দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি: সুদূর মুম্বইয়ের ভাইকোল্লা থেকে বাস ভাড়া করে বাড়ি ফেরার পরও চরম সামাজিক হেনস্থার শিকার হুগলির পুরশুড়ার দুই ভাই সুব্রত রাউত ও মিঠুন রাউত। সংসারের অভাব অনটন দূর করতে ২০ বছর আগে কাজের খোঁজে মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিলেন দুই ভাই। মুম্বাইয়ের ভাইকোল্লায় এমব্রোডয়েরির কাজও জুটে যায়। তারপর থেকে ভালই কাটছিল। কিন্তু হঠাৎই করোনা এসে সবকিছু ওলটপালট করে দিল। লকডাউনে দুই মাসেরও বেশি সময় আটকে থাকার পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাসে করে আরামবাগ নামার পর থেকেই শুরু হয়েছে নতুন করে বাঁচার লড়াই। প্রতি মুহূর্তে সামাজিকভাবে চরম হেনস্থার শিকার হচ্ছেন দুই ভাই। রীতিমতো ভয়ে ভয়ে একটা গোটা স্কুল বিল্ডিংয়ের মধ্যে কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন।
সুব্রত রাউত ও মিঠুন জানান তাঁরা লকডাউনের পর অন্তত ছ’বার কখনও ট্রেনে আবার কখনও বাসে করে ফেরার জন্য নির্ধারিত ফর্ম পূরণ করে আবেদন জানিয়েছিলেন স্থানীয় আখরিপাড়া পুলিশ চৌকিতে। প্রত্যেকবারই প্রাইভেট ডাক্তার শারীরিক পরীক্ষার জন্য তাদের কাছ থেকে কখনও ৩০০, কখনও ২০০ টাকা নিয়েছেন। শেষবার তাঁরা নিজেদের জমানো টাকা দিয়ে ৩০ জন ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা দিয়ে বাস ভাড়া করে সোমবার কাকভোরে রওনা দেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাঁরা আরামবাগে পৌঁছানোর পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের পুরশুড়ার শ্রীরামপুর অমূল্য স্মৃতি নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়ে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। এখানে আসার পর থেকেই এক অসম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন দুই ভাই। সুব্রত জানান, ‘পুরো বিদ্যালয়ের বিদ্যুতের লাইন খারাপ। অন্ধকারের মধ্যে চারিদিকে মাকড়সা ও ছেটো ছোটো ব্যাঙের উপদ্রব। পায়খানা বাথরুমের অবস্থা আরও খারাপ। সেখানে পোকা গিজগিজ করছে। সেখানে যে কোনও সুস্থ মানুষই অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’ ভয়ে তারা বেঞ্চ জড়ো করে তার উপর শুচ্ছেন।
[ আরও পড়ুন: গত ২৪ ঘণ্টায় রাজ্যে করোনার বলি সাত, তবে স্বস্তি দিচ্ছে সুস্থ হয়ে ওঠার সংখ্যা ]
বিদ্যালয়ের সামনে বড় শ্মশান। বিদ্যালয়ের চারিদিকে বিষাক্ত পোকামাকড় থেকে সাপের ভয় তাঁদের তাড়া করে বেরাচ্ছে। রীতিমতো দুঃখের সঙ্গে দুই ভাই জানান প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেঁচে থাকার জন্য দু’টো খাওয়ারও ব্যবস্থা করা হয়নি। তাঁদের বৃদ্ধ মা খাবার দিতে এলে পাড়া প্রতিবেশীরা তাঁকে উদ্দেশ্য করে অশ্লীল কটুক্তি করছে। শুধু তাই নয়। স্কুল বিল্ডিং থেকে প্রায় দু’শো মিটার দূরে পাকা রাস্তার উপর মা খাবার রেখে যাচ্ছেন। খাবার রাখার পর দু’শো মিটার দূরে চলে যাওয়ার পর মা তাঁদের ফোনে জানাচ্ছেন খাবার দিয়ে এসেছি। তারপর তাঁরা রাস্তার উপর থেকে সেই খাবার নিয়ে আসছেন। অসহায় দুই ভাই জানান খাবার দিয়ে যাওয়া আর নিয়ে আসার মাঝের সময়ে যদি কোনও কুকুর বা বিড়াল খাবারে মুখ দেয় তাদের কিছুই করার থাকবে না।
তবে প্রতিবেশী মানুষগুলোর ব্যবহারে রীতিমতো মনে দুঃখ পেয়েছেন দুই ভাই। বলছেন, ‘আমরা কি মানুষ নই? যদি আমাদের করোনার সংক্রমণ হয়ে থাকে, তবে প্রশাসন আমাদের যে কোনও করোনা হাসপাতালে রেখে সব ধরণের চিকিৎসা করাক। আমাদের নিজের রাজ্যের মানুষ, প্রশাসন যদি পাশেই না থাকবেন এটা আগে জানতাম তাহলে কখনোই মুম্বাই থেকে ফিরে আসতাম না। তাতে আর যাই হোক অন্তত মুম্বাইতে দশটা মানুষকে পাশে পেতাম।’ এখানে অন্ধকারের মধ্যে বিনা পাহারায় একটা গোটা স্কুল বিল্ডিংয়ের মধ্যে থাকাটাও তাঁদের পক্ষে নিরাপদ নয় বলে দাবি দুই ভাইয়ের। স্থানীয় বিজেপি নেতা গণেশ চক্রবর্তী দুই ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রশাসনের কাছে গণেশবাবুর আবেদন, ‘যদি এই দুই ভাইয়ের করোনা হয় তবে তার চিকিৎসা করান, নতুবা দুই ভাইয়ের প্রতি একটু মানবিক হন। নয়তো মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস থাকবে না।’
[ আরও পড়ুন: উদ্বেগের মাঝে সুখবর, সঞ্জীবন হাসপাতাল থেকে একদিনে মুক্ত ১০১ জন করোনা জয়ী ]
The post কোয়ারেন্টাইনের বিষাক্ত পোকার উপদ্রব, অব্যবস্থার মধ্যেই দিন কাটছে মুম্বই ফেরত দুই যুবকের appeared first on Sangbad Pratidin.