অর্ণব দাস, বারাকপুর: পায়ে পায়ে সময় পেরিয়েছে ৪৬ বছরেরও বেশি। আবছা হলেও মনে আছে, মায়ের সঙ্গে তাঁর দাদু-দিদার ডবল ডেকার বাসে যাতায়াতের কথা। খড়দহ থানার পুরনো বিল্ডিং, বারাকপুরের চিড়িয়ামোড়, একটা চার্চ, তার একটানা লম্বা পাঁচিল। মনে আছে, সেই মাঝ ডিসেম্বরের শীতের সন্ধ্যার কথা। দিনটা ১৯৭৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর। রাতের খাবার রান্না শুরু হবে একটু পরেই। কিন্তু ঘরে একফোঁটা কয়লা নেই। উনুন ধরানোর কাঠকয়লা জোগাড় করতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল পাঁচ বছরের মেয়েটা। এপথ-ওপথ ঘুরতে ঘুরতে কখন যেন চেপে বসেছিল লোকাল ট্রেনে। তারপর... হারিয়ে গিয়েছিল।

পথ হারানো বাচ্চা মেয়েটা এক সহৃদয় অপরিচিত ব্যক্তির হাত ধরে সেই রাতে পৌঁছেছিল খড়দহ থানায়। রাতটা কেটেছিল সেখানেই। পরদিন প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারের হোমে। সেখানে থেকেই টেম্পরি থমাস। দত্তক কন্যা হিসাবে পাড়ি আমেরিকার মিনেসোটায়। একরত্তি সেই মেয়ে টেম্পরি থমাস মার্কিন নাগরিক। সন্তান-সন্ততিতে ভরা সংসার। নিশ্চিন্ত জীবন। কিন্তু গতানুগতিক জীবন মোড় নিল ভারতীয়-অস্ট্রেলিয়ান লেখিকা সারু ব্রিয়ারলির 'আ লং ওয়ে হোম' বইটি পড়ার পর। অস্ট্রেলিয়ান বাবা-মা দত্তক সারু ২৫ বছর পর খুঁজে পেয়েছিলেন জন্মদাতা মা-বাবার সন্ধান। এই গল্পের অনুপ্রেরণায় ২০১৬-য় তৈরি হল গার্থ ডেভিস পরিচালিত 'লায়ন' ছবি।
খড়দহের একরত্তি সেই মেয়ে আজ টেম্পরি থমাস, মার্কিন নাগরিক। নিজস্ব ছবি।
তারপরই শিকড়ের সন্ধানে ভারতে আসা অনুপ্রাণিত টেম্পরির। শনিবার কলকাতায় পা রেখেই সোজা খড়দহ থানায় হাজির। বললেন, "থানায় পিছনের সেই চেনা দরজাটা একই রয়েছে। একটা নলকূপ ছিল। যেখানে আমি মুখ ধুয়েছিলাম।" খড়দহ থানার পুরনো বিল্ডিংয়ে পৌঁছনোর পর পুরনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ে গিয়েছে টেম্পরির। রবিবার দিনভর বিটি রোড ধরে সোদপুর, খড়দহ, বারাকপুর-সহ সংলগ্ন শহরতলি ঘুরেছেন তিনি। গিয়েছেন বারাকপুরের চিড়িয়ামোড়, খড়দহ রেল স্টেশনে। টেম্পরির কথায়, “বাবা একটি বিড়ি কারখানায় কাজ করতেন। মা ছিলেন গৃহবধূ। এক দিদি ও এক দাদা ছিল। আমি ছিলাম সবচেয়ে ছোট।"
নাহ! তার পরও এবার খোঁজ মেলেনি হারানো বাবা-মায়ের। চারদিনের স্মৃতি নিয়ে বুধবার টেম্পরি ফিরে যাচ্ছেন মিনেসোটা। পরের বছর ফের ফিরে আসবেন শিকড়ের খোঁজে। তাঁর কথায়, "অনুভব করেছি যে আমি সত্যিই আমার লক্ষ্যের কাছাকাছি ছিলাম। আমার অনুসন্ধান চালু থাকবে। পরের বছর আবার আসব। প্রয়োজনে গুগল আর্থের সাহায্য নেব।"