shono
Advertisement
Personal Finance

স্বাস্থ্যবিমার প্রয়োজনীয়তা এবং প্রসারে প্রতিবন্ধকতা, কী জানাচ্ছেন বিমা পর্যবেক্ষক?

স্বাস্থ‌্যবিমার গুরুত্ব যে অপরিসীম, তা নিয়ে দ্বিমত নেই।
Published By: Suchinta Pal ChowdhuryPosted: 09:04 PM Jul 23, 2024Updated: 09:04 PM Jul 23, 2024

স্বাস্থ‌্য পরিষেবার মান আগে যা ছিল, বর্তমানে তা অনেকটাই আলাদা। পরিষেবার উৎকর্ষ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে। এসেছে স্বাস্থ‌্য বিমা। তবে অভিযোগ, এখনও এই ধরনের বিমার চল না কি সমাজের উঁচু স্তরের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ! সকলে এর উপকারিতা পান না। সেক্ষেত্রে কীভাবে এর সুবিধা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, আলোচনা করলেন বিমা পর্যবেক্ষক দেবাশীষ নাথ

Advertisement


স্বাস্থ‌্যবিমার গুরুত্ব যে অপরিসীম, তা নিয়ে দ্বিমত নেই। তবে এর প্রসারে এখনও বেশ কিছু প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। তবে মূল বিষয়ে আলোকপাত করার আগে, প্রথমে আসুন, আমাদের দেশের চিকিৎসা পরিষেবার বিবর্তনের উপর সংক্ষেপে একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক।

শুরু থেকেই অঞ্চল অনুযায়ী এই পরিষেবার মান ছিল ভিন্ন ভিন্ন, যা এখনও আছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে গ্রামীণ চিকিৎসাকেন্দ্র তৈরি হবার আগে হাতুড়ে চিকিৎসকরাই ছিলেন ভরসা। যোগাযোগ ব্যবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে তুলনামূলকভাবে উন্নত জায়গায় প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র বা সমতুল ব্যবস্থা থেকেই সাধারণ মানুষ চিকিৎসার পরিষেবা নিতেন। শহরতলির মানুষেরা ডাক্তারের সুবিধা পেতেন এবং সেই সঙ্গে পেতেন জেলা হাসপাতাল বা সদর হাসপাতালে চিকিৎসার সুবিধা। কিন্তু সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় নানা ধরনের গাফিলতি ও অদক্ষতার কারণে পাশাপাশি গড়ে উঠছিল ছোট ছোট নার্সিংহোমও। এই সব নার্সিংহোমে চিকিৎসার খরচও অনেক বেশি। তবুও সম্পন্ন মানুষেরা পরিচ্ছন্নতা ও সুচিকিৎসার আশায় এখানে ভিড় জমাতে শুরু করেন। আরম্ভ হয় চিকিৎসাক্ষেত্রে ব্যবসা।

সরকারি বড় বড় হাসপাতালগুলো সাধারণত নগরকেন্দ্রিক হওয়ায় দূরবর্তী মানুষদের জন্য তার সুযোগ নেওয়া স্বাভাবিক কারণেই অসুবিধাজনক। তা সত্ত্বেও এইসব হাসপাতালগুলিতে রোগীদের অত্যধিক চাপ ও সেই তুলনায় ডাক্তার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের অপ্রতুলতায় সঠিক পদ্ধতি ও পরিচ্ছন্নতা মেনে চিকিৎসা চালানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠতে থাকে। এবং এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে গড়ে উঠতে থাকে বড় বড় বেসরকারি নার্সিংহোম ও হাসপাতাল। ধনী ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষেরা পরিচ্ছন্ন নার্সিংহোম ও হাসপাতালেই চিকিৎসার সুযোগ নেওয়া পছন্দ করতে থাকেন। ক্রমশ এই চিকিৎসা পরিষেবা হয়ে উঠতে থাকে একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। সম্পন্ন রোগীদের ভাল চিকিৎসা ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশের চাহিদা এই ব্যবসাকে আরও উৎসাহিত করে তুলতে থাকে। ক্রমে নগর ছাড়িয়ে শহর, শহর ছাড়িয়ে শহরতলি, শহরতলি ছাড়িয়ে গ্রামাঞ্চলেও ব্যাঙের ছাতার মত ছড়িয়ে পড়ে ‘নার্সিংহোম'’ নামের প্রতিষ্ঠান।

[আরও পড়ুন: বহুমুখী বিনিয়োগেই সম্ভব অভীষ্ট লক্ষ্যপূরণ, মাথায় রাখুন মাল্টি অ্যাসেটের বিষয়

এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার খরচ অত্যন্ত বেশি এবং তা নির্ভর করে স্থান, সুবিধার মাত্রা ও চিকিৎসার মানের ওপর। সামান্য আয়ের মানুষ তো দূরের কথা, উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির পক্ষেও এই সব জায়গায় চিকিৎসার সুবিধা নেওয়ার সামর্থ‌্য যোগাড় করা নেহাৎ সোজা কথা নয়। আর ঠিক এখানেই বিস্তার লাভ করার পথ পায় স্বাস্থ্যবিমার প্রকল্পগুলো। আজ থেকে মাত্র দুদশক আগেও মেডিক্লেম নামের বিমার কথা সাধারণ মানুষের গোচরে সেভাবে ছিল না, যেভাবে আজ আছে। বাস্তব পরিস্থিতিতে আমাদের মত জনবহুল দেশে রোগীর সংখ্যা আনুপাতিক হারে অনেক বেশি এবং সম্পন্ন মানুষেরা সেরা চিকিৎসা পাওয়ার আশায় খরচবহুল বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমের পরিষেবা নেওয়ার পক্ষপাতী। স্বাস্থ্যবিমা করা থাকলে সেই খরচ বহন করে বিমা সংস্থা। ফলে স্বাস্থ্যবিমার চাহিদার মাত্রা ঊর্ধ্বমুখী। এবং এই কারণেই সমস্ত সাধারণ বিমা সংস্থাগুলি তো বটেই, জীবনবিমা সংস্থাগুলিও স্বাস্থ্যবিমার পসরা নিয়ে সমস্ত সম্পন্ন মানুষের কাছে হাজির হওয়ার জন্য উদগ্রীব।

স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়াম যেহেতু কোনও রকম সঞ্চয়ের মাধ্যম নয়, আবার বিমা নেওয়ার এক বছরের মধ্যে অসুখ-বিসুখ না হলে সেই বিমার সুবিধা পাওয়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। তাছাড়া যে কোনও ছোটখাটো অসুখ বিসুখে যেহেতু এই বিমার কোনও কার্যকারিতা নেই, তাই অসচ্ছল মানুষের এই ধরনের বিমার প্রতি আগ্রহ কম। অর্থনৈতিক কারণেই যাঁরা ব্যয়বহুল উন্নততর চিকিৎসার সুযোগ নিতে অক্ষম, তাঁরা প্রিমিয়াম দিয়ে স্বাস্থ্যবিমার সুযোগও নিতে পারেন না। ফলশ্রুতি হিসেবে স্বাস্থ্যবিমার প্রসার ঘটেছে সমাজের উঁচু তলার মানুষের মধ্যেই। বিমা গ্রাহকদের মধ্যে চিকিৎসার প্রয়োজন ও সেই হারে চিকিৎসার খরচ যত বেশি বহন করতে হবে বিমাসংস্থাগুলিকে, বিমার প্রিমিয়ামও আনুপাতিক হারে বাড়বে।

প্রসার না ঘটার ফলে বিমার দাবি মেটাতে গিয়ে সংস্থাগুলো ক্রমাগত বাড়াতে থেকেছে প্রিমিয়াম। হিসেব বলছে, বিগত পাঁচ বছরে প্রিমিয়ামের হার বেড়েছে কোথাও কোথাও প্রায় দ্বিগুণ। এরপরেও থাকে বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলির নিন্দনীয় দৃষ্টিভঙ্গী। স্বাস্থ্যবিমা আছে জানলেই তাদের চিকিৎসার খরচ যায় বেড়ে! স্বাস্থ্যবিমা নিয়ে সাধারণ বিমাগ্রাহক যাতে সঠিক পরিষেবা পান, বিমাসংস্থাগুলো যাতে গ্রাহকদের সাথে কোনও অন্যায় না করতে পারে ও বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমগুলি যাতে চিকিৎসার অন্যায্য খরচ দাবি না করতে পারে, তার জন্য বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা IRDAI নানা পদক্ষেপ করে আসছে।

[আরও পড়ুন: QIP বাবদ ৮০০ কোটি উপার্জন জুপিটার ওয়াগনসের, হাসি ফুটল লগ্নিকারীদের মুখে

সাম্প্রতিক কালে বিমার সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসার শুরুতে এবং শেষে যাতে দাবি মেটানোর ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপ না হয় সেই মর্মে আইন করেছে নিয়ন্ত্রকসংস্থা। এছাড়াও তুলে দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্যবিমা করার ক্ষেত্রে বয়সের ঊর্ধ্বসীমা। বেশ কিছু জনপ্রিয় স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিমা করানোর উর্ধ্বসীমা ছিল ৭৫ বছর। অর্থাৎ ৭৫ বছর বয়স হয়ে গেলে কারও পক্ষে আর স্বাস্থ্যবিমার ওই প্রকল্পগুলো নেওয়ার সুযোগ ছিল না। বেশি বয়সি মানুষদের ক্ষেত্রে যেহেতু রোগগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তাই বিমাসংস্থাগুলো বয়স্ক মানুষের বিমা করানোয় আগ্রহী ছিল না। কারণ সেক্ষেত্রে চিকিৎসার খরচ মেটানোর পরিমাণ দাঁড়াবে অনেক বেশি। IRDAI এখন সংস্থাগুলোকে বাধ্য করেছে এই ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেবার জন্য। যেহেতু প্রিমিয়াম নির্ভর করে সংস্থার দ্বারা দাবি নিষ্পত্তির পরিমাণের ওপর, তাই দাবির পরিমাণ বেশি হলে প্রিমিয়ামের অঙ্কও দাঁড়াবে বেশি।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন ৮০ বছর বয়স্ক মানুষের জন্য একটি প্রকল্পে ৫ লক্ষ টাকার পলিসিতে বার্ষিক প্রিমিয়াম দিতে হবে ৫৬৭৮৩ টাকা (নিউ ইন্ডিয়া অ্যাসুরেন্সের প্রিমিয়াম, ১৮% জিএসটি-সহ)। একই বিমারাশির জন্য একই ধরণের প্রকল্পে বেসরকারি স্টার হেলথের প্রিমিয়াম হবে ৬২,৭২১ টাকা। কম বয়সিদের ক্ষেত্রে প্রিমিয়াম কিন্তু অনেকটাই কম। যদিও মাত্র বছর চারেক আগে প্রিমিয়ামের অঙ্ক ছিল আরও কম। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০২০ সালে একজন ৪০ বছর বয়সের মানুষের যে প্রকল্পে ৫ লক্ষ বিমারাশির বার্ষিক প্রিমিয়াম ছিল ৭,১২০ টাকা (নিউ ইন্ডিয়া অ্যাসুরেন্সের প্রিমিয়াম, ১৮% জি এস টি সহ), এখন তা বেড়ে হয়েছে ১০,৫৬৩ টাকা। বেসরকারি স্টার হেলথের প্রিমিয়াম বেড়ে হয়েছে ১০,৪৩৭ টাকা।

এখন ভাববার বিষয়, বছরে এতগুলো টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে স্বাস্থ্যবিমা কেনার ক্ষমতা আমাদের দেশে কত শতাংশ মানুষের আছে? একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতের ৭৪% মানুষ প্রয়োজনীয় পূর্ণ আহার পান না। বিশ্ব ক্ষুধা তালিকায় ১২৫ টি দেশের মধ্যে আমাদের স্থান ১১১-তে (২০২৩ সালের পরিসংখ‌্যান)। ব্যয়বহুল চিকিৎসা সামাল দিতে তাঁদের পক্ষে কি হাজার হাজার টাকার প্রিমিয়াম দিয়ে স্বাস্থ্যবিমা নেওয়া সম্ভব? স্বাস্থ্যবিমার জন্য বয়সের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দিয়ে IRDAI যাঁরা জন্য বিমার দ্বার খুলে দিলেন, তাঁরা সকলেই কি এই সুযোগ নেওয়ার মত অর্থনৈতিক অবস্থানে আছেন? অস্বচ্ছল মানুষদের যদি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরিষেবা সরকারি হাসপাতাল থেকে না দিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে যেতে বাধ্য করানো হয় তাহলে প্রিমিয়ামের হার কীভাবে কমানো সম্ভব, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ভাবতে হবে তা-ও। অন্যথায় স্বাস্থ্যবিমা রয়ে যাবে শুধুমাত্র দেশের একেবারে ওপরতলার কয়েক শতাংশ মানুষের জন্যই।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে গ্রামীণ চিকিৎসাকেন্দ্র তৈরি হবার আগে হাতুড়ে চিকিৎসকরাই ছিলেন ভরসা।
  • শহরতলির মানুষেরা ডাক্তারের সুবিধা পেতেন এবং সেই সঙ্গে পেতেন জেলা হাসপাতাল বা সদর হাসপাতালে চিকিৎসার সুবিধা।
  • বেশ কিছু জনপ্রিয় স্বাস্থ্যবিমা প্রকল্পের ক্ষেত্রে বিমা করানোর উর্ধ্বসীমা ছিল ৭৫ বছর।
Advertisement