বোরিয়া মজুমদার: ঝুলন গোস্বামীকে (Jhulan Goswami) ঠিক কোন শব্দবন্ধে বোঝাব? দেশজ ক্রিকেটের প্রেক্ষিতে, বিশেষ করে দেশের মহিলা ক্রিকেটের প্রেক্ষিতে ঝুলন গোস্বামী নামটা কত অর্থবহ? কেন ঝুলন গোস্বামী এতটা স্পেশ্যাল? কেন বিশ্বক্রিকেট দীনহীন হয়ে যাবে শনিবারের পর থেকে, ঝুলন গোস্বামীর অবসরের কারণে?
নিছক ভাষায় কয়েকটা লাইন না লিখে গোটা কয়েক উদাহরণ দিয়ে বরং উত্তরগুলো দেওয়া ভাল। ঝুলন গোস্বামীকে নিয়েই কয়েকটা উদাহরণ। ২০১৭ বিশ্বকাপে ঝুলন প্রথম দিকে একেবারেই ভাল বোলিং করছিলেন না। যার পর তিনি নিজেই গিয়ে কোচকে বলেন যে, মনে হলে আমাকে বসিয়ে দিন! ডার্বি যাওয়ার পথে টিম কোচের প্রথম সিটে বসে ঝুলন সে দিন ক্রমাগত কোচকে বুঝিয়ে গিয়েছিলেন যে, কেন টিমের স্বার্থে তাঁকে বাদ দেওয়া উচিত। এটাই ঝুলন গোস্বামী। যিনি একদিকে কিংবদন্তি যেমন, তেমন আদর্শ টিম প্লেয়ারও বটে। তৎকালীন ভারতীয় কোচ তুষার আরোঠে সে দিন শোনেননি ঝুলনের কথা। বরং বলেন যে, বোলিংটা করে যেতে। আর এটাও বলেন, পুরো টিম ঝুলনের সঙ্গে আছে। রেজাল্ট? সেমিফাইনালে মেগ ল্যানিংয়ের বিরুদ্ধে ক্লাসিক বোলিং আর ফাইনালে ঐতিহাসিক স্পেল।
[আরও পড়ুন: ডেঙ্গু মোকাবিলায় তৎপর রাজ্য, স্বাস্থ্যকর্মীদের ছুটি বাতিল পুজোয়!]
পরের ঘটনাটা বছরখানেক বাদের। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে একটা ওয়ান ডে ম্যাচে প্রচুর লড়াই করেও শেষ পর্যন্ত হেরে যায় ভারত। কারণ– ঝুলন একটা নো বল করেছিলেন। যদিও সেই নো বলটা না দিলেও মহাভারত অশুদ্ধ হত না। ঝুলনের মনের ভিতর থেকে সে দিন কতটা ঝড় বয়ে গিয়েছিল বোঝাতে ওঁর মন্তব্যই তুলে দিচ্ছি, “রাত সাড়ে তিনটে পর্যন্ত ঘুমোতে পারিনি। ঘরে পায়চারি করে গিয়েছি। মহিলা ক্রিকেটে ২৭৫ তুললে জেতা উচিত। আমরা জেতার অত কাছে চলে গিয়েছিলাম। ভাবলেই যন্ত্রণা হচ্ছে।”
পরের দিন বলেছিলেন, “শেষ পর্যন্ত সেই রাতে ঘুমোতেই পারিনি। পর দিন উঠি সকাল সাড়ে দশটায়। দেখি, হরমন আর স্মৃতি ফোন করছে। বলল, আমাকে নিয়ে ওরা বেরোতে চায়। যে কোনও ম্যাচের আগের দিন আমি একটা নির্দিষ্ট রুটিন মেনে চলি। কিন্তু ওরা সে দিন আমার কোনও কথা শুনল না। আমার প্রি ম্যাচ রুটিন ভেঙে চুরমার করে দিল।” মনে আছে, বলতে বলতে হেসে ফেলেছিলেন ঝুলন। তা সেই প্রাতরাশের সময়ই ঝুলনকে হরমনরা বলেন যে, অতীতে কী হয়েছে তা নিয়ে না ভেবে শেষ ম্যাচটায় মন দিতে। “ওরা আমাকে বলেছিল, তুমিই আমাদের শেষ ম্যাচটা জেতাবে। শোনামাত্র মনে হল, এটাই তো সময় নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ফের ঝাঁপানোর। আগামী কাজে মন দেওয়ার। আর আমি তাই করেছিলাম। শেষ ওয়ান ডে-তে বল করতে যাচ্ছি যখন, আমার শরীরে যন্ত্রণা করছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ফুটছিলাম। ঠিক করে ফেলেছিলাম, আমাকে পারতেই হবে।”
[আরও পড়ুন: প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে মিলল সমাধান সূত্র, ৫ দিন পর আন্দোলন প্রত্যাহার কুড়মিদের]
তা পেরেছিলেন ঝুলন। জিতিয়েওছিলেন ভারতকে। পরে ঝুলনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, ডাগআউটে ব্যাট হাতে বসে থাকার সময় ভেতরে ভেতরে কী চলছিল? উত্তরে ঝুলন বলছিলেন, “কোচ রমেশ পাওয়ার আমাকে বলেছিল, তুমিই জেতাবে আমাদের। জয়ের স্ট্রোকটা তুমিই নেবে। শুনে প্রথমে বিশ্বাস করিনি। কিন্তু ডেলিভারিটা খেলার আগে ঠিক করি সোজা মারব। নিজের জায়গায় পেলে হয় সোজা নইলে মিড অফ দিয়ে উড়িয়ে দেব। আর সেটা পাওয়া মাত্র নিজেকে বলেছিলাম, চলো ঝুলন। ওড়াও।” আর সে দিন বলটা বাউন্ডারি পার করা মাত্র সব কিছু বদলে গিয়েছিল ঝুলন গোস্বামীর। তিনি আবার ম্যাচ উইনার হয়ে গিয়েছিলেন। সর্বোপরি, ভারতকে জিতিয়েছিলেন।
আর খেলা তো সেটাই করে। শোককে উৎসবে বদলে দেয় এক লহমায়। ঝুলন জানেন সমস্ত। তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ার তুলনাহীন এক কথায়। চাকদহ থেকে লর্ডস– এই সফরে ঝুলন গোস্বামী এমন এক পরম্পরা সৃষ্টি করে গেলেন যা পরবর্তীতে ছোঁয়া বড় কঠিন হবে। সবচেয়ে বড় কথা বঙ্গসন্তান একটা নবজাগরণ ঘটিয়ে গেলেন। নানা বাধা-বিপত্তি চুরমার করে। বলা হত, মহিলা ক্রিকেটে ভারত নাকি পেসার বোলার তৈরি করতে পারে না। এখন সে সব কেউ প্রশ্নে সোজা ঝুলনকে দেখিয়ে বলা যাবে, “এঁকে দেখুন। ইনি পেসার ছিলেন। এবং কুড়ি বছর ধরে রাজত্ব করেছেন।”
আসলে ঝুলন ছিলেনই একজন জাদুকরী। যিনি সব সময় আশার ঝাড়বাতি জ্বালতেন। তিনি মাঠে নামলে দেশের জেতার সব সময় সম্ভাবনা থাকত, সম্ভাবনা থাকত একটা উইকেট পাওয়ার। ঝুলনকে দেখে এক এক সময় রজার ফেডেরারের কথা মনে পড়ে। দু’জনে যেন জন্মগ্রহণই করেছিলেন, খেলবেন বলে। আর দু’জনেরই কী অসামান্য কেরিয়ার দেখুন। বল গার্ল হিসেবে সাতানব্বইয়ের ইডেনে শুরু ঝুলনের। সেখান থেকে বিশ্বসেরাদের মহড়া নেওয়া, তাঁদের উইকেট তোলা। সিনেমার মতো নয় এটা? আর এখন তো তাঁকে নিয়ে সিনেমাও হচ্ছে, অনুষ্কা শর্মা করছেন। কোথাও গিয়ে মনে হয়, ভারতীয় ক্রিকেটের দরকার ঝুলনকে। অনুপ্রেরণা হিসেবে, মোটিভেটর হিসেবে, সর্বোপরি পরবর্তী তরুণ প্রজন্মকে পরিশ্রমের মূল্য কতটা, তার শিক্ষিকা হিসেবে।
ভাল থাকবেন ঝুলন। মাথা উঁচু করে আজ থেকে অবসরে যান।