রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: লন্ডনে ফোন করে তাকে যখন রবিবার রাতে ধরা গেল, গলাটা পরিশ্রান্ত শোনাচ্ছিল। জুনিয়র উইম্বলডন বয়েজ সিঙ্গলস জেতার পর এক মুহূর্ত বিশ্রামের সময় পায়নি। একের পর এক ইন্টারভিউ দিতে দিতে ক্লান্ত। তারই মধ্যে আন্তর্জাতিক টেনিসে নতুন বাঙালি সেনসেশন একান্ত সাক্ষাৎকার দিল ‘সংবাদ প্রতিদিন’কে। ভিক্টর লাইলভকে ফাইনালে হারানোর মুহূর্ত থেকে শুরু করে সতেরো বছরের টেনিস সফর, প্রিয় টেনিস তারকা, সব কিছু নিয়ে খোলাখুলি কথা বলল সমীর বন্দ্যোপাধ্যায় (Samir Banerjee)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা হলেও যার ইতিহাস সৃষ্টির দিনে বারবার মনে পড়ে গেল কলকাতার কথা…
প্রশ্ন: জেতার পর কলকাতার খবর পেয়েছ?
সমীর: মানে? (থমকে গিয়ে)
প্রশ্ন: সমীর, কলকাতা তোমাকে নিয়ে স্রেফ উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। তুমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে খেলো, সেটা জেনেও তোমাকে সন্তান বানিয়ে ফেলেছে কলকাতা। গতকাল যখন জুনিয়র উইম্বলডন বয়েজ সিঙ্গলসের ফাইনালে উঠলে, সবাই গুগল সার্চ করা শুরু করে দিয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় খোঁজাখুঁজি চালাচ্ছিল, তোমার ব্যাপারে আরও কিছু জানা যায় কি না? আজ কলকাতা বলছে, তার নিজের সন্তান উইম্বলডন (Wimbledon 2021) জিতেছে!
সমীর: (হেসে) কলকাতার আবেগ জানি আমি। বহুবার গিয়েছি ছোট থেকে। আমার বাবা কুণাল বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার লোক। বাবার পরিবার সবাই কলকাতায় থাকেন। কলকাতার সব আমার ঘোরা। সাউথ ক্লাব-টাব সব। দেখুন, আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে খেলি ঠিকই। কিন্তু এটা জানি যে, আমার শিকড়টা কোথায়।
[আরও পড়ুন: Euro 2020: ফাইনালে হারের পরই ইটালির সমর্থকদের উপর চড়াও হলেন ইংরেজরা]
প্রশ্ন: রবিবার তুমি যে কীর্তিটা গড়লে, সেটা কলকাতারই আর এক সন্তান করে দেখিয়েছিলেন অতীতে। লিয়েন্ডার পেজ (Leander Paes)। লিয়েন্ডারও তোমার মতো জুনিয়র উইম্বলডন চ্যাম্পিয়ন।
সমীর: জানি। সত্যি বলতে, গর্ব হচ্ছে সেটা ভাবলে। ভাবলে অবিশ্বাস্যই লাগছে, এত বড় একজন কিংবদন্তির সঙ্গে আমার নামটা জুড়ে গেল ভেবে। জুড়ে গেল এমন একজনের সঙ্গে, যিনি কি না কলকাতার! অথচ জানেন, আমি যখন উইম্বলডন খেলতে আসি, স্বপ্নেও ভাবিনি টুর্নামেন্টটা জিতব।
প্রশ্ন: তাই?
সমীর: হ্যাঁ। আসলে আমার লাস্ট টুর্নামেন্টটা একেবারে ভাল যায়নি। ফ্রেঞ্চ ওপেনে ফার্স্ট রাউন্ডে ছিটকে গিয়েছিলাম। এবার তাই ঠিক করেছিলাম, টুর্নামেন্ট জেতার কথা ভাববই না। চাপটাই নিজের উপর রাখব না। ভেতরে ভেতরে জানতাম, ভাল খেলছি। নিজের সেরাটা দেব। তার পর যা হওয়ার হবে।
প্রশ্ন: সেখান থেকে সোজা চ্যাম্পিয়ন!
সমীর: এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। ট্রফিটা নেওয়ার সময় ভাবছিলাম, এই মুহূর্তটা আমার সঙ্গে চিরকাল থেকে যাবে। তারপর আরও অবাক লাগছে একই দিনে জকোভিচ উইম্বলডন জিতলেন বলে।
প্রশ্ন: তুমি জকোভিচের ভক্ত?
সমীর: অবশ্যই। জকোভিচ কী প্লেয়ার বলুন তো? আমি তো বলব, আমার দেখা শ্রেষ্ঠ প্লেয়ার, কমপ্লিট প্লেয়ার। কত কত নতুন প্লেয়ার আসে, নাদাল-ফেডেরারকে সামলাতে হয়, তবু জকোভিচকে থামানো যায় না। ও রকম কর্তৃত্ব নিয়ে খেলতে কাউকে দেখিনি। আমি শপথ নিয়ে ফেলেছি, নিজের খেলাটা জকোভিচের মতো করতে হবে।
প্রশ্ন: তা হলে তো তোমার কাছে রবিবার দিনটা অতীব স্পেশ্যাল। তুমি জিতলে, তোমার গুরুও জিতলেন।
সমীর: ভাবলেই অদ্ভুত লাগছে। টাইমিংটা খালি আমি ভেবে চলেছি। যে দিন আমার হাতে উইম্বলডন, সে দিন কি না জকোভিচের হাতেও উইম্বলডন! এর চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আর হয়?
প্রশ্ন: তোমার কেরিয়ার গ্রাফটা একটু বলো। টেনিসে আসা কীভাবে?
সমীর: ছ’বছর বয়স থেকে শুরু। প্রথম প্রথম টেনিস, বেসবল, সকার তিনটেই খেলতাম। আমার বাবা আসলে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে টেনিস খেলতে যেতেন। আমিও যেতাম সঙ্গে সঙ্গে। পরে বাবাই আমাকে ট্রেনিং দিতেন। ব্যস, আস্তে আস্তে টেনিসের প্রেমে পড়ে গেলাম।
প্রশ্ন: সকার, বেসবল সব ছেড়ে দিলে?
সমীর: সব। আসলে টেনিস খেলার সময় সব সময় আমার মনে হত, এই একটা খেলায় আমিই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারব। যা হবে, তার রিমোট আমার হাতে থাকবে। টিম স্পোর্টে যা সম্ভব নয়। আমার ক্রমাগত মনে হত, আমি ইন্ডিভিজুয়াল স্পোর্টের জন্যই ঠিক আছি। টিম স্পোর্ট আমার হবে না।
[আরও পড়ুন: Euro 2020: প্রি-কোয়ার্টার থেকে বিদায় নিলেও সোনার বুটের মালিক সেই রোনাল্ডোই]
প্রশ্ন: তারপর?
সমীর: তারপর ভালবাসাটা বাড়তে শুরু করল। প্রোফেশনাল কোচিং নেওয়া শুরু করলাম। বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলতে যেতাম। স্থানীয় সব টুর্নামেন্ট খেলতাম নিউ জার্সিতে। তারপর আস্তে আস্তে ন্যাশনালস। তখনই ঠিক করে ফেলি, আমার প্রথম ধাপ হবে কোনও গ্র্যান্ড স্লাম জেতা।
প্রশ্ন: আজ সেটা হয়েও গেল।
সমীর: হ্যাঁ। স্বপ্নপূরণ বলতে পারেন।
প্রশ্ন: এরপর কী?
সমীর: এরপর অনেক কিছু আছে। ধাপে ধাপে এগোব। ইউএস ওপেন খেলব। ন্যাশনালস খেলব। তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেনস টুর্নামেন্ট। স্বপ্নগুলো সাজাচ্ছি আস্তে আস্তে।
প্রশ্ন: আর কিছু? কলকাতার জন্য কিছু?
সমীর: (হাসি) সব কিছু শোনার পর কলকাতাকে তো হৃদয় দিয়ে ফেলেছি। কলকাতাকে বলতে চাই, আপনারা যে ভালবাসা আমাকে দিলেন, তা কোনওদিন ভুলব না। বরং আমি ভবিষ্যতে যত বার কোর্টে নামব, আপনাদের কথা মাথায় থাকবে। কথা দিচ্ছি, আপনাদের ভাল লাগে, আপনারা আনন্দ পান, সে রকম খেলাই এরপর থেকে খেলব আমি।