অজিত তেণ্ডুলকর: কোনও দিন কি আমি ভেবেছিলাম যে, শচীন একদিন সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার হবে? কোনও দিন কি ভেবেছিলাম যে, একদিন ওর তুলনা স্যর ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যানের (Sir Donald Bradman) সঙ্গে হবে? কোনও দিন কি ভেবেছিলাম যে, শচীন (Sachin Tendulkar) একদিন একশোটা আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি করবে, বিশ্বকাপ জিতবে? উত্তর হল– না। জীবনে কখনও ভাবিনি। আমি শুধু জানতাম যে, শচীন একদিন ভাল ব্যাটার হবে।
আমরা যে সোসাইটিতে থাকতাম, ক্রিকেট সেখানে খুব জনপ্রিয় ছিল। অত অল্প বয়সে টেকনিক নিয়ে ভাবার মানে হয় না। কিন্তু যে ভাবে ব্যাটকে বলের কাছে ও নিখুঁতভাবে নিয়ে যেত, ওর যা ব্যাট-সুইং ছিল, যতটা নিখুঁতভাবে ও কানেক্ট করত, দেখে মনে হত ছেলেটার মধ্যে কিছু না কিছু স্পেশ্যাল ব্যাপার তো আছে, যাকে উৎসাহ দেওয়া উচিত। আমিও ক্রিকেট খেলেছি অল্পস্বল্প। আমার তাই মনে হত, শচীনকে যদি ঠিকঠাক কোচের হাতে দেওয়া যায়, যদি ওকে সঠিক দিশা দেখানো যায়, একদিন ও ভাল ক্রিকেটার হবে।
[আরও পড়ুন: ‘শচীনের সঙ্গে মিল মূল্যবোধে’, বলছেন অর্ধাঙ্গিনী অঞ্জলি তেণ্ডুলকর]
আর তখনই ঠিক করি, আমি শচীনকে রমাকান্ত আচরেকর (Ramakant Achrekar) স্যরের কাছে নিয়ে যাব। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে, রমাকান্ত স্যরই কেন? স্যরের মধ্যে আলাদা একটা ব্যাপার ছিল। আমি পড়তাম বালমোহন স্কুলে। আর স্যরের স্কুল ছিল সারদাশ্রম। যত বার আমাদের খেলা পড়ত সারদাশ্রমের সঙ্গে, তফাতটা বুঝতে পারতাম। বালমোহনের পড়ুয়ারা পড়াশোনাকে গুরুত্ব দিত বেশি। কিন্তু সারদাশ্রমের কাছে ক্রিকেটই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেত। স্কুল শেষ করে আমি যখন কলেজে ঢুকছি, আচরেকর স্যর কী করছেন না করছেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেয়াল করতাম। স্যরের তিন জন ছাত্র আমার সঙ্গে পড়ত কলেজে। চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত, লালচাঁদ রাজপুত এবং সুভাষ শিবসাগর। আমি যেখানে প্রথম বল খেলার আগে টেনশনে ভুগতাম, ওরা সেখানে নেমেই রান করতে শুরু করে দিত। আসলে তফাতটা ছিল খিদেয়। চাপ অনেক ভাল ভাবে ম্যানেজ করতে জানত ওরা। আর সেটাই আচরেকর স্যরের মাহাত্ম্য।
স্যর কী শিখিয়েছিলেন শচীনকে? যন্ত্রণার সঙ্গে সমঝোতা করতে শিখিয়েছিলেন। অনেক সময়ই ব্যাট করার সময় শচীনের মুখে বল এসে আছড়ে পড়েছে। আসলে মুম্বইয়ের পিচগুলো তো অত ভাল ছিল না তেমন। অনেক সময়ই ব্যাটারের মুখে-মাথায় এসে বল লাগত। বলের বেয়াদপি করা নিয়মই ছিল মুম্বইয়ের মাঠঘাটে। আর ও ভাবে আঘাত পেতে পেতে শচীনের কাছে যন্ত্রণা সহ্য করাটা সহজাত হয়ে গিয়েছিল। আর তাই পাকিস্তান সফরে গিয়ে যখন ওর নাকে সজোর আঘাত লাগে, ও এতটুকু কেঁপে যায়নি। আমি পাকিস্তান গিয়েছিলাম শচীন কেমন খেলছে দেখতে। বলটা যখন আছড়ে পড়ে শচীনের নাকে, তার আওয়াজ শুনেছিলাম আমি। দেখেছিলাম, দরদরিয়ে নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে ওর। কিন্তু শচীনের মনে হয়েছিল যে, ও খেলা চালিয়ে যেতে পারবে। আসলে চিরকাল দায়িত্ব নিতে পছন্দ করে শচীন। আর সেই সময় মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া মানে, টিমকে আরও বিপদে ফেলা। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, শচীন সেটা করবে না। আর তাই হয়েছিল।
অনেকেই খেয়াল করেননি যে, শচীন নাকে আঘাত পাওয়ার পরেও ভাইজার ছাড়াই ব্যাট করে যাচ্ছিল। যার অর্থ হল, একই জায়গায় আবার ওর আঘাত লাগতে পারে। কিন্তু শচীন যে ও রকমই। যন্ত্রণাকে পাত্তা দিত না ও।
শচীন খেলা ছেড়ে দিয়েছে বেশ কয়েক বছর হল। আর এখন ওর কেরিয়ার নিয়ে ভাবতে বসলে দুটো ব্যাপার আমাকে বেশ তৃপ্তি দেয়। একজন ক্রিকেটারকে বিশুদ্ধবাদী এবং সমর্থকরা একই সঙ্গে শ্রদ্ধা করছে, খুব কমই দেখবেন আপনারা। শচীনের ক্ষেত্রে বিশুদ্ধবাদীরা যে ভাবে ভাবতেন, সমর্থকরাও তাই। ভাবনায় কোনও বিভাজন দেখিনি। দ্বিতীয়ত, শচীনের নিজেকে উন্নত করার অসীম ক্ষমতা আমাকে টানত। নিজের কেরিয়ারের প্রতিটা মুহূর্তে ও শিখতে চাইত। সব সময় নিজের সেরা ভার্সনকে দেখতে চাইত।
শুরুতেই আমি লিখেছি যে, আমি কোনও দিন ভাবিনি শচীন একদিন একশোটা সেঞ্চুরি করবে। আসলে সংখ্যা, পরিসংখ্যান এ সবের পিছনে আমরা ছুটিনি কখনও। আমরা ভাবিনি যে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৩৫ হাজার রান করতে হবে। আমি শুধু চেয়েছি, শচীনের সেরা ভার্সনটা মাঠে নামুক। ও ভাল ব্যাটার হোক। নিজের সব কিছু দিয়ে ও এত কীর্তি গড়েছে, এত কিছু অর্জন করেছে। যা শচীনের সঙ্গে থেকে যাবে চিরকাল।
শচীনের পঞ্চাশতম জন্মদিনে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা থাকল।