হাসিনা ভয় পাননি। তিনি প্রমাণ করেছেন তাঁর শক্তি। এবারও ঘটনার পর তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাতে প্রমাণিত কবজির জোর। মৌলবাদীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি হিন্দুদের বলেছেন, ‘আমি আপনাদের আবারও অনুরোধ করব, আপনারা কখনওই নিজেদের সংখ্যালঘু ভাববেন না। সংখ্যালঘু নয়, আপনাদের আপনজন বলেই মানি। আপনারা দেশের নাগরিক।’ লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক
বাংলাদেশের মাটিতে কোনও হিন্দু ছেলে বজরংবলির কাছে কোরান রেখে গিয়েছিলেন- এমন আষাঢ়ে গল্প বিশ্বাসযোগ্য নয়। পরিকল্পিতভাবে দাঙ্গা ছড়াতে সে-দেশের মৌলবাদীরা এই কাণ্ড ঘটিয়েছিল, তা বুঝতে বোদ্ধা হওয়ার দরকার নেই। এটা পাকা মাথার প্ল্যান। যার খবর হয়তো বাংলাদেশের গোয়েন্দারাও জানতেন না।
সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর কৌশল বদলে গিয়েছে। রাতের অন্ধকারে মন্দিরের দরজায় গরুর মাংস ফেলে দাও। হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির মুখে লাথি মারার ছবি সাজিয়ে-গুছিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে দাও। বীর হনুমানের হাতে রাখো কোরান। অথবা মসজিদের সামনে এমন কিছু করো, যাতে সেই সম্প্রদায়ের মানুষ খেপে ওঠে।
এই কৌশল ওপারের মৌলবাদীরা যেমন রপ্ত করেছে, তেমন এপারেও সক্রিয় কিছু শক্তি। এদের অস্ত্র ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ। যার মাধ্যমে মুহূর্তে বিষ ছড়িয়ে দেওয়া যায়। যাতে ঘটনার অভিঘাত হয় সুদূরপ্রসারী। আজকাল প্রযুক্তির খেলায় তিলকে তাল করা খুব সোজা। রোষের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় ফেক ভিডিও, মিথ্যা ছবি। সবটা বোঝার আগেই আগুনে পুড়ে মরে সমাজ।
[আরও পড়ুন: পশ্চিমবঙ্গের জন্য কেন মঙ্গলজনক দুর্গোৎসবের অর্থনীতি?]
“একই বৃন্তে দু’টি কুসুম”- বলেছিলেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন রহমত আর মিনির উপাখ্যান। কিন্তু হিন্দুর সঙ্গে মুসলমানের ভালবাসা সোনার পাথরবাটি রয়ে গেল। প্রায় আটশো বছর ধরে এই সংঘাত চলছেই। গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে বাস করেও দুই ধর্মে বনিবনা হল না। ভারত ভেঙে তৈরি হয়ে গেল তিন-তিনটে দেশ। বিভেদের সমাধান হল না।
উপমহাদেশে দেশভাগ এক মর্মান্তিক যন্ত্রণার নাম। কাঁটাতারের বেড়ার ভবিতব্য মেনে উদ্বাস্তু হয়েছিলেন কোটি কোটি মানুষ। ভিটেমাটি হারিয়ে শুরু হয়েছিল সহায়-সম্বলহীন আধপেটাদের বাঁচার মিছিল। লক্ষ লক্ষ একর জমি, সম্পত্তি, অর্থ, ঐশ্বর্য বেহাত, লুঠ। রাজা মুহূর্তে ফকির। শত শত লাশের স্তূপ দেখেও ধর্মান্ধদের চোখে জল আসেনি। ভিটে হারানো, সংসার হারানো, আশ্রয় হারানোর কষ্ট সবাই বোঝে না। যাদের জীবনে সেই কালো রাতের অভিশাপ নেমে আসে, তারাই জানে, দাঙ্গার ক্ষত কতটা ভয়াবহ।
যুগে যুগে দাঙ্গার কার্যকারণ বদলেছে। আগে ধর্মের নামে, ধর্মান্তরকরণের নামে দাঙ্গা হত। একটা সময় এল, যখন সম্পত্তির দখল নেওয়ার জন্য দাঙ্গা হতে শুরু করল। এখন দাঙ্গা হয় রাজনীতির জন্য। আরও সোজা ভাষায় বললে, সমাজকে হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করে ক্ষমতার কুর্সি দখলের জন্য। ভারতে হয়, পাকিস্তানে হয়, বাংলাদেশে হয়।
ভোটের জন্য বিভাজন আরও বেশি হয়। এই যে বাংলাদেশ নিয়ে এত উগ্র মিছিল হচ্ছে এপার বাংলায়, কেন হচ্ছে? সব কি প্রকৃত প্রতিবাদের মিছিল? ওপারের হিন্দুদের সুরক্ষার জন্য মিছিল? একদম না। এক শ্রেণির উদ্দেশ্য, ওদিকের অশান্তিকে কাজে লাগিয়ে এপারে ভোটের মেরুকরণ। তাতে দাঙ্গা বাধে বাধুক। কিছু মানুষ এই নোংরা খেলায় ধর্মোন্মাদ হয়ে ওঠে। দাঙ্গার আগুনে ঝাঁপ মারে। একবারও ভাবে না, পরধর্মের উপর আক্রমণ পেটের ভাত দেয় না। বেকারত্বের জ্বালা দূর করে না। সমাজে শান্তি বজায় রাখতে পারে না।
বাংলাদেশের ঘটনা ছোট করে দেখার উপায় নেই। এর চেয়ে অনেক বড় বড় আক্রমণ সংখ্যালঘুদের উপর সে-দেশে হয়েছে। কিন্তু এবার প্রেক্ষিত ভিন্ন। যে-কায়দায় বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব বেছে নেওয়া হল, তা থেকে স্পষ্ট দুরাত্মার ছল। শারদোৎসবের মাহেন্দ্রক্ষণ অষ্টমীতে দুর্গামূর্তির উপর আক্রমণ। প্যান্ডেল-মন্দিরে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ। কোরান অবমাননার যে খবর রটিয়ে এই আক্রমণ, তা আদৌ সত্যি কি না, সত্যি হলে সেই কাজ কারা করল, সেসব বিবেচনা না করে একতরফা আঘাত হিন্দুদের উপর। মা দুর্গার উপর আক্রমণের প্রভাব যে অনেক বেশি হবে, তা ষড়যন্ত্রকারীরা জানত। ইসকন মন্দিরে হামলাও সুপরিকল্পিত। তাঁদের বিশ্বজুড়ে ব্যাপ্তি।
প্রশ্ন হচ্ছে, কী করছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দারা? দেশজুড়ে দাঙ্গার ছক কষা হচ্ছে, তাঁরা জানতে পারলেন না! তাঁরা কি ঘুমচ্ছিলেন? না কি সরষের মধ্যে ভূতের বাস? ভারত-বিদ্বেষী শক্তির প্রভাব? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করতেই যে শারদোৎসবে হামলা, তা বুঝতে কারও বাকি নেই। তিনি ক্ষমতায় থাকুন, তা সে-দেশের তালিবানপন্থীরা চায় না। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলি ভোটের ভয়ে চুপ করে থাকে। প্রতিবাদী একমাত্র ‘বঙ্গবন্ধু’-র কন্যাই।
সাম্প্রতিক সময়ে আমি বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে গিয়েছি। হাসিনার জমানায় উন্নতি চোখে পড়ার মতো। জিডিপি হারে ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়া ইউরোপ-আমেরিকার কাছে ঢাকার গুরুত্ব অনেক বাড়িয়েছে। গারমেন্ট শিল্পে বিপুল বিনিয়োগ গ্রামাঞ্চলে বেকারত্ব কমিয়েছে। ঢাকায় চলছে মেট্রো রেল, পদ্মার উপর বৃহত্তম রেল-সড়ক সেতু শেষের পথে। সব মিলিয়ে উন্নয়নের মুখ হয়ে উঠেছেন হাসিনা। তাঁকে ভোটে হারানো যখন সম্ভব নয়, তখন ধর্মের আফিম খাওয়াতে মৌলবাদীরা সক্রিয় হবে, সেটা স্বাভাবিক।
মুজিবুর রহমান ছিলেন আপাদমস্তক এক অসাম্প্রদায়িক চরিত্র। পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পর তাঁর হাত ধরে ভারতের মতো স্বাধীন, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের পর বহু হিন্দু ভিটে ত্যাগ করেননি তাঁর ভরসাতেই।
এর মূল্য দিতে হয় মুজিবকে। মৌলবাদীদের ষড়যন্ত্রে জাতির পিতা সপরিবার নিহত হন। ধানমন্ডির বাড়ির সিঁড়িতে আজও রক্তের দাগ। তাঁর আত্মা কাঁদে। ৪৫ বছর পরও সব অমলিন। বিলেতে থাকায় বেঁচে যান শেখ হাসিনা। মুজিব-হত্যার পর বাংলাদেশ ধর্মীয় খোলসে ঢুকে পড়ে। প্রথমে সামরিক শাসন। ক্রমে ক্রমে ইসলামিক কান্ট্রি। পরপর পালাবদল। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামি লিগ অবশেষে বাংলাদেশে ক্ষমতা দখল করে হাসিনার নেতৃত্বে। ধর্মীয় মোড়ক থাকলেও গণতন্ত্র ফেরে। মানুষ স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার পায়। হাসিনার জমানায় সবচেয়ে নিরাপদ বোধ করেন দেশের আট শতাংশ হিন্দু। বাংলাদেশে গিয়ে দেখেছি, হিন্দুরা যাতে নির্বিঘ্নে দুর্গাপুজো করতে পারেন, তার জন্য সরকারই তাদের প্রোমোট করছে। আর্থিক অনুদান দিচ্ছে। ঢাকা শহরে প্রচুর পুজো হয়। নির্ভয়ে এতদিন শারদোৎসব করেছেন হিন্দুরা।
স্বাভাবিকভাবেই গভীর ষড়যন্ত্র। পুজোই টার্গেট হল। জামাত-সহ মৌলবাদীরা মনে করে, আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশকেও শরিয়তের ফতোয়ায় বেঁধে ফেলার পথে বাধা হাসিনাই। স্বভাবতই বারবার তাঁকে হত্যার চেষ্টা হয়।
হাসিনা ভয় পাননি। তিনি প্রমাণ করেছেন তাঁর শক্তি। এবারও ঘটনার পর তিনি যে পদক্ষেপ নিয়েছেন, তাতে প্রমাণিত কবজির জোর। মৌলবাদীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি হিন্দুদের বলেছেন, ‘আমি আপনাদের আবারও অনুরোধ করব, আপনারা কখনওই নিজেদের সংখ্যালঘু ভাববেন না। সংখ্যালঘু নয়, আপনাদের আপনজন বলেই মানি। আপনারা দেশের নাগরিক। সম-অধিকারে আপনারা দেশে বসবাস করেন। সম-অধিকার নিয়ে আপনারা আপনাদের ধর্ম পালন করবেন, উৎসব করবেন, এটাই আমি চাই।’
তাঁর নির্দেশে পুলিশ হিংসায় যুক্ত পাঁচশো জনকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যেখানে হামলা হবে, সেখানেই হামলাকারীদের খুঁজে বের করতে বলা হয়েছে। তাদের এমন শাস্তি দেওয়া হবে, ভবিষ্যতে যাতে এমন কাণ্ড তারা ঘটাতে না পারে!’
এই হলেন প্রকৃত প্রশাসক। বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো বলা সোজা নয়। হাসিনা ‘আমরা-ওরা’ করেননি। মাত্র আট শতাংশ নাগরিকের পক্ষ না নিয়ে ৯২ শতাংশ সংখ্যাগুরুর দিকে ঢলতে পারতেন। কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধু-কন্যা। কলজের জোরটা লৌহকঠিন। তাই দাঁড়ালেন দুর্বলের পক্ষে। দেখালেন, পিতার পথেই চলেছেন।
বাংলাদেশে মুসলমানরা ভাল থাকুন। কিন্তু হিন্দুদেরও নিরাপত্তা চাই। সেটা দিতে পারেন হাসিনা-ই। তাই তিনি যতদিন আছেন, ততদিন বাংলাদেশও ভাল থাকবে। তাঁর অ-বর্তমানটা ধু-ধু মরুভূমির মতো সুদূর। সেদিন ওপার শুধু নয়, উদ্বেগে ডুববে এপারও।