সব্যসাচী বাগচী: দুই কানে মাঝেমধ্যে দেখা যায় দুল। চোখে নিত্যনতুন সানগ্লাস। দুই হাত জুড়ে রয়েছে একাধিক ট্যাটু। সঙ্গে বাহারি চুলের ছাঁট। এক ঝলক দেখলে মনে হতেই পারে ছেলেটি একেবারে হার্দিক পাণ্ডিয়ার (Hardik Pandya) যোগ্য উত্তরসূরি! কিন্তু ২১ বছরের অভিষেক পোড়েল (Abishek Porel) ব্যাট হাতে বাইশ গজের দিকে এগিয়ে গেলেই বদলে যান। কানে সবসময় বাজতে থাকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly)-রিকি পন্টিংয়ের (Ricky Ponting) মন্ত্র। বাংলার হেড কোচ লক্ষ্মীরতন শুক্লার (Laxmi Ratan Shukla) পেপ টক। অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারির (Manoj Tiwary) কড়া মন্তব্য।
বাংলার (Bengal) জার্সি গায়ে চাপিয়ে একেবারে প্রথম ম্যাচ থেকেই মারকুটে মেজাজ দেখিয়েছিলেন। বেপরোয়া মনোভাবের জন্যই আলাদা পরিচিতি গড়েছেন। ব্যাটিংয়ের সেই ডোন্ট কেয়ার মনোভাব। আর সেই আগ্রাসী মেজাজকে সম্বল করেই সেরে ফেললেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর প্রথম শতরান। তাও আবার খুব চেনা ইডেন গার্ডেন্সের (Eden Gardens) বাইশ গজে। চলতি রনজি ট্রফিতে (Ranji Trophy 2023-24) ২১৯ বলে ১১৪ রানে থামল অভিষেকের দুরন্ত ইনিংস। ৫২.০৫ স্ট্রাইক রেট বজায় রেখে এই ইনিংস ১৪টি চার ও ১টি ছক্কা দিয়ে সাজানো ছিল। ছত্তিশগড়ের (Chhattisgarh) বিরুদ্ধে লড়াকু ইনিংসের পর টেলিফোনে সংবাদ প্রতিদিন.ইন-কে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন অভিষেক।
প্রশ্ন) বাংলার হয়ে আপনার তৃতীয় মরশুম চলছে। ১৮টি ম্যাচে ৭টি অর্ধ শতরান করলেও শতরান পাচ্ছিলেন না। এবার কী কোনও বিশেষ প্ল্যান ছিল?
অভিষেক) আমার মাথায় শুধু একটাই ব্যাপার কাজ করছিল। যাই হয়ে যাক, শরীরের যেখানেই লাগুক, যতই স্লেজিং চলুক, আমাকে ২০০টি বল খেলতেই হবে। আমাদের কোচ লক্ষ্মী দা বারবার আমাকে সেটা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। এগুলো মাথায় রেখেই ব্যাট করছিলাম।
প্রশ্ন) গত রনজি ফাইনালের দ্বিতীয় ইনিংসে সৌরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অর্ধ শতরান করেছিলেন। এর পর এবার সেই ইডেনে নেমেই শতরান। ইডেনের ঘাসে ভরা পিচে ব্যাট করার অভিজ্ঞতা কেমন?
অভিষেক) ছোটবেলা থেকেই আমি মানসিকভাবে খুবই শক্তিশালী। তাই চাপের মুখে পারফর্ম করতে অসুবিধা হয় না। গত রনজি ফাইনালে অর্ধ শতরান করলেও জিততে পারিনি। সেই আক্ষেপ রয়েই গিয়েছে। তবে এবার শতরান করে কিছুটা আক্ষেপ মিটেছে। অনেকেই ভাবেন ইডেনের ঘাসে ভরা উইকেটে ব্যাট করা কঠিন। কিন্তু লড়াই করার ক্ষমতা ও তাগিদ থাকলে এই পিচে রান করা অসম্ভব নয়। যদিও এই মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্য ম্যাচটা জিততে হবে। আগামী তিন দিন সেটাই আমাদের টার্গেট।
[আরও পড়ুন: রনজিতে প্রথম শতরান, সৌরভ-পন্থের দিল্লিকে ভরসা দিলেন বাংলার অভিষেক]
প্রশ্ন) লক্ষ্মী আপনার ইনিংস দেখে কতটা খুশি?
অভিষেক) লক্ষ্মী দা আমার ইনিংস দেখে দারুণ খুশি। কারণ এই পর্যায়ে এসে পারফর্ম করার জন্য ওঁর অনেক অবদান রয়েছে। মরশুম শুরু হওয়ার আগে সকালের দিকে ঘণ্টার পর ঘন্টা আমাকে থ্রো ডাউন প্র্যাকটিস করিয়েছে। শুধু আমার জন্য নয়, দলের বাকিদের জন্যও লক্ষ্মী দা একইভাবে পাশে থেকেছে। এগুলো অনেকেই দেখতে পায় না। তবে এই সাহায্যগুলো পেয়েছি বলেই, শতরানের মুখ দেখলাম। তবে এটা সবে শুরু। এখনও অনেক দূর এগোতে হবে। সামনে অনেক ম্যাচ রয়েছে।
প্রশ্ন) অনুষ্টুপ মজুমদারের সঙ্গে ব্যাট করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
অভিষেক) রুকু দা আমাদের দলের অন্যতম বড় সম্পদ। বাংলা দলে সুযোগ পাওয়ার আগেও রুকু দা-র অনেক লড়াকু ইনিংস দেখেছি। আর এখন তো এই দলের সদস্য হিসেবে ওঁকে আরও কাছ থেকে দেখছি। ক্রিজে ব্যাট করার সময় থেকে ড্রেসিংরুম, সব জায়গায় রুকু দা একজন আদর্শ টিমম্যানের উদাহরণ তৈরি করেছে। এবার তো আমরা অনেকটা সময় ব্যাট করলাম। প্রতি মুহূর্তে আমাকে আগলে রাখছিল। কোন সময় কেমন শট মারতে হয়, কোন সময় নিজের উইকেট আগলে রাখতে হয়, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিল রুকু দা।
প্রশ্ন) গত দুই মরশুম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে একাধিকবার ট্রেনিং করেছেন? লাল বলের ক্রিকেটে রান করার জন্য তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ পেয়েছেন?
অভিষেক) সৌরভ স্যর আমাকে একটা কথা বারবার বলেন। তিনি বলেন, ‘ছয় ঘন্টা ব্যাট করলে তবেই শতরান করা যায়’। এটাও মাথায় ছিল। এর আগে রনজি ট্রফি খেলার সময় কয়েকটা ইনিংসে মারতে গিয়ে দ্রুত আউট হয়ে গিয়েছিলাম। সৌরভ স্যর আমাকে ধৈর্য বজায় রাখতে বলেছিলেন। কলকাতায় অনুশীলন করার সময় স্পিনারদের বিরুদ্ধে খেলতে কিছু সমস্যা হচ্ছিল। সেই সময় স্যর আমার কাছে ফুট ওয়ার্কের ভুল দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়া কিপিং-এর খুঁটিনাটি নিয়ে মাঝেমধ্যেই আলোচনা হয়।
প্রশ্ন) সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়-রিকি পন্টিংয়ের সান্নিধ্যে থেকে আপনার মধ্যে কতটা বদল হয়েছে?
অভিষেক) নিজের মধ্যে বদল তো দেখতেই পারছি। আইপিএল খেলার সুবাদে বাকি দলগুলোর দেশি ও বিদেশি ক্রিকেটারদের সঙ্গে মিশেছি। এবং বুঝেছি কতটা প্রতিযোগিতা চলছে। বড় সার্কিটে টিকে থাকতে হলে লাগাতার পারফর্ম করতেই হবে। এছাড়া আর কোনও উপায় নেই। আমি সেটা ইতিমধ্যেই বুঝে গিয়েছি। শুধু বাংলা ও আইপিএল খেলে সন্তুষ্ট থাকলেই চলবে না। আমার টার্গেট টেস্ট খেলা। সেই টার্গেট ও মোটিভেশনকে সামনে রেখেই প্রতিদিন মাঠে নামি।
প্রশ্ন) বিশ্বকাপের সময় দিল্লি ক্যাপিটালসের ক্যাম্প বসেছিল। সেই সময় ঋষভ পন্থ আপনাকে কী পরামর্শ দিয়েছিলেন?
অভিষেক) আমি ব্যাট করার সময় ঋষভ ভাই নেটের পিছন দাঁড়িয়ে ছিল। বলে যাচ্ছিল, ‘আচ্ছা ফিল আ রাহা হ্যায়। অ্যায়সে হি ব্যাট করনা হ্যায়!’ লাল বলের ক্রিকেট নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনও আলোচনা হয়নি। যাবতীয় আলাপ সাদা বলের ক্রিকেট নিয়েই হয়েছিল। টি-২০ ফরম্যাটে আমি অনেক পরে ব্যাট করার সুযোগ পাই। সেই সময় কোন মানসিকতা বজায় রাখতে হবে। কীভাবে বিপক্ষের উপর অ্যাটাক করতে হবে, সেগুলো নিয়েই ঋষভ ভাইয়ের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল।
প্রশ্ন) কাদের এই শতরান উৎসর্গ করবেন?
অভিষেক) আমার দাদু প্রয়াত তুলসী পোড়েলকেই এই শতরান উৎসর্গ করলাম। দাদুই আমাকে ছোটবেলা মাঠে নিয়ে যেতেন। সেখান থেকেই ক্রিকেটের প্রতি টান শুরু হয়েছিল। তাছাড়া আমার বাবা-মা (পড়ুন, সোমনাথ পোড়েল ও অনিমা পোড়েল) তো আছেনই। কারণ লেখাপড়ার মাঝে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা থাকলেও বাবা-মা কখনও আটকে রাখেননি। পরিবারে অনেক সময় আর্থিক সমস্যা তৈরি হয়েছিল। তবে বাবা-মা আমার পাশে সবসময় দাঁড়িয়েছেন। তাই ওঁরা তো আমার এই সাফল্যের দিনের শরিক।
প্রশ্ন) অধিনায়ক মনোজ এই ইনিংস দেখে কিছু বলেছেন?
অভিষেক) মনোজ দা-ও খুব খুশি। শুধু তাই নয়, মনোজ দা সবসময় একটা কথা বলে, ‘এই সময় টেস্ট দলে উইকেটকিপার দরকার। সেভাবে মাইন্ডসেট তৈরি কর।’ এই পরামর্শগুলো মাথায় রেখেই এগিয়ে যেতে চাই।