অর্পণ দাস: শেষ ওভারে হার্দিকের (Hardik Pandya) হাতে বল। ম্যাচ জিততে দরকার ১৬। তাঁর কাঁধেই সারা দেশের বিশ্বকাপ স্বপ্ন । হার্দিকের নিশ্চয়ই মনে পড়ছিল মাস দেড়েক আগের কথা। আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের শেষ ম্যাচ ছিল ১৭ মে। সেই ম্যাচও হেরে মাঠ ছেড়েছিলেন হার্দিক পাণ্ডিয়ারা। সম্ভবত সেদিন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন মুম্বই অধিনায়ক। কারণটা আর নতুন করে বলার নেই। ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টে এমন একটা দিন আসেনি, যেদিন বিদ্রুপের শিকার হতে হয়নি হার্দিককে। গুজরাট টাইটান্সের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচ থেকে শুরু। গ্যালারি থেকে উড়ে এসেছে তীব্র বিদ্রুপ। তুলনা করা হয়েছে কুকুরের সঙ্গে। ছানবিন করে দেখা হয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন। সোশাল মিডিয়ায় তাঁর নতুন ডাক নাম হয়েছিল ‘ছাপরি’।
আর আজ? অতীতে ফিরে গিয়ে পাঁক ঘেঁটে দেখতে চাইবেন না কেউ। আজ ভারতের হাতে বহুপ্রতীক্ষিত বিশ্বকাপ ট্রফি। তাতে যোগদান রয়েছে হার্দিকেরও। তাঁর মুখে এখন হাজার ওয়াটের আলো। সাফল্য সব ভুলিয়ে দিতে পারে। তাই আজ ‘চ্যাম্পিয়ন’ হার্দিককে নিয়ে বন্দনা। টিম ইন্ডিয়ার অলরাউন্ডারকে মাথায় তুলে রাখার পালা। সময়ের হিসেবে দেড় মাসও কাটেনি। ‘ওয়াক্ত বদল দি, জিন্দেগি বদল দি’। এমনকী নিন্দুকদের স্ট্যান্ডপয়েন্টও বদলে গেল এত কম সময়ে।
কথায় বলে ক্রিকেট বলের খেলা। ক্রিকেটারদের স্টার-ভ্যালুও সেই অনুপাতে কমে-বাড়ে। হার্দিকের মূল্য এখন বাড়তির দিকে। এখন তিনি হিরো। জনগণমনের সহ-অধিনায়ক। ক্রিকেট যে দেশে ধর্ম, সেখানে এই ঝুঁকিটা নিয়েই মাঠে নামতে হয় সব খেলোয়াড়কে। ক্রিকেটাররা আসলে ট্রাপিজের দড়িতে হাঁটেন। ক্রিকেটারদের ঈশ্বর হিসেবে পুজো করে যেমন মাথায় তুলে রাখা হয়, তেমনই দেবতাকে স্বর্গভ্রষ্ট করতেও বেশিদিন লাগে না। কুশপুতুল পোড়ানোর ইতিহাস থেকে সোশাল মিডিয়ার মিম, ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলিতেছে’।
[আরও পড়ুন: ইউরো চ্যাম্পিয়ন কবে কোন দেশ? জানিয়ে দিল মেটা এআই]
আইপিএলে তার নমুনা ভালোমতোই টের পেয়েছিলেন হার্দিক। তাঁর নেতৃত্বে অভিষেকেই চ্যাম্পিয়নের মুকুট পড়েছে গুজরাট। পরের বছরের ফাইনালিস্ট। চ্যাম্পিয়নের রাজমুকুটের পরিবর্তে জুটল রানার্সের সান্ত্বনা। সেটাই বা কম কীসে! অথচ বিরাট অঙ্কে মুম্বইয়ে ফিরতেই শুরু হল আক্রমণ। কেন? স্পষ্ট উত্তর সেদিন কারও কাছে ছিল না, আজও নেই। রোহিত শর্মাকে সরিয়ে অধিনায়ক হওয়া, পুরনো নেতাকে দূরে ফিল্ডিং করতে বলা, নাকি কুছ পরোয়া নেহি অ্যাটিটিউড। কোনটা দায়ী ছিল সেদিন? ‘ট্রেন্ডিং’-এর দুনিয়ায় হার্দিক হয়ে উঠেছিলেন সফট টার্গেট।
প্রশ্ন উঠেছিল, জাতীয় দলে তাঁর দায়বদ্ধতা নিয়েও। ভারতের হয়ে খেলার সময় আহত হন। আর আইপিএল এলেই পুরো ফিট। গত বছর বিশ্বকাপে টিম ইন্ডিয়ার অলরাউন্ডার হিসেবে শুরুটা খারাপ করেননি হার্দিক। তখন বিশ্বজয়ের স্বপ্নে মশগুল গোটা দেশ। কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চোটটা অভিশাপ হয়ে নেমে এল তাঁর জীবনে। ছিটকে গেলেন টুর্নামেন্ট থেকে। চোটের খাঁড়া যে কোনও মুহূর্তে নেমে আসতে পারে। প্লেয়ারের নিয়ন্ত্রণে থাকে না তা। হার্দিকের অবশ্য যুক্তি ছিল, ইঞ্জেকশন নিয়েও তিনি চেষ্টা করেছিলেন মাঠে নামার। কিন্তু মাঠে নেমে ঘাম-রক্ত না ঝরালে এই ধরনের কথার কোনও মূল্যই থাকে না। শেষ কথা বলে পারফরম্যান্স।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (T20 World Cup 2024) পর নিশ্চয়ই সেই গুঞ্জন থামবে। রোহিত শর্মা বলেছিলেন, এই টিমটা কোনও ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল নয়। কেউ নিজের স্কোরবোর্ডের দিকে তাকিয়ে খেলছে না। আর যদি ওঠে হার্দিকের পরিসংখ্যানের কথা, তাহলে ১২ উইকেট আছে তাঁর। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অর্ধশতরান-সহ প্লেয়ার অফ দ্য ম্যাচ। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে ব্যাট হাতে লোয়ার অর্ডারে ছোট্ট ক্যামিও। আর অবশ্যই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মোড় ঘোরানো দুটো উইকেট। আর ফাইনালে ৩ উইকেট। তার পর কাঁধ ঝাঁকানো সেলিব্রেশন। যথেষ্ট নয় কি?
মুম্বইয়ের জার্সিতে হার্দিক পাণ্ডিয়া।
আসল কথাটা হল, রোহিতরা যেটা চেয়েছেন, সেটাই পেয়েছেন। দুঃস্বপ্নের আইপিএল সত্ত্বেও হার্দিককে দলে নেওয়া নিয়ে কম সমালোচনা হয়নি। কিন্তু আগরকর-দ্রাবিড়দের কাছে বক্তব্য খুব স্পষ্ট ছিল। এই মুহূর্তে পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসাবে আর কোনও বিকল্প ভারতের হাতে নেই। শিবম দুবে আইপিএলেও সেভাবে বল করেননি, বিশ্বকাপেও একই অবস্থা। তাই হার্দিক দলে থাকলে বাড়তি পেসার খেলানোর প্রয়োজন পড়ে না। দলের ভারসাম্যের জন্য তাঁর থাকাটা জরুরি। তাছাড়া হার্দিক ম্যাচ উইনার। বড় ম্যাচে ভালো খেলার অভ্যাসও আছে। আর শেষ বিশ্বকাপে চোট পাওয়ার আগে পর্যন্ত জাতীয় দলের জার্সিতে হার্দিক মোটেই খারাপ খেলেননি। তাই তাঁকে সহ-অধিনায়ক পদ থেকে সরানোরও প্রয়োজন কখনওই বোধ করেননি আগরকররা।
[আরও পড়ুন: খুদে প্রতিভাকে সাহায্য, মার্লিন গ্রুপ এবং যুবরাজ সিং সেন্টার অফ এক্সিলেন্সের তরফে স্কলারশিপ ঋষিকাকে]
এটাই একটা সুস্থ, পরিকল্পিত টিম ম্যানেজমেন্টের সাফল্য। শুধু সেরা খেলাটা বের করে নিয়ে আসা নয়, তাঁর কাঁধে বিশ্বাসের হাত রাখা। হার্দিক নিজের হারানো ফর্ম খুঁজে পেয়েছেন, পরিশ্রমই সাফল্যের মন্ত্র। এই সব বাণী থাকবেই। কিন্তু সমান কৃতিত্ব রোহিত-দ্রাবিড়েরও। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে হার্দিক-রোহিত বিবাদ নিয়ে কত জল্পনা ছড়িয়ে ছিল সেই সময়ে। সমর্থকদের ক্রমাগত ধিক্কার হোক কিংবা সোশাল মিডিয়ায় বিদ্রুপ, মুম্বই ইন্ডিয়ান্স থেকে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি তারা। শোনা গিয়েছিল, একসঙ্গে প্র্যাকটিস করেন না দুজনে। যখন অধিনায়ক ব্যাট করতে আসেন, তখন সাইডলাইনের ধারে বসে থাকেন রোহিত, সূর্যকুমাররা। আবার রোহিতের ব্যাটিংয়ের সময় একেবারেই দেখা যায় না হার্দিককে। সেসব যদি সত্যি হয়, তাহলে এটাও বলতে হয় দুই তারকার পেশাদারিত্বের জবাব নেই। জাতীয় দলের জার্সিতে তাঁদের দায়বদ্ধতার কোনও অভাব নেই। সেটাই এই দলটার মূলমন্ত্র। কই, জাতীয় দলে তো কোনও বিতর্ক হল না! অফ ফর্মে থাকা একজনকে কখন-কীভাবে খেলাতে হয়, তার নকশা সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগ করলেন রোহিত-দ্রাবিড়। শেষ ওভারে বল তুলে দিলেন তাঁর হাতে। আর হার্দিকও প্রমাণ করে দিলেন, তিনি ভরসার যোগ্য।
এই সেই মুহূর্ত। আলিঙ্গনে রোহিত ও হার্দিক।
আইপিএলের মাঝেই ব্রায়ান লারা বলেছিলেন, হার্দিককে যদি সম্মান ফিরে পেতে হয়, তাহলে তাঁকে জাতীয় দলের হয়ে পারফর্ম করতে হবে। সেই কাজটা দায়িত্বের সঙ্গে করেছেন তিনি। কিন্তু মজার বিষয় হল, তার পরও কেউ পরবর্তী প্রজন্মকে বলবে না, ‘হার্দিকের মতো ক্রিকেটার হও’। বিতর্ক আর হার্দিক, একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। মাঝেমাঝেই তাঁর শরীর থেকে খসে পড়ে ক্রিকেটারের জোব্বা। তিনি ভুলে যান ক্রিকেটারদের সামনেও ঝুলছে ‘ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস’-এর অদৃশ্য এক সাইনবোর্ড। ক্রিকেট নয়, বারবার আলোচনায় চলে আসে তাঁর জীবনযাত্রা, আচার-আচরণ। কিছুক্ষেত্রে যাকে ‘ঔদ্ধত্য’ বললেও ভুল বলা হয় না। হার্দিক সে সবের ধার ধারেন না। যে অ্যাটিটিউড তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রু, বিপদকালে সেটাই তাঁর সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে ওঠে। ফর্মের সমস্যা তো রোহিত-বিরাট সবাইকেই পড়তে হয়। সমালোচনাও হয়। কিন্তু আসমুদ্র হিমাচলের ঘৃণার বিষ ধারণ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা মুখের কথা নয়। বিদ্রুপের খাঁড়ার নিচে দাঁড়িয়ে আইপিএল থেকে বিশ্বকাপের রাস্তাটা পাড়ি দেওয়া কম কঠিন নয়। আসলে হার্দিক পাণ্ডিয়া হওয়াটা সহজ কাজ নয়!