দেবব্রত মণ্ডল, বারুইপুর: টানা লকডাউনে (Lockdown) এলাকায় কোনও কাজ না পেয়ে পেটের তাগিদে ফের ভিনরাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন বহু পরিযায়ী শ্রমিক। সেরকমই মাস খানেক আগে এক ঠিকাদারের হাত ধরে জীবনতলা থানার ঢুঁড়ি এলাকা থেকে এক পরিযায়ী শ্রমিক সপরিবারে তামিলনাড়ুতে কাজে যায়। অভিযোগ, সেখানে পৌঁছনোর পর বন্দি করে রাখা হয় তাঁদের। জীবনতলা থানার আধিকারিকদের উদ্যোগে তামিলনাড়ু পুলিশ উদ্ধার করল ওই পরিবারকে।
জানা গিয়েছে, ঢুঁড়ি মষিয়ারা হাটের বাসিন্দা ফারুকউদ্দিন লস্কর, তাঁর স্ত্রী মুর্শিদা লস্কর ও দুই মেয়ে ফারজানা-ফারবিনা লস্কর এবং ভাই আমির হোসেনকে নিয়ে কাজের জন্য হাজির হয়েছিলেন তামিলনাড়ুতে। সেখানে ফারুক ও তাঁর ভাই নারকেলের ছোবড়া দিয়ে দড়ি তৈরির কারখানায় কাজ শুরু করেন। অভিযোগ, দৈনিক ৮০০ টাকা দেওয়ার কথা বলা হলেও সেখানে যাওয়ার পর তাঁদের ৩৫০ টাকা করে দেওয়া হত। শুধু তাই নয়, তাঁদেরকে দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করানো হত। প্রতিবাদ করতে গেলে চলতো অত্যাচার। ইতিমধ্যে ওই কারখানায় কাজ করার সময় মেশিনে হাত কেটে বাদ চলে যায় ফারুকউদ্দিনের। স্থানীয় একটি নার্সিংহোমে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করে ঠিকাদার সংস্থা ও কারখানা কর্তৃপক্ষ। সেখানে ফারুকের চিকিৎসা বাবদ প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। অভিযোগ, এই ঘটনার পর ফারুকউদ্দিনকে বলা হয় চিকিৎসা ৩০ হাজার টাকা এবং ঢুঁড়ি থেকে সেখানে কাজে যাওয়ার জন্য বাস ভাড়া বাবদ সমস্ত টাকা পরিশোধ করতে হবে। ওই পরিমান টাকা দেওয়ার ক্ষমতা নেই বলে জানাতেই বন্দি করে রাখা হয় ফারুক ও তাঁর পরিবারকে। বলা হয়, যতদিন না টাকা পরিশোধ হবে ততদিন বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে হবে। বাড়তে থাকে অত্যাচার।
এই পরিস্থিতিতে কারখানা কর্তৃপক্ষ তাঁদের একটি অ্যাকাউন্ট নম্বর দিয়ে বলে, দ্রুত ওই অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিতে হবে। নিরুপায় হয়ে ফারুক বিষয়টি ফোন করে ঢুঁড়িতে পরিবারের সদস্যদের জানান এবং টাকা পাঠানোর কথা বলেন। এই ঘটনার পর তাঁর জামাইবাবু রজবআলি লস্কর জীবনতলা থানায় বিষয়টি জানান। তারপরই শুরু হয় অন্য গল্প। রীতিমতো অসাধ্য সাধন করে পুলিশ। পুরো তদন্তে নেতৃত্ব দেন বারুইপুর পুলিশ জেলার সুপার কামনাশিস সেন এবং জীবনতলা থানার ওসি সমরেশ ঘোষ। কাজটা যতটা সহজ ভাবা হয়েছিল মোটেই তেমনটা ছিল না। ওসি সমরেশ ঘোষ তামিলনাড়ু পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এরপর ফারুকের ফোন নাম্বার জোগাড় করে তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু ভয়ে ফারুক কথা বলতে পারছিলেন না। কোনওরকমে তিনি একটি ঠিকানা বলতে পারলেও দেখা যায় সেটি ভুল। বহু চেষ্টায় পুলিশ ফারুকের প্রেসক্রিপশনটি জোগাড় করে। প্রেসক্রিপশনের সূত্র ধরে পুলিশ জানতে পারে নার্সিংহোমের নাম “দিভিয়া”, ঠিকানা-৩০৬ চেন্নিমালা রোড।
[আরও পড়ুন:রান্নার গ্যাস মজুত করে বেআইনি ব্যবসা, ৯৫টি সিলিন্ডার-সহ ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করল EB]
এরপরই জীবনতলা থানা থেকে তামিলনাড়ুর ত্রিপুর জেলা পুলিশের কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করা হয়। ইতিমধ্যে বারুইপুরের পুলিশ সুপার কামনাশিস সেন সেখানকার পুলিশ সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ত্রিপুর জেলা পুলিশের কন্ট্রোল রুম থেকে তাঁদের জানান হয় জায়গাটা কাঙ্গায়াম থানা এলাকার আন্দুপুতুর মাঞ্জামিল। সেইমতো কাঙ্গায়াম থানার পুলিশ তাঁদের উদ্ধারের জন্য ফারুকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে ভাষাগত সমস্যা তৈরি হয়। এই পরিস্থিতিতে কনফারেন্সে দোভাষীর কাজ করেন জীবনতলা থানার ওসি সমরেশ ঘোষ। এইভাবেই চলে খোঁজ। ওসির নির্দেশ পেয়ে বন্ধ ঘর থেকে কোনও রকমে বাইরে বের হয়ে আসেন ফারুক। তখনই সেখানে পাহারারত এক কর্মী তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করেন। তিনি পুলিশের ফোনটি ওই প্রহরীকে ধরিয়ে দেন। পুলিশের ভয়ে ওই প্রহরী নির্দিষ্ট ঠিকানা বলতে বাধ্য হন। সেইমতো কাঙ্গায়াম থানার পুলিশ নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে যায়। কিন্তু পুলিশ আসার আগের মুহূর্তে ফারুকদের ঘিরে রাখা প্রহরীরা সঙ্গে সঙ্গে অন্য আরেকটি ঘরে বন্দি করে দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও তাঁদের খুঁজে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিল। সেই সময় ফারুক জীবনতলা থানার ওসিকে ফের ফোন করে জানায় তাঁদের পাশের অন্য একটি ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। এরপরই ফারুক উদ্দিন ও তাঁর পরিবারকে উদ্ধার করে কাঙ্গায়াম থানার পুলিশ।
ফারুক উদ্দিন ও তাঁর পরিবারকে জীবনতলার ঢুঁড়ির বাড়িতে ফিরিয়ে আনার জন্য জেলা পুলিশ-প্রশাসন জেলা শ্রম দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেইমতো বুধবার বিকেলে কাঙ্গায়াম থানার পুলিশ তাদের কোয়েম্বাটুর থেকে বাসে তুলে দেয়। বারুইপুর জেলা পুলিশের সুপার কামনাশিস সেন বলেন, “আমার কাছে একটি অভিযোগ আসে তামিলনাড়ুতে ওই এলাকার একটি পরিবারকে আটকে রাখা হয়েছে। সেইমতো সেখানকার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের উদ্ধারের ব্যবস্থা করি।”
[আরও পড়ুন: দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর নিরিখে ফের শীর্ষে কলকাতা, সুস্থতার হারে সামান্য স্বস্তি]
The post পেটের টানে লকডাউনের মাঝেই ভিনরাজ্যে কাজে গিয়ে বন্দি বাংলার শ্রমিক পরিবার, ঘরে ফেরাল পুলিশ appeared first on Sangbad Pratidin.