shono
Advertisement

চলছে ‘লাল-নীল’অনিশ্চয়তার খেলা, মার্কিন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন নিয়ে উত্তাল দুনিয়া

বিতর্কের মাঝে নির্বাচনের ফলাফলের ফয়সলা হতে পারে আদালতেও।
Posted: 02:58 PM Nov 02, 2020Updated: 03:58 PM Nov 02, 2020

অতনু বিশ্বাস: আচ্ছা, আমাদের ভোটের সিস্টেমটা আমেরিকার (USA)মতো হলে ব্যাপারটা ঠিক কেমন হত? সত্যিকথা বলতে কী, ভোট, ভোটের প্রচার, রাজনৈতিক কার্যকলাপ- অনেক কিছুই বেশ অন্যরকম হত। কারণ, সেদেশের সিস্টেমটা বেশ আলাদা। যেমন একটা অদ্ভুত জিনিস হত, লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে যে দল সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে, তারা রাজ্যের ৪২টা আসনেই জয়ী হবে। আবার, যেদল সবচেয়ে বেশি ভোট পাবে বিহারে, তারা জিতে নিত সে রাজ্যের ৩৯টা আসন। একেবারে রাজ্য ধরে জেতা-হারার খেলা।

Advertisement

[আরও পড়ুন: করোনা মোকাবিলায় পথ দেখাতে পারে থাইল্যান্ড মডেল]

না, আমাদের সিস্টেমটা একেবারেই সেরকম নয়। আমাদের নির্বাচনী সিস্টেমে (Election) লোকসভা কেন্দ্রগুলি একক, আলাদা করে যে-প্রার্থী বেশি ভোট পাবে কোনও কেন্দ্রে, সেই-ই জিতে নেবে সেই কেন্দ্র। তাই পশ্চিমবঙ্গের ৪২টা আসন ভাগ হবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে, বিভিন্ন লোকসভা কেন্দ্রে তাদের রাজনৈতিক প্রভাব অনুসারে।

মার্কিন মুলুকে ভোটের নিয়ম আলাদা। আর, সেই ভোট নিয়ে দুনিয়া উত্তাল এই মুহূর্তে। সে-দেশে ভোটাররা সরাসরি ভোট দেন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে। আর সেইসঙ্গে এক-একটা রাজ্য একসঙ্গে হয়ে ওঠে লাল বা নীল। ‘লাল’ হল রিপাবলিকান দলের রং, আর ‘নীল’ ডেমোক্র্যাটদের। মেইন বা নেব্রাস্কা– এই রাজ্য দু’টি অবশ্য ব্যতিক্রমী। এই রাজ্যগুলিকে আবার ভাগ করা হয়েছে একাধিক ভাগে, যার এক-এক ভাগ নিজেদের মতো করে লাল বা নীল হয়ে উঠতে পারে। সব মিলিয়ে দেশের মানচিত্রটা লাল-নীলের নকশা হয়ে ওঠে, রাজ্য ধরে ধরে। ৫৩৮ আসনের ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’-এ বিভিন্ন রাজ্যের জন্য নির্দিষ্ট আসন অবশ্য অনেকটাই তাদের জনসংখ্যার উপরে নির্ভরশীল। সেই বিচারে এক-এক রাজ্যের গুরুত্ব এক-এক রকমের। আমাদের যেমন সবচেয়ে বেশি লোকসভা আসন উত্তরপ্রদেশে, আমেরিকায় তেমনই ৫৫টি ইলেক্টোরাল আসন নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। তবে, পার্থক্য হল, ক্যালিফোর্নিয়ার ওই ৫৫টি আসন কোনও একটি দল পাবে একসঙ্গে। ওদিকে, আলাস্কা কিংবা ডেলাওয়্যারের মতো রাজ্যের ইলেক্টোরাল ভোট ৩টি করে। মোটের উপর কতটা লাল বা নীল হয়ে ওঠে অনিশ্চিত রাজ্য বা ‘সুইং স্টেট’গুলি, তার ভিত্তিতেই ঠিক হবে হোয়াইট হাউসের পরের চার বছরের মালিকানা।

অনেকগুলি ওপিনিয়ন পোল হয়। ‘ফাইভথার্টিএইট’-এর মতো সমীক্ষার সমষ্টিবিদ সংস্থা আবার বিভিন্ন প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষার গড় নিয়ে পূর্বাভাস করে। ওপিনিয়ন পোলগুলির মধ্য থেকে খুব সম্প্রতি করা কয়েকটি সমীক্ষাকে এরা বেছে নিয়েছে সমীক্ষার প্রভাব, পদ্ধতি এবং নমুনা-সংখ্যার ভিত্তিতে। এগুলির গড়কে দেওয়া হয় প্রায় ৯০ শতাংশের কাছাকাছি গুরুত্ব, আর জনবিন্যাস এবং আগেকার ভোটিং প্যাটার্নে দেওয়া হয় বাকি গুরুত্ব। এভাবেই অনুমান করা হয়েছে নির্বাচনের ফলে কোন রাজ্যের লাল হওয়ার সম্ভাবনা কতটা, কতটাই বা সম্ভাবনা নীল হওয়ার। রাজ্য-ভিত্তিক এই লাল-নীলের খেলায় কোনও রাজ্যে এগিয়ে রিপাবলিকানরা, তো কোথাও আবার ডেমোক্র্যাটরা। তাই এই রাজ্যগুলির রং কী হবে, সে একেবারে নিশ্চিত। যেমন, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়াতে রিপাবলিকানরা এগিয়ে আছে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোটে। তাই এই রাজ্য যে ভোটের ফলে লালই থাকবে, এবং এ-রাজ্যের ৫টি ইলেক্টোরাল ভোট যে ট্রাম্পের একেবারে বাঁধা, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ওদিকে আবার নিউ ইয়র্কে ডেমোক্র্যাটরা এগিয়ে আছে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোটে। এই রাজ্য তাই নীল, এখানকার ২৯টি ইলেক্টোরাল ভোটই যে বিডেনের ঝোলাতে যাচ্ছে– সে একেবারে নিশ্চিত।

স্বাভাবিকভাবেই এসব রাজ্যে ভোটের প্রচারের উত্তাপও বিশেষ থাকার কথা নয়। ভোটের সমস্ত উত্তাপ জড়ো হয় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের রাজ্যগুলিতে। যেখানে দুই দলের সমর্থনের পার্থক্য ভীষণ কম, ভোটের পরে রাজ্যের রং ‘লাল’ হবে না ‘নীল’, তা একান্তই অনিশ্চিত। যেমন, আইওয়া কিংবা ওহাইয়ো রাজ্যে ট্রাম্প এগিয়ে থাকলেও ভোট শতাংশের পার্থক্য একের কম। জর্জিয়াতে বিডেন এগিয়ে আছেন এক শতাংশ ভোটে, ফ্লোরিডা কিংবা নর্থ ক্যারোলিনার মতো রাজ্যে দুই শতাংশ ভোটে, আর অ্যারিজোনাতে ৩ শতাংশ ভোটে। পেনসিলভেনিয়ার মতো ভীষণরকমের গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে বিডেন এগিয়ে ৫ শতাংশ ভোটে। যে কোনও নির্বাচনী লড়াইয়ে এই সামান্য পার্থক্য ঘুচে যেতে পারে একচুটকিতে। একটা দমকা হাওয়াই যথেষ্ট তার জন্য। নিজের এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলিতে ভোট ধরে রেখে ভোটের দিন জর্জিয়া, ফ্লোরিডা, নর্থ ক্যারোলিনা, অ্যারিজোনা আর পেনসিলভেনিয়ার এই ভোট-পার্থক্য যদি মুছে দিতে পারেন ট্রাম্প, তাহলে কিন্তু তাঁর ইলেক্টোরাল ভোট ২৭০ ছাড়াবে, আর পরের চার বছর হোয়াইট হাউস থাকবে তাঁরই দখলে। তাই দেশজোড়া পপুলার ভোটে বিডেন যতই ১০-১২ শতাংশ এগিয়ে থাকুন, লড়াইটা ততটাও একপেশে নয়। লড়াইটা শেষও হয়ে যায়নি।

এমনিতে এবারের লড়াইটা স্পষ্টতই ব্যতিক্রমী। শতাব্দীর ভয়ংকরতম অতিমারীতে বিপর্যস্ত দুনিয়া। মারাত্মকভাবে প্রভাবিত আমেরিকাও। তার প্রেক্ষিতে এই ভোটটাও হতে চলেছে নজিরবিহীন। বিপুল সংখ্যক মানুষ কিন্তু ইতিমধ্যেই ভোট দিয়ে ফেলেছেন ‘আর্লি ভোটিং’-এর মাধ্যমে।

পোল এগ্রিগেটর ‘ফাইভথার্টিএইট’ কম্পিউটারে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিকে ‘সিমুলেশন’ করেছে ৪০,০০০ বার। অর্থাৎ, রাজ্যে রাজ্যে ভোটের শতাংশের প্রেক্ষিতে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে ভোটের পরিস্থিতি। গড় নেওয়া হয়েছে তার। আর, এই নিবন্ধ লেখার সময় সেখানে ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনা মাত্র ১১ শতাংশ। তাদের গড় হিসাব, ট্রাম্প পাবেন ১৯১টি ইলেক্টোরাল ভোট। বিডেন ৩৪৭টি। তাই পাল্লা যে বিডেনের দিকেই ভারী, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কিনা, গড় দিয়েই তো আর সব কথা বলা যায় না। নির্বাচন হল অনিশ্চয়তার খেলা। আর আমেরিকার ইলেক্টোরাল কলেজ, জনসমর্থনের কাঠামো, দেশটার মিশ্র জনগোষ্ঠী, বেড়ে ওঠা সামাজিক দ্বন্দ্ব– সবই এই নির্বাচনী সংঘাতে উত্তাপ জোগায়। অনিশ্চয়তার ফলশ্রুতিতে লড়াইটা তাই জারি থাকছে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

[আরও পড়ুন: করোনা মোকাবিলায় পথ দেখাতে পারে থাইল্যান্ড মডেল]

ভুললে চলবে না, ২০১৬-তে দেশজোড়া পপুলার ভোটে ২ শতাংশ ভোট কম পেয়েও হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে ৭৭টি ইলেক্টোরাল ভোট বেশি পেয়েছিলেন ট্রাম্প। আর এছাড়াও ইলেক্টোরাল কলেজে ফল খুব কাছাকাছি হলে নির্বাচনের ফলাফলের ফয়সলা হতে পারে আদালতেও। ২০০০ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছিলেন এমনই এক ৩৬ দিনব্যাপী আইনি লড়াইয়ের পরে। আর এক প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডেমোক্র্যাট আল গোর-কে হারিয়ে। এবারে ‘আর্লি ভোটিং’ নিয়ে যে-পরিমাণ তরজা চলছে এখনই, তার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত ট্রাম্প। এমনকী, এ নিয়ে আদালতে শরণাপন্ন হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে ইতিমধ্যেই। অনেকে কিন্তু জটিল আইনি লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখছেন ভোট হয়ে যাওয়ার পরে। কে বলতে পারে, নভেম্বরের ৩ তারিখ হয়তো সূত্রপাত হতে পারে নতুন আইনি সংঘাতেরও। সব মিলিয়ে ২০২০-র মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়তো তৈরি করতে পারে আরেক ‘হযবরল’-র জগৎ। না, ভুল বললাম। আর এক ‘কভফিফে’-র দুনিয়া। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই হয়তো সেই দুনিয়ার স্রষ্টা।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক আইএসআই কলকাতা-র অধ্যাপক
appubabale@gmail.com

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement