দুলাল দে, দোহা: কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর তিন নম্বর মাঠে মেসিরা যখন ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে খেলার জন্য তৈরি হচ্ছেন, তখন অদ্ভুত এক জিনিস দেখা গেল শিবিরের বাইরে সমর্থকদের মধ্যে।
নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে ম্যাচটা শেষ হয়েছে মাত্র তিনদিন আগে। তারমধ্যেই এক আর্জেন্টাইন সমর্থক তাঁর পায়ে মেসিকে নিয়ে দারুণ একটা ট্যাটু করিয়েছেন। মাঠের ধারে সহকারীর সঙ্গে বেঞ্চে বসে আছেন নেদারল্যান্ডস কোচ লুই ফান গল। আর মেসি তাঁর সামনে গিয়ে দু’হাত কানের দু’পাশে লাগিয়ে সেলিব্রেশন করছেন।
এতো গেল দোহাতে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের পরিস্থিতি। মেসি-সহ আর্জেন্টিনা (Argentina) দল যখন সবে দোহা পৌঁছেছিল, তখনই মেসির আদি বাড়ি রোজারিও থেকে এসেছিল এক খবর। সেখানে যে বাচ্চাই এখন জন্মাচ্ছে, বাবা-মা তার নাম রাখছে মেসি (Lionel Messi)। ফলে হাসপাতালগুলিতে বাচ্চাদের জন্মকে কেন্দ্র করে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। একসঙ্গে একই দিনে যদি সহস্র বাচ্চার নাম রাখা হয় মেসি, সমস্যা তো হবেই। আর তাই দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে রোজারিওর মেয়র ঘোষণা করে দিয়েছেন, নবজাতকের নাম কিছুতেই মেসি রাখা যাবে না। তিনি দোহায় সেমিফাইনালের প্রস্ততিতে মগ্ন থাকলেও, নিজের পাড়ায় তাঁকে কেন্দ্র করে যে পাগলামি শুরু হয়েছে, স্বাভাবিক নিয়মে সেই খবর এসেছে তাঁর কানেও।
[আরও পড়ুন: মোহনবাগানে স্পোর্টস লাইব্রেরি তৈরির কাজ শুরু, কবে উদ্বোধন? জানালেন সচিব]
আর্জেন্টিনায় এখন জনপ্রিয়তার তালিকায় চে, মারাদোনার পরই লিও মেসি। কিন্তু ৩৬ বছরের খরা কাটিয়ে মেসি এবারেও যদি বিশ্বকাপটা দেশে নিয়ে না যেতে পারেন, তাঁকে ঘিরে এই পাগলামি থাকবে তো?
এদিন দোহার স্থানীয় সময় ছ’টায় কোচ লিওনেল স্কালোনি যখন প্র্যাকটিস শুরু করলেন, সংবাদমাধ্যম উৎসুক হয়ে তাকিয়ে। যদি প্রথম একাদশটা বোঝা যায়। অত্যন্ত বুদ্ধিমান স্কালোনি ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম একাদশটাকেই পুরো ঘেঁটে দিলেন। মিনিট ১৫ পরই নেমে এল অদৃশ্য পর্দা। মাঠ ছাড়তে হল মিডিয়াকে। ঘন্টা আড়াই আগে কাতার আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিক সম্মেলনের মঞ্চে আর্জেন্টিনার কোচ স্কালোনি জানিয়ে এসেছেন, চোট থাকা দুই ফুটবলার ডি মারিয়া এবং ডি পল সুস্থ। তবে প্রথম দলে রাখবেন কি না, সেটা বলেননি।
মাত্র ১৫ মিনিটের প্র্যাকটিসে সংবাদমাধ্যমের সামনে ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর প্রথম একাদশ না দেখালেও, খোঁজ খবর নিয়ে যা জানা গিয়েছে, তাতে লুকা মদ্রিচদের বিরুদ্ধে আর্জেন্টিনার প্রথম একাদশ হতে চলেছে অনেকটা এরকম। গোলে অবশ্যই এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। চার ডিফেন্ডার- মোলিনা, রোমেরো, ওটামেন্ডি এবং কার্ড সমস্যায় আকুনার বদলে তাগলিয়াফিকো। তিন মিডফিল্ডার- ডি পল, ম্যাকালিস্টার, এনজো ফার্নান্দেজ। এবং তিন ফরোয়ার্ড- মেসি, ডি’মারিয়া এবং জুলিয়ান আলভারেজ। সাসপেনশনের জন্য শেষ চারের লড়াইয়ে নামতে পারবেন না মার্কোস আকুনা এবং গনজালো মনটিয়েল।
আপাতত এদিন প্র্যাকটিসের পর জানা গিয়েছে, ডি’মারিয়া খেললে ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে ৪-৩-৩ সিস্টেমে যাবে আর্জেন্টিনা। সেক্ষেত্রে মেসি খেলবেন ফলস নাইন পজিশনে। কোনও কারণে ডি’মারিয়া না খেলতে পারলে স্কালোনি ফর্মেশন সাজাবেন, ৪-৪-২-এ। সেক্ষেত্রে ফরোয়ার্ডে আর্জেন্টিনার দুই তারকা হবেন মেসি এবং জুলিয়ান আলভারেজ। মিডফিল্ডে একজন ফুটবলারের সংখ্যা বাড়বে। তিনি পারেদেস।
সাংবাদিক সম্মেলনে এসে স্কালোনি স্বাভাবিক ভাবেই বলতে চাননি, ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে কোন দল খেলাতে চাইছেন। শুধু বলেছেন, “আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে আলোচনা করে প্রতিপক্ষ বুঝে নিজেদের দল তৈরি করি। তবে তার জন্য আমাদের খেলার কোনও পরিবর্তন হয় না। আমরা যে স্টাইলে খেলি, সেটাই খেলব। অতিরক্ত আক্রমণাত্মকও হব না। আবার সেমিফাইনাল বলে অতিরিক্ত ডিফেন্সও করব না।”
এদিন প্রথম ১৫ মিনিটের প্র্যাকটিসেই মেসিকে বেশ চাঙ্গা লাগছিল। জাম রঙয়ের ফুল হাতা জার্সি পরে প্র্যাকটিসে নেমেছিলেন। প্রথম পনেরো মিনিট গা গরমের বিভিন্ন দৌড় ঝাঁপ করতেই কেটে গেল। আসলে এই সময়টা ফুটবলারদের ছবি তোলার জন্য ফটোগ্রাফারদের সময় দেওয়া হয়। আর সেই সময়েই দেখা গেল বেশ হাসি খুশি রয়েছেন তিনি। নেদারল্যান্ডস ম্যাচের পর যে অ্যাংরি ইয়ং ম্যানের ইমেজ তৈরি করে ফেলেছিলেন, তাকে এক টানে ছুঁড়ে ফেলে হয়ে গিয়েছেন সেই পুরনো, চেনা মেসি। তবে এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে ফের নেদারল্যান্ডস ম্যাচ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় স্কালোনিকে। আর্জেন্টিনার বর্তমান কোচ অবশ্য এই সব সমালোচনা সামলান খুবই দক্ষ হাতে। একদম নিস্পৃহ হয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে উত্তর দিলেন, “সেদিন রেফারি ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কাছে নেদারল্যান্ডস ম্যাচ অতীত হয়ে গিয়েছে। প্রথম ম্যাচে সৌদির কাছে হারার পর আমরা যখন ড্রেসিংরুমে ফিরি, তখন থেকেই তৈরি হয়েছিলাম পরের মেক্সিকো ম্যাচের জন্য। সেরকমই কোয়ার্টার ফাইনালের পর আমাদের মন থেক নেদারল্যান্ডস আউট হয়ে গিয়েছে। আমরা শুধুই তৈরি হয়েছি ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের জন্য।”
কিন্তু মেসি কি সহজে চার বছর আগে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হারটা খুব সহজে ভুলতে পেরেছেন? গ্রুপ লিগে লুকা মদ্রিচদের কাছে ০-৩ হারের পর গ্রুপ রানার্স হয়ে পরের রাউন্ডে ফ্রান্সের মুখোমুখি হতে হয়। সেই ম্যাচ হেরেই বিদায় রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকে। মেসি কি খুব সহজে ভুলে যাবেন সেই হারের ক্ষত? মঙ্গলবার কি পাওনা গন্ডায় লুকা মদ্রিচদের তা ফিরিয়ে দেবেন না? বিশেষ করে এই মুহূর্তে চার গোল করে তিনি যেরকম ফর্মে রয়েছেন। তবে নেদারল্যান্ডস ম্যাচের পর যেভাবে মেসির আচরণ নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে, তাতে এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে এসে বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন তাগলিয়াাফিকো। বলছিলেন, “আমাদের অধিনায়ককে যেভাবে সমালোচনা করা হয়েছে, তা মেসির প্রাপ্য নয়।”
তিনটে যুগ বিশ্বকাপ প্রবেশ করেনি আর্জেন্টিনায়। এবারই মেসির শেষ সুযোগ। আর তাই ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের আগে শান্ত থাকতে নিজেকে এতটাই গুটিয়ে নিয়েছেন যে, এদিন সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখিই হলেন না। বক্তব্য তো পরেও রাখা যাবে। আপাতত মঙ্গলবার ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে চার বছর আগের হারের প্রতিশোধটা তো নিতে হবে।