shono
Advertisement

প্রথম শীতের দিশাহারা বাদল ধারা

শীতের অকাল বর্ষণ মনে করিয়ে দেয় অনেক স্মৃতি।
Posted: 03:27 PM Dec 07, 2021Updated: 03:27 PM Dec 07, 2021

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ‌্যায়: প্রথম শীতের এই বৃষ্টি হঠাৎ আসেনি কিন্তু। এসেছে এক হারিয়ে-যাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের বার্তাবাহী হয়ে। কেউ এই ঝড়ের নাম দিয়েছেন ‘জাওয়াদ’। কেউ ডেকেছেন ‘উদার’ নামে। এখন এই ঝড় রূপান্তরিত প্রথম শীতের বাদলধারায়! কাল সারারাত নাছোড় বৃষ্টি হয়েছে। সারাবেলা বাদল ছাড়ার নাম নেই। বেশ লাগছে আমার প্রথম শীতের এই অকাল-বর্ষা। একশো বছর আগে, শীত-সবে-পড়ছে এক রাত্তিরবেলা, রাতভর বৃষ্টিতে জেগে আছেন অবন ঠাকুর! আর একা ঘরে, হয়তো বা পিদিমের আলোয়, লিখে ফেলছেন ‘কুঁকড়ো’ নামের এক ভারি রোম্যান্টিক কবিতা, কোনও এক ‘সোনালিয়া’-র উদ্দেশে। কোথায় কোন চুলোয় গিয়েছে অবন ঠাকুরের সেই চিলতে কবিতার বই, এখন আর ঠাওর নেই। শুধু মনে আসছে খাপছাড়া কয়েকটি লাইন ‘সোনালিয়া, প্রায় সবই তো শুনলে, আরও যদি চাও তো বলি, অন্ধকারের মধ্যে থেকে ভোররাতের হিম মাটি এই যে কাঁদন জানাচ্ছে আকাশের কাছে তার অর্থ কী, সোনালিয়া।’ কাল সারারাত হিম রাতে বৃষ্টির শব্দ শুনতে-শুনতে আমার মনে হয়েছে অন্তত একশো বছরের পুরনো মেয়ে ওই সোনালিয়া-কে। প্রথম শীতের অকালবর্ষণ না এলে, হিম মাটির রাতভর কান্না না শুনলে, সোনালিয়াকে মনে পড়ত না, সে মেয়ে যেই হোক না কেন।

Advertisement

একটি ব‌্যক্তিগত প্রসঙ্গ না এনে পারছি না। প্রসঙ্গটি মৃত্যুর। কাল হিমরাত্রে বৃষ্টি পড়ছে। অঝোরে বৃষ্টি। একা ঘরে জেগে ভয় পেয়েছি আমি। বাইরে অনাকার অন্ধকার। শীতের রাত্রে মুষলধারে বৃষ্টি পড়লে আগে কি এমন অসহায় লাগত? হয়তো না। কাল লেগেছে। মনে হয়েছে পৃথিবীতে কেউ নেই যে আমার কোনও প্রয়োজনে এখন সাড়া দিতে পারে। শুধু শীত। আর অন্ধকার। আর বৃষ্টি। আর আমার লেপের মধ্যে আবৃত অসহায়তা। শীতের বর্ষা ছাড়া হয়তো এইভাবে ভাবতাম না। এই যে ঝাপসা আর্তি, এরও প্রয়োজন আছে জীবনে।

[আরও পড়ুন: ‘বিরোধী ঐক্য’ একতরফা হয় না]

মনে পড়ে গেল উপকূলে যাঁরা আছেন, যাঁরা মাছ ধরে, মাছ বিক্রি করে বেঁচে থাকেন, সমুদ্রের শস‌্য যাঁরা সারারাত ধরে জড়ো করেন নৌকায়, – তাঁদের তো এই অসময়ের বর্ষণের মধ্যেও বেরিয়ে পড়তে হয়েছে শুধু টিকে থাকার জন‌্য। আয়ারল‌্যান্ডের উপকূল থেকে বাংলার উপকূল – প্রবল শীত আর শীতের বৃষ্টির মধ্যে একই অনিশ্চয়তার গল্প মৎস‌্যজীবীদের সংসারে-সংসারে। শীতের বৃষ্টি আর শীতের সমুদ্র আইরিশ সাহিত্যের বিশেষ বিষয়, অন্তহীন ব‌্যাপ্তি ও ট্র্যাজেডিতে প্রসারিত। আমাদের দেশেও তাই। মাণিক বন্দ্যোপাধ‌্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ থেকে বুদ্ধদেব বসুর ‘শীতরাত্রির প্রার্থনা’– সর্বত্র ছড়িয়ে আছে শীতরাত্রে বৃষ্টি নামলে ঝাপসা মৃত্যুভয়! ‘এসো ভুলে যাও তোমার সব ভাবনা, তোমার টাকার ভাবনা, স্বাস্থ্যের ভাবনা, এরপর কী হবে, এর পর, ফেলে দাও ভবিষ‌্যতের ভয়, আর অতীতের জন‌্য মনস্তাপ।’ আরও কয়েকটি শব্দ মনে এল আমার বুদ্ধদেব বসুর কবিতা থেকেই, যখন প্রথম শীতের আকস্মিক রাত্রে আসে হঠাৎ বৃষ্টি আর দূরে কোথাও শোনা যায় অ‌্যাম্বুল্যান্সের সাইরেন, যেমন শুনলাম কাল রাত্রে বৃষ্টির শব্দ ভেদ করে – ‘আজ পৃথিবী মুছে গিয়েছে, তোমার সব অভ‌্যস্ত নির্ভর ভাঙল একে একে – রইল হিম নিঃসঙ্গতা।’

[আরও পড়ুন: সর্বভারতীয় স্তরে আরও একধাপ এগোলেন মমতা]

প্রথম শীতের এই প্রবল বর্ষণ। যার মধ্যে অনিশ্চিত, নিঃসঙ্গ, কিছুটা আর্ত আমি, শুয়ে আছি লেপের উষ্ণতায়, ভালও তো লাগছে আমার! এই অহেতুক ত্রাস, ওই অনিশ্চয়তা ও নিঃসঙ্গতা হঠাৎ পাওয়া গয়নার বাক্সের মতো। ঝলমল করছে অন্ধকারের মধ্যে। জীবনে এখনও এত মণিমুক্তো! কে জানত! রবীন্দ্রনাথেরই একটি অকালবর্ষার গান, শীতরাত্রির বর্ষার মধ্যে, ছুটে এল আমার কাছে! তার যাত্রাপথে গানটি নিজেই পালটে নিয়েছে একটিমাত্র শব্দ : ‘কোন খ‌্যাপা শ্রাবণ ছুটে এল অঘ্রানেরই আঙিনায়!’ সংস্কৃত নাম তো ‘অগ্রহায়ণ’। কেন অগ্রহায়ণ? কারণ বহু বছর আগে এই মাসই ছিল মার্গশীর্ষ। সাহেবদের মতো বাঙালিরও বছরের প্রথম মাস ছিল শীতের মাস! আর হলই বা শীত, শীতের বর্ষাই তখন ছিল বছরের প্রথম ধৌতির বর্ষণ। অনেক রাত্রে কাল, শীতের অকাল বর্ষণের মধ্যে, হঠাৎ মনে এল এই ভাবনাটিও – এই বৃষ্টি মহামারীর শেষে নতুন শুরুর পবিত্র বর্ষণ! মনপ্রাণ ভরিয়ে দিলেন চিরদিনের অনন্ত রবীন্দ্রনাথ, নিজেকে সামান‌্য বদলে নিয়ে :
আমার প্রথম শীতের বাদল ধারা
আমার স্বপনলোকে দিশাহারা॥
ওগো অন্ধকারের অন্তরধন, দাও ঢেকে মন পরান মন–
আমি চাইনে তপন, চাইনে তারা॥
আমার প্রথম শীতের বাদল ধারা॥

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement