বিশ্বদীপ দে: অতিমারীর (Pandemic) মেঘ এখনও ঢেকে রেখেছে পৃথিবীকে। এক মারণ ভাইরাস কোথা থেকে হাজির হয়ে মাটিতে বসিয়ে দিয়েছে সভ্যতার রথের চাকা। আর তার জেরে বিপর্যস্ত জনজীবন। লকডাউন আর কোভিড বিধির জাঁতাকলে চেনা স্বাভাবিকতাকে সরিয়ে কার্যত বর্মকে বেছে নিতে হচ্ছে স্রেফ বেঁচে থাকার জন্য। চোখের সামনে ভাসছে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় দেশজুড়ে অক্সিজেনের অভাবে ওঠা নাভিশ্বাস, সারি সারি জ্বলে থাকা চিতার করুণ ছবি। কিন্তু পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক না কেন, এই লড়াই শেষ পর্যন্ত জিতবে মানুষই। অতীতের পৃথিবী খুঁড়ে মেলা ইতিহাসের নানা স্মারক মুহূর্তের দিকে তাকালে এই বিশ্বাস ক্রমেই দৃঢ় হতে থাকে।
গত কয়েক দশকে মহামারী (Epidemic) বা অতিমারীর স্পর্শ বাঁচিয়ে রাখলেও হাজার হাজার বছরের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বারবার আমাদের এই নীল রঙের গ্রহ এমন অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে গিয়েছে। খালি চোখে যাদের দেখা যায় না, সেই আণুবীক্ষণিক জীবরাই ধুন্ধুমার ঘটিয়ে ছেড়েছে। যদিও কমবেশি সাড়ে তিন শতকের আগে পর্যন্ত মানুষের জানা ছিল না মহামারীর আসল ‘ভিলেন’ কারা। অজান্তেই লক্ষ লক্ষ মানুষ রোগের কবলে পড়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন।
মহামারীর ইতিহাসের কার্যত প্রথম অধ্যায়টি রচিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০ থেকে ৪২৬ সালে এথেন্সে (Athens) আছড়ে পড়েছিল প্লেগ (Plague)। এর আগেও হয়তো মহামারীর প্রাদুর্ভাব হয়েছিল কোথাও কোথাও। কিন্তু এথেন্সের এই মহামারীই প্রথম, যার রীতিমতো লিখিত তথ্য ও ভাষ্য পাওয়া যায়। বিখ্যাত গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডুডিস লিখে রেখে গিয়েছেন মহামারীর ‘আঁখে দেখা হাল’। তিনি নিজেও আক্রান্ত হয়েছিল কালান্তক সেই অসুখে।
এথেন্সের এই মহামারীর সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে রয়েছে স্পার্টারও (Sparta) নাম। সেই সময়ই শুরু হয়েছিল পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধ (Peloponnesian War)। গ্রিসের এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে সেই সাংঘাতিক যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরের বছরই প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল মহামারীর। যার ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ৭৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ মানুষ। অর্থাৎ এথেন্সের জনসংখ্যার এক চতুর্থাংশেরই মৃত্যু হয়েছিল। পরে মহামারী ছড়িয়ে পড়েছিল মিশর, ইথিওপিয়া ও অন্যত্রও।
[আরও পড়ুন: বন্যায় বিপর্যস্ত ইউরোপ, জার্মানিতে মৃত কমপক্ষে ৯০]
ঠিক কেমন অবস্থা হত আক্রান্তদের? থুসিডুডিসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, প্রথমেই কপালের তাপমাত্রা বেড়ে যেত। জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে চোখ লাল হয়ে যেত। সঙ্গে জ্বলুনি। জিভ-গলাতেও লালচে ভাব। সঙ্গে বমি-কাশি-পেটের অসুখ। যত সময় যেত ততই ভয়ংকর হত অবস্থা। এমনকী মুখ দিয়ে রক্ত পড়া ও কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলাও। শেষে নিস্তেজ শরীরটার দখল নিত মৃত্যু।
এথেন্সের পক্ষে পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল তা সহজেই অনুমেয়। একদিকে শক্তিশালী অশ্ববাহিনী নিয়ে স্পার্টার আক্রমণ। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে হু হু করে ছড়াতে থাকা মহামারীর সংক্রমণ। স্পার্টার আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে এক দীর্ঘ প্রাচীরের আড়ালে আশ্রয় নিতে হয়েছিল এথেন্সবাসীদের। কেউ ভাবতেও পারেননি অচিরেই তাঁদের জীবনে পা রাখতে চলেছে এমন অসুখ, যার কাছে স্পার্টার সেনাবাহিনীর আক্রোশও কম ঠেকবে। তবে প্রথম প্রথম মনে করা হয়েছিল, এই অসুখও ছড়াচ্ছে স্পার্টার সেনারাই। তারাই শহরের সব জলাশয় বিষিয়ে দিয়ে ডেকে এনেছে রোগটি। পরে অবশ্য রোগের ব্যাপকতা থেকে বোঝা গিয়েছিল, একাজ পরিকল্পনা করে ছড়ানো সৈন্যদের পক্ষে অসম্ভব।
[আরও পড়ুন: তালিবানকে সরাসরি সাহায্য পাক বায়ুসেনার! গুরুতর অভিযোগ আফগান ভাইস-প্রেসিডেন্টের]
কোথা থেকে এসেছিল মহামারীর জীবাণুরা? পিরেস বন্দর থেকে। ওই বন্দরের মাধ্যমেই খাদ্য-সহ সব রকম প্রয়োজনীয় সামগ্রী এসে পৌঁছত। মনে করা হয় ইজিপ্ট থেকে আসা নাবিকরাই এথেন্সে বয়ে এনেছিল প্লেগের জীবাণু। কেননা প্রথম দিকে অসুস্থ হচ্ছিলেন তাঁরাই। পরে ক্রমে তা শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আর দীর্ঘ হতে থাকে মৃত্যুমিছিলের কালো ছায়া।
একদিকে যুদ্ধ। অন্যদিকে মহামারী। এই দুইয়ের ধাক্কায় এথেন্সের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়ে। জীবনযাপনই যেন বদলে যেতে থাকে রাতারাতি। এদিকে ধনী আত্মীয়দের মৃত্যুর পরে দূর সম্পর্কের দরিদ্র আত্মীয়রা সম্পত্তির মালিকানাও পেতে লাগলেন। কোথাও গরিব প্রতিবেশীরাও জোর করে সম্পত্তি দখল করে নিতে লাগল। সব মিলিয়ে আইনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গেল। ঈশ্বর কিংবা রাষ্ট্র কারও অনুশাসনকেই পাত্তা দিচ্ছিল না মানুষ। কেননা মৃত্যু এসে দাঁড়িয়েছে দোরগোড়ায়। যে কোনও সময়ে সে আঘাত হানবে। এই আতঙ্কই বেপরোয়া করে তুলছিল সকলকে। সেই সঙ্গে ছিল স্পার্টার আক্রমণের ধাক্কা। যুদ্ধ অবশ্য অত তাড়াতাড়ি শেষ হয়নি। চলেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪০৪ সাল পর্যন্ত। শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেছিল এথেন্স। তবে তা অনেকটাই পরের কথা। কিন্তু যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় মহামারীর হানাই যে লিখে দিয়ে গিয়েছিল যুদ্ধের ভবিতব্য। কেননা ভিতরে ভিতরে ভেঙে পড়েছিল এথেন্সবাসীর প্রতিরোধ ক্ষমতা।
এথেন্সের এই দীর্ঘকালীন দুর্ভোগ ও মৃত্যুভয়ের ঐতিহাসিক সত্যতা রয়েছে, সেকথা শুরুতেই বলেছি। কিন্তু একটা বিষয়ে সংশয় রয়েছে। কোন অসুখ থেকে ছড়িয়েছিল মহামারী? তা যেন আজও রহস্যে ঢাকা। প্লেগ ছাড়াও অন্য অসুখের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে রোগটা টাইফয়েডও হতে পারে। বিশেষ করে অসুখটা যেহেতু এথেন্স ছাড়িয়ে পাশের শহরগুলিতে ছড়িয়ে পড়েনি। তাই তুলনামূলক কম এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা টাইফয়েডের দিকেই আঙুল তোলে। তাছাড়া কয়েক বছর আগে প্রাচীন গ্রিসে উদ্ধার হওয়া ওই সময়ে মৃত মানুষের দেহাবশেষ থেকে প্রাপ্ত ডিএনএ পরীক্ষা করে তাতে টাইফয়েডের জীবাণু থাকার চিহ্ন মিলেছে। আরও একটা হিসেব বলছে, রোগটা ইবোলা কিংবা ঠিক ওই ধরনের কোনও অসুখও হতে পারে।
কিন্তু থুসিডুডিসের লেখায় যে ‘প্লেগ’ শব্দটাই রয়েছে। পরবর্তী সময়ে পৃথিবীতে বারবার মহামারী সৃষ্টি করেছে প্লেগের জীবাণু। বিশেষ করে চতুর্দশ শতকে ‘কালো মৃত্যু’ হয়ে যেভাবে ভয়াবহ মৃত্যুলীলা চালিয়েছিল প্লেগ, তা মাথায় রাখলে এথেন্সেও এই অসুখ না হওয়ার কী কারণ থাকতে পারে? আসলে থুসিডুডিস যে বর্ণনা দিয়েছেন তা প্লেগের মূল লক্ষণ, বিশেষ করে শেষ পর্যায়ে গলার রং কালো হওয়া বা অন্যান্য লক্ষণের সঙ্গে মেলে না। ফলে আজও রহস্যেই থেকে গিয়েছে পৃথিবীর প্রথম মহামারীর অদৃশ্য খলনায়করা। তবে যে জীবাণুই এই মহামারী ঘটিয়ে থাকুক না কেন, মানুষের ভোগান্তি, দীর্ঘকালীন ট্রমার যে ধারাবাহিক ইতিহাস পরবর্তী সময়ে বারবার লেখা হয়েছে তার সূচনা যে সেই প্রাচীন এথেন্সেই লেখা হয়ে গিয়েছিল, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।