বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য , শিলিগুড়ি: একে শীতে বৃষ্টির দেখা মেলেনি। তার উপর মার্চের মাঝামাঝি থেকে ঊর্ধ্বমুখী তাপমাত্রা। পরিণতিতে উত্তরের নদী ও পুকুরের জল শুকিয়ে গরম হয়ে যেন ফুটছে। শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের মধ্যে ছোট পুকুর কেটেও মাছ রক্ষা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক নদীতে জলস্তর এতোটাই কমেছে যে মাছের পাশাপাশি জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী টিকে থাকতে পারছে না। পাহাড়-সমতলের এমন পরিস্থিতি দেখে উদ্বিগ্ন মৎস্যদপ্তরের আধিকারিকরা। তাদের শঙ্কা, প্রতিকূল আবহাওয়ায় এবার উত্তরের বাজারগুলোতে নদীয়ালি ও পুকুরে চাষ করা মাছের জোগান শুধু কমবে না, কিছু প্রজাতির নদীয়ালি মাছ উধাও হতে পারে।
কয়েকদিন তাপমাত্রা ঊর্ধ্বমুখী হতে অনেক নদীতে জলস্তর এতোটাই কমেছে যে মাছের পাশাপাশি জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীটিকে থাকতে পারছে না। পুকুরে পাম্প করে ঠান্ডা জল ঢেলেও লাভ হচ্ছে না। পোনা মাছ তৈরির হ্যাচারিগুলো বন্ধের পথে। মৎস্যদপ্তরের প্রাথমিক হিসেবে ওই পরিস্থিতিতে বিপাকে পরেছে পাহাড়-সমতলের প্রায় ৫০ হাজার মৎস্য চাষি। বাজারে কমেছে নদীয়ালি মাছের যোগান। ভরসা হয়েছে ভিন রাজ্যের রুই, কাতলা, আড়, চিতল।
মৎস্য গবেষকদের শঙ্কা, কয়েকদিনের মধ্যে ভারী বর্ষণ না হলে উত্তরের পাহাড়ি নদীগুলোর বাস্তুতন্ত্র পালটে অনেক নদীয়ালি মাছ ও জলজ উদ্ভিদ হারিয়ে যেতে পারে। কালিম্পং জেলা মৎস্য অধিকর্তা পার্থসারথী দাস বলেন, “তীব্র তাপদহে সমতলের তিস্তা-সহ প্রতিটি নদীর উৎস এলাকা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে। যতটুকু জল রয়েছে তাপদাহে ফুটছে। এর ফলে নদীর মাছ তো বটেই। জলজ উদ্ভিদ, অন্য প্রাণী নষ্ট হতে বসেছে। এটা খুবই উদ্বেগের। এর ফলে নদীগুলোর বাস্তুতন্ত্রের সমস্যা বাড়বে। প্রচুর মৎস্যজীবী বিপাকে পড়বেন।” তিনি জানান, উত্তরে শীতে মাঝারি বৃষ্টি হয়ে থাকে। এবার সেটা নেই। মার্চে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে ঘোরাফেরা করেছে। এপ্রিলের শুরুতে খারাপ ইঙ্গিত মিলছে। এই সময় এতো বেশি তাপমাত্রা কল্পনা করতে পারি না। খুবই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। প্রতিদিন খবর আসছে গরমে জল শুকিয়ে সেখানকার পুকুর ও নদীর মাছ ভাসছে। মৎস্যজীবীদের দ্রুত পুকুরের মাছ তুলে বাজারে পাঠাতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কারণ, যেভাবে ক্রমশ তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে মাছ রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
উত্তরের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার জেলা এবং দার্জিলিং জেলায় বেশি পাহাড়ি নদী ও ঝোরা রয়েছে। পাশাপাশি এখানেই বেশি পুকুরে মাছ চাষ হয়। মৎস্যজীবীদের সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যে তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, মহানন্দা সহ প্রতিটি বড় নদীর জলস্তর উদ্বেগজনকভাবে কমেছে। বারোহাতি, ধরলা, জরদা, কুমলাই, করলা, সাহুর মতো ছোট-মাঝারি নদীগুলো শুকিয়ে নালার চেহারা নিয়েছে। জল শুকিয়ে কাদা গরম হয়ে জিওল মাছও মরছে। মৎস্যজীবীরা জানান, ওই কারণে বাজারে নদীয়ালি মাছের জোগান কমেছে। পুকুরের পরিস্থিতি আরও খারাপ। সেখানে পাম্প মেশিনে ঠান্ডা জল ঢেলে মাছ রক্ষার চেষ্টা করেও খুব একটা লাভ হচ্ছে না। অনেকে শুকিয়ে যাওয়া পুকুর নতুন করে কেটে মাছ রক্ষার চেষ্টা করলেও লাভ হচ্ছে না।
শিলিগুড়ির চটহাটের মৎস্য চাষি সুশীল দাস জানান, মাছচাষের জন্য পুকুরে ৮ ফুট থেকে ১০ ফুট গভীর জল থাকা দরকার। কিন্তু এখন অধিকাংশ পুকুরে দু’আড়াই ফুট গভীর জলেই মাছেদের বেঁচে থাকতে হচ্ছে। ওই জল সহজে গরম হচ্ছে। পুকুরে ঠান্ডা জল ঢেলে দেওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যে পরিস্থিতি একই দাড়াচ্ছে। রুই, কাতলা, মৃগেলের চারাপোনা থাকতে পারছে না। লাফালাফি করছে। ওই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মাছের ডিম ফুটিয়ে চারা তৈরির হ্যাচারিগুলো। মৎস্যদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি জেলা এবং শিলিগুড়ি মহকুমায় শতাধিক মাছের পোনা তৈরির হ্যাচারি রয়েছে। জল গরম হতে শুরু করায় সেখানে চাষিরা কাজ করতে পারছে না।