shono
Advertisement

ডিজিটাল লেনদেনে দেশব্যাপী বিপ্লব, তবে নজর রাখতে হবে সরকারকে

‘আনফেয়ার’ ট্রেড প্র‌্যাকটিসেস যাতে না বিঘ্ন ঘটায়, তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।
Posted: 01:45 PM Jul 07, 2022Updated: 01:45 PM Jul 07, 2022

বিপ্লব এনেছে ‘ইউপিআই’। ডিসেম্বর, ২০২১- দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ‘ফোনপে’ এবং ‘জিপে’, যথাক্রমে ৪৭ শতাংশ এবং ৩৪ শতাংশ বাজার নিজেদের কুক্ষিগত করে। গত ছ’মাসে লড়াই আরও জোরদার হয়েছে, তবে একই সঙ্গে চলে এসেছে আরও দুই বৃহৎ, বহুজাগতিক প্লেয়ার- ‘হোয়াটসঅ্যাপ পে’ এবং ‘অ্যামাজন পে’। আপনি মাছ কিনে তৎক্ষণাৎ দাম মিটিয়ে দিতে পারেন জিপে-র মাধ্যমে। মাছবিক্রেতাও মেসেজ দেখে বলতে পারে, ‘পেয়েছি দাদা।’ লিখছেন নীলাঞ্জন দে

Advertisement

 

পনি হয়তো কড়া ধাঁচের মানুষ, পরিসংখ্যান দেখে ঘাবড়ান না, আহ্লাদিতও হন না। তবে ‘ইউনাইটেড পেমেন্টস ইন্টারফেস’ সংক্ষেপে ‘ইউপিআই’ সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্যের আভাস পেলে এহেন মানুষেরও ভুরু কুঁচকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা।

লেনদেনের বাজারে চালু ধারণা তো কবেই পালটেছে। শুধুমাত্র মে মাসেই প্রায় ৬০০ কোটি ট্রানজাকশন হয়েছে এর মাধ্যমে, টাকার অঙ্কে ১০.৪ লক্ষ কোটিরও বেশি। এসব কেজো স্ট্যাটিস্টিক্স যে আগামী দিনে ধূসর স্মৃতি হয়ে থাকবে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বস্তুত, ইউপিআই এবং তার বাড়বাড়ন্ত কোনও নতুন ‘খবর’ নয়, টিকাটিপ্পনি-সহ এই প্রসঙ্গের অবতারণা না করলেও চলে। তবে নেপথ্যে যে-কথাটি জনপরিসরে অনুচ্চারিত, তা হল, পেমেন্টস মার্কেটে দু’-চারটি বিশালাকৃতি কর্পোরেট সংস্থার মাত্রাধিক ক্ষমতা, এবং তাদের দাদাগিরি ফলানোর সম্ভাবনা। অস্বীকার করার জো নেই, এর ফলে ব্যবহারকারী গ্রাহকের স্বার্থ লঙ্ঘিত হতে পারে, ভবিষ্যতে এ নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে। ‘আনফেয়ার’ ট্রেড প্র‌্যাকটিসেস যাতে না বিঘ্ন ঘটায়, তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে।

[আরও পড়ুন: জেনে নিন কীভাবে মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে হতে পারে লক্ষীলাভ]

তবে এসব পরের কথা, আগে দেখি সত্যিই আপনার ভুরু কুঁচকে যায় কি না। ফিরিয়ে নিয়ে যাই আপনাকে ডিসেম্বর, ২০২১ সালে- যখন দেখা গিয়েছিল যে দুই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ‘ফোনপে’ এবং ‘জিপে’, যথাক্রমে ৪৭ শতাংশ এবং ৩৪ শতাংশ বাজার নিজেদের কুক্ষিগত করতে পেরেছে। এই দুই সংস্থার জনপ্রিয়তা নিয়ে আমাদের কারও সন্দেহ থাকতে পারে না। গত ছ’মাসে লড়াই আরও জোরদার হয়েছে, তবে একই সঙ্গে চলে এসেছে আর-দুই বৃহৎ, বহুজাগতিক প্লেয়ার- ‘হোয়াটসঅ্যাপ পে’ এবং ‘অ্যামাজন পে’। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পেমেন্ট বাজার, যেখানে পুরনো ব্যাংকিং ব্যবস্থা চুরমার হয়ে যাচ্ছে ফিনটেক-এর তাড়নায়, নিজেদের হাতের মুঠোয় আনার যুদ্ধ ক্রমেই জমে উঠছে।

এদেশে রিটেল পেমেন্ট এবং সেট্‌লমেন্টের বাজার চলে ‘ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া’-র নিয়মে। ‘রিজার্ভ ব্যাংক’ এবং ‘ইন্ডিয়ান ব্যাংকস অ্যাসোসিয়েশন’ মিলে এই উদ্যোগ; ইলেকট্রনিক পেমেন্টস যাতে যথাযথভাবে হয়, তা দেখাই এর উদ্দেশ্য। ‘ইউনাইটেড পেমেন্টস ইন্টারফেস’ ছাড়াও- ‘রুপে’ এই সংস্থার অন্যতম বড় প্রচেষ্টা। এই শেষোক্ত ‘রুপে’ নামটি বিশেষভাবে বর্তমানে খবরের শিরোনামে, কারণ ব্যাংক নিয়ন্ত্রক তার সর্বশেষ পলিসি ঘোষণায় ‘রুপে ক্রেডিট কার্ড’ জুড়েছে ইউপিআই প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে।

সে যা-ই হোক, এর জন্য স্বল্পসংখ্যক প্লেয়ারদের রমরমা বন্ধ হচ্ছে না। ডিজিটাল পেমেন্টস বাজার এদের জন্যই এখন এত গরম, তা ধরে নেওয়া যায়। মনে রাখতে হবে যে, মার্কেট শেয়ার ‘ক্যাপ’ করার ঘোষিত নীতি থেকে দূরে সরে যাওয়া অনুচিত হবে। সরকার চায় না যে, কোনও বিশেষ সংস্থা একটি নির্দিষ্ট গণ্ডি পেরিয়ে মার্কেট নিজের কুক্ষিগত করে নিক, তাতে কম্পিটিশনের ধ্যানধারণা বিঘ্নিত হয়, কাস্টমারকে কেবল দু’-চারটি সংস্থার পরিষেবা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ঠিক যেমন হয়েছে আমাদের দেশে মোবাইল ফোনের পরিষেবার ক্ষেত্রে। অনেক টানাপোড়েনের পর, বহু ধরনের পরিবর্তনের পর, মোবাইল কমিউনিকেশনের বাজারে অবশিষ্ট যে-কয়েকটি সংস্থা আছে, তারাই সমগ্র সেক্টরটি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই কোনও নতুন প্লেয়ারের আবির্ভাব নেই সেখানে। ফিনানশিয়াল সার্ভিসেস কিন্তু তেমন নয়, বহুদিন ধরে এখানে রিফর্মের ছড়াছড়ি, অনেক নীতিগত পরিবর্তনের সাক্ষী এদেশের ব্যাংক এবং বিভিন্ন ফিনান্স সংস্থা। সবথেকে বড় কথা, এখানে বৃহদাকার সরকারি (এবং বেসরকারিও) সংস্থা প্রবলভাবে উপস্থিত। এত কিছু সত্ত্বেও, পেমেন্টসের বাজারে তাদের কোনও নতুন প্রয়াস নেই। আপনি হয়তো এখানে আমার বক্তব্যকে খণ্ডন করবেন। বলবেন, কেন, সাবেকি ব্যাংকেও তো অ্যাপ-নির্ভর লেনদেন প্রচুর হচ্ছে, জনগণ মনের সুখে ইন্টারনেট ব্যবহার করে নেট ব্যাংকিং করছেন, বেশ বিল মেটানো যাচ্ছে, কেনাকাটা করতেও অসুবিধা নেই। ঠিক, মেনে নিলাম আপনার পয়েন্ট, তবে বলে রাখি, ‘জিপে’ বা ‘ফোনপে’-র সুবিধা, মোবাইল ফোন ব্যবহার করার তাৎক্ষণিকতা, কিন্তু যথেষ্ট ‘ইউনিক’, এবং তার যাথার্থ্য আমরা ইতিমধ্যে বেশ ধরতে পেরেছি। ধরতে পেরেছি বলেই আপনি মাছ কিনে তৎক্ষণাৎ দাম মিটিয়ে দিতে পারেন জিপে-র মাধ্যমে। বা, পাড়ার দোকানে পাঁচ কেজি চাল কিনে আনার সময় ফোনপে ব্যবহার করে পেমেন্টের পাট সেরে নেন। হাসিমুখে আপনার দীর্ঘদিনের পরিচিত চাল ব্যবসায়ী তা গ্রহণ করেন, মোবাইলের মেসেজ পড়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, বলেন, ‘হ্যাঁ, এই তো টাকা এসে গিয়েছে!’

লঘু চালে হয়তো বললাম, কিন্তু বিষয়টি আমাদের মূল প্রসঙ্গের সঙ্গে একান্তভাবে জড়িত। অনেকেই হয়তো আমার কথার সঙ্গে একমত হবেন, পুরনো ব্যাংকগুলো যে কোথাও পিছিয়ে পড়ছে, তা-ও তারা বুঝতে পারবে। এখানে টেনে আনা যাক ফিনানশিয়াল সার্ভিসেস সেক্টরে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা চালানো, এবং বহু নজির সৃষ্টি করা ব্যাঙ্কার উদয় কোটাকের কথা। এক বছরও হয়নি (স্মৃতি থেকে লিখছি) তিনি আক্ষেপ করেছেন, সাবেকি ব্যাংক এই দেশের পেমেন্টস ব্যবসায় পিছিয়ে পড়ছে। তুলনায় এগিয়ে স্রেফ গোটা দুই নতুন কোম্পানি, বাজারের সিংহভাগই তাদের দখলে। কোটাক ব্যাংকের কর্ণধার এরই সঙ্গে অন্য এক প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিলেন- ফিনানশিয়াল স্টেবিলিটি কি এতে কোনওভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে?

আমার মনে হয়, শুনতে বেশ ডিফেন্সিভ হলেও, বিষয়টি অমূলক নয়। তাই একই প্রশ্ন অন্যভাবে করি: বাজার কি মুষ্টিমেয় কয়েকটি গোষ্ঠীর দাস হয়ে পড়বে না? কায়েমি স্বার্থের ভিড়ে কি সাধারণ মানুষের অধিকার হারিয়ে যাবে? উত্তর নিজে খুঁজে নিন, তবে তার আগে মনে রাখুন যে, হাতেগোনা কিছু সংস্থা যে প্রসারিত বাজার মাত করে রাখবে, তা কিন্তু মোটেও কাম্য নয়। ভবিষ্যতে তো পেমেন্টস অনেক বাড়বে, লেনদেনের সংখ্যা এবং টাকার ভলিউম- দুই-ই বৃদ্ধি পাবে, তাই সার্ভিস দিতে চাই বেশি সংখ্যক প্রোভাইডার। তা না-হলে ক্ষমতা ভোগ করতেই থাকবে শুধু কয়েকজন। তাতে বহুজনের হিত হওয়া অসম্ভব। তুলনায় ছোট মাপের বা নতুন সংস্থার চেষ্টা যে জারি নয়, তা কিন্তু নয়। তবে বেশিরভাগেরই দাঁত ফোটাতে দেরি আছে। তাদের প্রয়াসও সেভাবে জনপ্রিয় হয়নি বলে ধরা যায়। কয়েকটি অবশ্য নিজস্ব ক্ষেত্রে যথেষ্ট ওজনদার। ‘পেটিএম’ যেমন, অথবা একেবারে নবাগত ‘টাটা নিউ’ (Tata Neu)- প্রযুক্তি ব্যবহার করে এরাও এগিয়ে যেতে পারবে, আশা করা যায়। একান্তভাবে স্বল্প-নামী দেশজ কোম্পানি, ‘স্লাইস’-এর নামও আজকাল শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে ‘পিকচার অভি বাকি হ্যায়’ গোছের বাণী ছাড়া এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়। কিন্তু এ-কথা বলতেই হবে যে, সাধারণ অন্য পাঁচরকম কনজিউমার মার্কেটে চালু থাকা পদ্ধতিসমূহ এখানেও চটপট চলে- আশার ইঙ্গিত দিয়েই রেখেছে কয়েকটি সংস্থা। ‘হোয়াটসঅ্যাপ পে’ যেমন ক্যাশব্যাকের পন্থায় মাঝে প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টায় ছিল। এবং আমজনতা যে সেই সুযোগ নিচ্ছিল না, তা-ও নয়। আর এখানেই আসে মার্কেটিং ও প্রাসঙ্গিক অন্য বিষয়গুলো।

বলা বাহুল্য, কনজিউমারের জন্য তা ভালই, কারণ সুযোগ-সুবিধা না বাড়লে সাধারণ মানুষ কেন এক ব্যবস্থা ত্যাগ করে অন্য ব্যবস্থা নিতে চাইবে? বলে রাখি, মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম হিসাবে কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ বর্তমানে বিলক্ষণ জনপ্রিয়। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে একথা বলছি।

আমআদমির প্রয়োজন মেটানোর জন্য, দৈনিক লেনদেন থেকে শুরু করে বিনিয়োগে ‘ইউপিআই’ এক অনিবার্য প্রচেষ্টা। তাই কেবল পেমেন্টই নয়, নানাবিধ অন্য দরকারেও এর ব্যবহার বাড়বে বলে ধারণা। যেমন ধরুন, ফোনপে-র সাম্প্রতিক প্রকল্প, ‘গোল্ড সিপ’ (Gold SIP)- যেটি ইউপিআই ব্যবহার করে চালানো সম্ভব। মাসে কেবল একশো টাকা দিয়ে লগ্নি করতে পারেন আপনি। আমার বক্তব্য, এবার আরও প্রাঞ্জল হবে, কারণ ইউপিআই এখন এক দেশব্যাপী বিপ্লব! পেমেন্টস মার্কেট অবশ্যই এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, আর সেজন্যই চাই আরও প্লেয়ার, আরও কম্পিটিশন, আরও গণতান্ত্রিক পন্থা। গোড়ার দিকে বলা ‘এনসিপিআই’ (NCPI) প্রসঙ্গে ফিরে আসি। একটু আগে যে-ঘোষিত নীতির কথা লিখলাম, সেই সূত্রেই বলি যে ‘মার্কেট ডিসরাপশন’ নতুন কিছু নয়। নবাগত সংস্থা বড় গোছের লগ্নি মারফত অনেক দিন ধরে চলা ব্যবস্থা ভেঙেচুরে দিতে পারে। যেমন করেছে ‘উবার’, যেমন দেখেছি ‘সুইগি’-কে করতে। আরও উদাহরণ না-দিয়ে বলি, ডিসরাপশনের প্রাবলে্য খুশি হয় অনেক সংখ্যক গ্রাহক, আবার ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়ার দরুন অসুবিধায় পড়ে তাদেরই একাংশ। প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিপ্রেক্ষিতে নিরন্তর ব্যবসার ধরন পালটে যাচ্ছে, যেমন আগেও যেত। এখন পালটে যাওয়াই যেন জলভাত, তাতে অানফেয়ার ট্রেড প্র‌্যাকটিসেস যদি চলেও আসে, কী-ই বা করার থাকে? এই অমোঘ প্রশ্নের উত্তরে তো অনেক কিছুই বলা চলে, তবে এইটুকু বলি যে, স্বচ্ছ পলিসির প্রয়োগ করতেই হবে, নতুবা গ্রাহকের স্বার্থহানি অবশ্যম্ভাবী।

এই লেখা শুরু করার সময় ভেবেছিলাম, একগুচ্ছ শুকনো স্ট্যাটিসটিক্সের ভার চাপিয়ে পাঠকদের কষ্ট দেব না। সেই ভাবনার ভিত্তিতেই সংক্ষেপে বলি, ভারতের রিটেল ব্যবহারকারীদের ট্র‌্যানজাকশনের সংখ্যা ট্রিলিয়নে গুনতে হবে, সেসবের বহর হবে এমনই। প্রযুক্তির মাহাত্ম্য তো আছেই, সঙ্গে থাকছে গ্রাহকের প্রিয় অভীষ্ট– অতি দ্রুত, অতি সহজে এবং অবশ্যই অতি কম খরচে উচ্চমানের পরিষেবা পাওয়া। কান পাতলে যেখানে শোনা যায়, জনসমুদ্রের কল্লোল, সেখানে পরিষেবা দেবে কতিপয় কয়েকজন? কেন?

[আরও পড়ুন: তীরে এসে তরী যেন না ডোবে, অবসরে সতর্ক থাকুন আর্থিক প্রতিবন্ধকতার ঝুঁকি থেকে]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement