধরনের বরপ্রাপ্তি, তাই তো?
–ধনী হলেও মানুষের ইচ্ছাপূরণের তো শেষ নেই। কতদিকে তার সম্ভাবনা ছড়াতে পারে। ধনীরও কি সব ইচ্ছে পূর্ণ হয়? সব সাধ মেটে?
–এবং সেই ইচ্ছাগুলো এ-যুগের ইচ্ছা। এখানে একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শনের কথা তো থাকছেই।
–অনেক কিছুই থাকবে। কিন্তু এ-যুগের জটিলতার মধ্যে রূপকথার সারল্যটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সেটাই হবে প্রধান আকর্ষণ।
–আর গান?
–তা তো থাকবেই। গানই প্রকাশ করবে রূপকথার মাধুর্য, সারল্য, মেজাজ। সন্দীপের কণ্ঠে আনন্দ।
–একেবারে শেষে, আমার একটা ছোট্ট অনুরোধ আছে।
–হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন।
–যদি এই রূপকথাটা হয় গুপীর ছেলে আর বাঘার মেয়েকে নিয়ে?
–তাহলে তো রাজকন্যা কম পড়ার ভয়টা আর থাকছে না, তাই তো? সন্দীপের হাসি।
–আরও একটা ব্য়াপার হল, গুপী-বাঘার ছেলে আর মেয়ে, দুজনেই ভাল গাইয়ে-বাজিয়ে হতে পারে। তাদের বাবাদের মতো ট্যালেন্টেড আর কী। ভূতের বরের জোরে নয়, তাদের রক্তের মধ্যেই গান-বাজনা আছে। তাছাড়া, এই গান-বাজনার সূত্র ধরে ওদের মধ্যে একটা মধুর বন্ধুত্ব হওয়াও স্বাভাবিক।
–রূপকথার গল্পে তো রাজকুমার আর রাজকন্যার মধ্যে প্রেম থাকেই। তবে রূপকথার প্রেম। সেখানেও ওই সরল সহজ মিষ্টি ব্যাপারটা জরুরি, বলেন সন্দীপ।
–এবং শেষে চিরসুখে দিন কাটাবার প্রতিশ্রুতি, সন্দীপের হাসি।
–তাহলে, গুপী-বাঘার ছেলেমেয়ে ফিরছে তো?
–আপাতত কল্পনাতেই ফিরুক। সন্দীপের হাসি।