রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: ধরা যাক, এক ক্রিকেটার প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন গোটা চারেক। আর এক ক্রিকেটার সেই প্রথম শ্রেণির ম্যাচই খেলেছেন। তবে চারটে নয়। সতেরোটা। তা, এবার দু’জনের মধ্যে কাকে প্রধান নির্বাচক করা উচিত? কী ভাবছেন, হাস্যকর প্রশ্ন? ঠিক আছে, দিন উত্তর। কী বললেন, দ্বিতীয় জন? অ্যায়, এখানেই বড় গণ্ডগোলটা করে ফেললেন। সঠিক উত্তর হল, প্রথম জন! যিনি চারটে ম্যাচ খেলেছেন। মোটেও সতেরো ম্যাচ খেলা দ্বিতীয় জন নন! কিছু করার নেই। স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধিতে দেশের ক্রিকেট চললেও, বঙ্গ ক্রিকেট (Cricket Association Of Bengal) চলে না। এবং চলে না যে, তার উদাহরণ বাংলার জুনিয়র নির্বাচক কমিটি। প্রমাণ সেখানে দিব্য জ্বলজ্বল করছে। যে নির্বাচক কমিটির প্রধান কল্যাণ ঢাল খেলেছন চারটে প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। আর তাঁর অধঃস্তন অমিতাভ চক্রবর্তী, সতেরোটা প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে নিছকই কমিটি সদস্য!
কী করে এ জিনিস হয়, কোন যুক্তিতে হয়, জানা নেই। তবে হয়। এই বাংলাতেই হয়। দেখতে গেলে বাংলার সিনিয়র নির্বাচক কমিটিতেই অমিতাভ-র চেয়ে দৃষ্টিকটু কম ম্যাচ খেলা একজন রয়েছেন। জিতেন সিং। যিনি খেলেছেন মাত্র একটা প্রথম শ্রেণির ম্যাচ। তবু সেটা ঘটতেই পারে। সিনিয়র নির্বাচক কমিটিতে জায়গা ফাঁকা না থাকলে কখনও কখনও বেশি ম্যাচ খেলা ক্রিকেটারকে জুনিয়রে থাকতে হয়। কিন্তু তিনি তো সেখানে নির্বাচক প্রধান হবেন! ম্যাচ বিচারে অমিতাভ-র যা হওয়া উচিত!
[আরও পড়ুন: ‘গ্লোবাল স্টার’ শাহরুখে মুগ্ধ ফিফা প্রেসিডেন্ট, এবার ফুটবল দুনিয়ায় পদার্পণ কিং খানের?]
ভারতীয় ক্রিকেটে (Indian Cricket) নির্বাচক প্রধান ঠিক করার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম দেখা হয় নির্বাচক কমিটি সদস্যদের মধ্যে কে ক’টা ম্যাচ খেলেছেন? যিনি ম্যাচ বেশি খেলবেন, তিনিই নির্বাচক প্রধান। বয়স একমাত্র বিচার্য হয় যদি একাধিক সদস্যের ম্যাচ সংখ্যা সমান হয়ে যায়। চেতন শর্মা (Chetan Sharma) যখন জাতীয় নির্বাচক প্রধান ছিলেন, তখন তাঁর আর জাতীয় নির্বাচক কমিটিতে থাকা শিবসুন্দর দাসের টেস্ট ম্যাচের সংখ্যা সমান ছিল। তাই বয়স বিচারে চেতনকে নির্বাচক প্রধান করা হয়। কিন্তু বেশি ম্যাচ খেলা সত্ত্বেও নির্বাচক কমিটিতে একজনকে সাধারণ ‘পেয়াদার’-র জীবন যাপন করতে হচ্ছে, আর কম ম্যাচ খেলা আর একজন হয়ে যাচ্ছেন ‘রাজা’, অর্থাৎ কিনা কমিটি প্রধান, এ জিনিস অভূতপূর্ব! আরে, ভারত-টারত ছেড়ে দিন। বাংলাতেই পূর্বে নির্বাচক কমিটিতে রনজি (Ranji Trophy) জয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (Sambaran Banerjee) থাকা সত্ত্বেও দেবাং গান্ধীকে (Debang Gandhi) নির্বাচক প্রধান করা হয়েছিল। কারণ, তিনি ভারতের হয়ে খেলেছিলেন বলে। সম্বরণ যে দেবাংয়ের চেয়ে বয়সে বড়, তা সেই সময় দেখা হয়নি। তা হলে? এখন তা হলে কল্যাণ ঢাল কোন যুক্তিতে অমিতাভ-র বদলে নির্বাচক প্রধান? বয়সের যুক্তি তো খাটে না।
ক্রিকেটে যে কোনও পর্যায়ের টিমের সাফল্য লাভের নেপথ্যে নির্বাচক কমিটির ভূমিকা বিশাল। তার ‘আইন-কানুন সর্বনেশে’ হলে চলে না। তাই অনূর্ধ্ব পর্যায়ে বাংলার চরম ব্যর্থতার নেপথ্যে এ হেন ‘বিদঘুটে’ নির্বাচক কমিটিরও দায় রয়েছে। আর কল্যাণের নির্বাচক প্রধান হওয়াও ‘মসৃণ’ ভাবে নয়। অভিযোগ, অনূর্ধ্ব উনিশ বাংলার পূর্বতন কোচ দেবাং গান্ধীর ‘স্বার্থসিদ্ধি’-তে সায় না দেওয়ায় ইস্তফা দিয়ে সরে যেতে হয়েছিল বাংলার প্রাক্তন জুনিয়র নির্বাচক কমিটির প্রধান অভীক মিত্রকে। অভীক সরে যাওয়ার পর কল্যাণকে নির্বাচক প্রধান করা হয়। বাংলার জুনিয়র নির্বাচকদের ‘সুনাম’ এমনিও বিশেষ নেই। কেউ কেউ এ দিন অভিযোগ করলেন যে, সিএবি প্রেসিডেন্ট স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের (Snehasish Ganguly) নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও এঁরা নাকি জুনিয়র পর্যায়ের টুর্নামেন্টের প্রথম রাউন্ডের খেলা-টেলা দেখতে অদ্ভুত গড়িমসি করেন! ফার্স্ট রাউন্ডের পারফরম্যান্সকে ধর্তব্যেই রাখেন না। নকআউট পর্যায়ের আগে ঘুম ভাঙে না এঁদের। জুনিয়র পর্যায় থেকে ভালো প্লেয়ার তা হলে আর উঠবে কী করে? তবে এর বিরুদ্ধ মতও রয়েছে। বলা হল, নির্বাচক হিসেবে আহামরি অর্থ পান না এঁরা। অর্থের অঙ্ক বাড়িয়ে দিলে সিএবি-র (CAB) জবাবদিহি চাওয়ার অনেক বেশি জায়গা থাকবে।
অতএব, সিএবির অবিলম্বে এ জিনিস দেখা উচিত। দরকারে তিন দুঁদে প্রাক্তন বাংলা ক্রিকেটারকে নিয়ে কমিটি গঠন করে এ হেন সার্বিক ব্যর্থতার কারণ খোঁজা যেতে পারে। শুধু তাই নয়, আরও কয়েকটা বিষয় দেখা উচিত সিএবি-র। পরপর নিচে যা তুলে দেওয়া হল:
১) ভিশন প্রোজেক্ট: নানাবিধ কারণে ভিশন ২০২৫-এর কাজ আপাতত বন্ধ। যা দ্রুত আবার শুরু করা দরকার। কারণ, ভিশন প্রোজেক্ট অতীতে বাংলাকে প্রচুর ক্রিকেটার সরবরাহ করেছে, যাঁরা পরে সিনিয়র টিমে খেলেছেন বা খেলছেন। মূলত, ভিশন বাংলার ‘সাপ্লাই লাইন’-এর কাজ করত।
২) অ্যাকাডেমি প্রকল্প: কল্যাণীতে বাংলার ক্রিকেট অ্যাকাডেমির পরিকাঠামো সম্পূর্ণ ভাবে রয়েছে। যেখানে আবাসিক শিবির করা সম্ভব। সম্ভব, তবে হয় না। অথচ অনায়াসে ব্যাটার-বোলারের ‘পুল’ তৈরি করে কল্যাণীতে গিয়ে আবাসিক শিবির করা যায়।
৩) ট্যালেন্ট হান্ট কমিটি: ময়দানে অভিযোগ, সিএবির ট্যালেন্ট হান্ট কমিটিতে থাকা তিন জনের মধ্যে দু’জন নিজেদের কাজ ঠিক ভাবে করেন না। তাঁরা নিজস্ব ক্রিকেট অ্যাকাডেমি চালান (যা সম্পূর্ণ স্বার্থের সংঘাত)। ধারাভাষ্য দেন। বেসরকারি লিগে কেউ কেউ কোচিং করান। সিএবি থেকে লক্ষ-লক্ষ টাকা নেন। কিন্তু দুর্ধর্ষ প্রতিভার খবর শেষ কবে এই দু’জন দিয়েছেন, ময়দান মনে করতে পারছে না!
৪) দ্বিতীয় ডিভিশনের ‘টাকার খেলা’: বাংলার এক প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেটারের বিরুদ্ধে যে অর্থের বিনিময়ে নিজের দ্বিতীয় ডিভিশন ক্লাবে প্লেয়ার খেলানোর অভিযোগ উঠছে, বুধবার ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ লেখা হয়েছিল। এ দিন শোনা গেল, বিত্তবান পরিবার থেকে আসা ক্রিকেটারদের অভিভাবকরাও নাকি সেই ‘দুর্নীতি’-তে যথেচ্ছ মদত দেন! মোটা অর্থের বিনিময়ে নাকি ছেলেপুলেকে টিমের অধিনায়ক করে দেন তাঁরা। মাঠে নেমে সেই সব ‘হিরের টুকরো’-রা রান করেন ৫! কিংবা ৪ ওভারে দেন ৬০! প্রতিভাবান অথচ গরীব-গুর্বো ক্রিকেটারদের সেখানে জায়গা নেই।
অতঃকিম? সাংবাদিকের কাজ সত্যিটা লেখা। বঙ্গ ক্রিকেটের শোচনীয় পরিস্থিতি নিয়ে গত দু’দিন ধরে ‘সংবাদ প্রতিদিন’ যা লিখেছে। বঙ্গ ক্রিকেট সংস্থার কাজ এবার এর প্রতিকার করা।
বল কিন্তু এবার সিএবি-র কোর্টে!