যন্ত্র বনাম মানুষ- এই চিন্তা সমকালের অন্যতম আধুনিক সংকট হলেও, অশনিসংকেত তৈরি করছে এআই বনাম এআই দ্বন্দ্ব।
১৯২০। ‘রোসামোভি ইউনিভার্জালনি রোবোতি’ নাটকের মধ্য দিয়ে, ইংরেজি ভাষার অভিধানে, জায়গা করে নিয়েছিল ‘রোবট’ শব্দটি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তির তড়িৎ অগ্রগতি, মনুষ্য-ক্ষমতার ঊর্ধ্বে গিয়ে উৎপাদনশীলতার প্রাবল্য এবং বুদ্ধিমত্তার কড়াপাক নিয়ে মানুষ সবে আঁচ করছে তার প্রতিপক্ষ আর মানুষ নয়, বরং যন্ত্র। নাটকের চরিত্র রোবোতি-গণ প্রথমে মনুষ্য সমাজের সুবিধার্থে ব্যবহৃত হতে হতে একসময় অতি-ব্যবহারের প্রতিবাদে গর্জে ওঠে এবং মানবসভ্যতার বিনাশ আনে। নাটকের সেই কাল্পনিক আখ্যান বাস্তবিক রঙ্গমঞ্চে ঢুকতে একশতকও লাগেনি, ভোগবাদ ও ধনতন্ত্রর উন্মত্ততায় চাহিদা-জোগানের খেলায় মেতে উঠে যন্ত্রসভ্যতার উন্মেষ এখন আর নতুন খবর নয়।
যন্ত্র এসে মানুষের জীবনকে সুসংহত করবে, সভ্যতাকে ত্বরান্বিত করবে, এমন কথাই ছিল। এমনকী, সেই সময়কার অর্থনীতিবিদরা অবধি মনে করেছিলেন, যন্ত্র কখনও মানুষের কর্মক্ষেত্র গিলে নেবে না। সে সঙ্গী হবে মানুষের। কিন্তু, তা ঘটেনি। ধনতান্ত্রিক বিশ্বে যন্ত্র বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সর্বসাধারণের জন্য হয়নি। মূল্য দিয়ে তার ব্যবহারের নিয়মই হয়েছে, আর স্বাভাবিকভাবেই বৈষম্যর দুনিয়ায় আরও একটি মাত্রা বেড়েছে বৈষম্যর। উপর্যুপরি, যন্ত্র ক্রমশ একের পর এক কর্মক্ষেত্র গ্রাস করেছে তার কর্মনৈপুণ্য ও উৎপাদক্ষমতার মাপকাঠি নিয়ে। একই সঙ্গে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এসে দখল করেছে প্রভুত্বের আসনটিও। আড়ালে-আবডালে মানুষকে সাহায্য করার মধ্য দিয়ে, তার পরিশ্রম কমানোর ছুতোয়, তার ভাবনাপ্রকরণের সময়ে সময়ে দিকবদল করতে সক্ষম হয়ে উঠেছে এআই। কল্পবিজ্ঞানের বহুলচর্চিত ‘এআই আপরাইজ’ বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভ্যুত্থান এখন কেঠো বাস্তব বই কিছু নয়।
[আরও পড়ুন: কাশ্মীরের ‘বিশেষ মর্যাদা’ কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত কি সংবিধানসম্মত?]
কিন্তু, সমকালের চকিতচর্যা আরও বেকুব করে দিয়ে শুরু হয়েছে আরও বৃহত্তর দ্বন্দ্ব, সম্ভবত আরও ভয়ানক। তা হল, ‘এআই’-দের অন্তর্দ্বন্দ্ব। তথ্যপ্রযুক্তির কাছে অনেক আগেই মানুষ পণ্য হয়ে গিয়েছিল, এখন তথ্যপ্রযুক্তির বাজারে কে প্রভুত্ব করবে, সেই লড়াইও বেধে গিয়েছে। চ্যাটজিপিটি, বার্ড চ্যাটবট এবং এমন একাধিক এআই প্ল্যাটফর্ম এতকাল ছিল বিভিন্ন মূল্যের বিনিময়ে লভ্য। এমন পরিসরে, ‘মেটা’ সংস্থা কৃত্রিম বুদ্ধির ময়দানে নামিয়েছে তাদের মুফত এআই মডেল ‘লামা ২’। সে নতুন নতুন স্টার্ট-আপ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনে মানুষকে বিবিধ উপায়ে সাহায্য করেই খুশি, এমনই ‘মেটা’-র বক্তব্য। কিন্তু, পরিবর্তে সে আরও ডিটেলিং গ্রহণ করবে মানুষের। একইসঙ্গে, চাইলে যে কোনও ডেভেলপার নিজের মতো করে শক্তিশালী করে তুলতে পারবে এই মডেলটিকে, কারণ তা ওপেন-সোর্সও।
কথায় আছে, ‘একা রাম হয় না, সুগ্রীব দোসর’। এআই ইতিমধ্যে কর্মক্ষেত্র গ্রাস করে নিয়েছে, তার মধ্যে মুফতের মজায় এই গলাধঃকরণ প্রক্রিয়া আরও গতিপ্রাপ্ত হবে, সন্দেহ নেই। মানুষ আর কত কোণঠাসা হবে?