গত ৯ ডিসেম্বর অরুণাচল প্রদেশের ইয়াংসেতে কেন এমন ঘটাল চিন? কোভিড মোকাবিলায় যখন চিন ব্যতিব্যস্ত, তখন ভারতের ভূখণ্ডে ঢুকে সেনা অভিযানের কী প্রয়োজন তা ঠাহর করা যাচ্ছে না। কেন গালওয়ান মডেলের পুনরাবৃত্তি? কলমে জয়ন্ত ঘোষাল
চিনে এখন প্রত্যেক দিন কোভিডে আক্রান্ত হচ্ছে ১০ লাখ মানুষ। ৫,০০০ জনের মৃত্যু হয়েছে সম্প্রতি। সে-দেশে খুব দ্রুত এই ভাইরাস আবার ছড়াচ্ছে। এবং এখনও চিনের বহু মানুষ কোভিড ভ্যাকসিন নেয়নি। চিনে এমন মারাত্মকভাবে কোভিড ছড়িয়ে পড়ার কারণ?
বলা হচ্ছে, এই ভাইরাস প্রতিরোধে সেদেশে সেভাবে লকডাউন হয়নি। প্রতিরোধমূলক কোনও ব্যবস্থাই সেভাবে গ্রহণ করা হয়নি। চিনের উৎপাদন ব্যবসা-শিল্পায়ন যাতে ব্যাহত না হয়, তার জন্য রাষ্ট্রীয় নীতি-ই হল কোভিড ভাইরাস প্রতিরোধে ব্যবস্থাগ্রহণ বাধ্যতামূলক না করা। এর আগেরবার যখন প্রথম ঢেউয়ে কোভিড বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল, তখনও চিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে, কোভিড ভাইরাসের প্রকৃত গর্ভগৃহ হল বেজিং। চিনের বাদুড় থেকে এই ভাইরাসের জন্ম- এমন প্রচারও হয়। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তো সরাসরি অভিযোগও হানেন চিনের বিরুদ্ধে। চিন অবশ্য সে অভিযোগ অস্বীকার করে।
এবার ২০২২ সালের শেষে আবার চিনে কোভিড প্রকোপ ভারত-সহ গোটা বিশ্বে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ‘জিরো-কোভিড’ নীতি ঘোষণা করেছিলেন।
[আরও পড়ুন: শূন্য শুধু শূন্য নয়, এ-ফোর রেভোলিউশনের সাক্ষী চিন]
সমগ্র পৃথিবীর চাপ এসে পড়েছিল তাঁর উপর। এখন দেখা যাচ্ছে, শি জিনপিংয়ের (Xi Jinping)) সেই জিরো-কোভিড নীতিও সাংঘাতিকভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত। ভারত চিনের এই পরিস্থিতির প্রতি কড়া নজর রেখেছে। কোনওভাবেই যাতে চিন থেকে এই ভাইরাস ভারতে আঘাত হানতে না পারে সে ব্যাপারে নজর রাখা হচ্ছে। নানা স্তর থেকে দাবি উঠছে, চিন থেকে ভারতে বিমান পরিষেবা বন্ধ করা হোক।
চিনের আর্থিক বৃদ্ধি এ বছর জোর ধাক্কা খাচ্ছে। সংকট খুব বাড়ছে। কিছুদিন আগে পার্টি কংগ্রেসে প্রস্তাব গ্রহণ করে সংবিধান বদল করে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নিজের কার্যকালের মেয়াদ আরও একটা টার্ম বাড়িয়ে নিয়েছেন। অভূতপূর্বভাবে নিজের টার্ম বাড়িয়ে নেওয়ার পর, প্রতিবাদে দেশে বিক্ষোভ দেখা গিয়েছে। চিনের মতো স্বৈরতন্ত্রী দেশে এই বিক্ষোভও তো অভূতপূর্ব! সাধারণত চিনে বিক্ষোভ হলেও তা বাইরে প্রকাশ পায় না। নানা সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে তা চিনের ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করে বিশ্বের অন্য প্রান্তেও সে খবর কী করে এবার ছড়িয়ে পড়ল সে-ও এক বিস্ময়।
এতরকম ঝামেলায় যখন চিন ব্যতিব্যস্ত, তখন ভারতের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে সেনা অভিযানই বা কেন? দিল্লিতে বহু কূটনীতিকের প্রশ্ন, চিন চাইছে কী? গালওয়ানের পুনরাবৃত্তি কেন হল তাওয়াংয়ে? গত ৯ ডিসেম্বর যখন দেশে কোভিড ভাইরাস মারাত্মকভাবে ছড়াচ্ছে, তখন ভারতের অরুণাচল প্রদেশের ইয়াংসেতে কেন এমন ঘটাল চিন?
২০২০-র জুনে ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষের সমতুল্য এ ঘটনা। প্রায় ৪০০ চিনা সেনা একপাক্ষিকভাবে অরুণাচল সেক্টরে ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’-র স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত করতে চেয়েছিল। সংসদে কেন্দ্র জানিয়েছে, ভারতীয় সেনা দৃঢ়তার সঙ্গে সেই আক্রমণ রুখেছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং স্বীকার করেছেন যে, চিনা সেনা ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল। মুখোমুখি সংঘাতে দু’পক্ষেরই কিছু সেনা আহত হয়েছেন তবে, কারও প্রাণহানি ঘটেনি। নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারতীয় ভূখণ্ডে চিনা আগ্রাসনের যে বিরতি নেই এই সংঘাত তো তারই প্রমাণ।কিন্তু কেন? কেন বেজিং নিজের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান না করে এ কাজ করছে? চিন নিয়ন্ত্রণরেখাকে কি আরও পশ্চিম দিকে ঠেলে দিতে চাইছে? সীমান্ত-সংকট নিরসনে কার্যকর আলোচনাতেও তারা উৎসাহী নয়।
ভুলে গেলে চলবে না, এর আগে কোভিড (COVID-19) যখন তুঙ্গে, সে সময় চিন গালওয়ানে সংঘাতের পথে যায়। শি জিনপিংয়ের প্রশাসন নতুন ভাইরাসের মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য প্রবলভাবে সমালোচিত হয়। তাই চিন কী চাইছে তা নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না।
সাউথ ব্লকের এক কূটনীতিক বলছিলেন, চিনের এই সাম্প্রতিক আগ্রাসন অনুপ্রবেশ আমাদের সেনাবাহিনীর কাছে নতুন কোনও ঘটনা নয়। ফি-বছর চিন এটা করেই থাকে। কারণ একটাই। তাওয়াং এলাকা যে আসলে তাদেরই, চিন নিজেদের সেই ধারণাকে ভারত-সহ বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। চিনা সেনা যদি সীমা লঙ্ঘন না করে, তাহলে এই বিতর্ককে কীভাবে তারা জিইয়ে রাখবে? তবে এবার তাওয়াংয়ে কোনও পক্ষেরই কোনও মৃতু্য না হওয়ায় মার্কিন ও পাশ্চাত্যের মিডিয়াতে এই সংঘাত সেভাবে গুরুত্ব পায়নি।
কিছুদিন আগে নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে ভারত-মার্কিন যৌথ সেনা মহড়া হয়েছিল। ঠিক তারপরই তাওয়াংয়ের সংঘর্ষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই দু’টি ঘটনার মধে্য একটা সংযোগ আছে। চিনা সেনাবাহিনীর এই অনুপ্রবেশকে কাকতালীয় বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। যেসব রাষ্ট্রের সঙ্গে বেজিংয়ের স্থলসীমা বা সমুদ্রপথে সংঘাত আছে, তারা কেউই আগ্রাসী কৌশল থেকে ছাড় পায় না। জাপানের কথা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। জাপান পূর্ব চিন সাগরে তাদের সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে বেজিংয়ের সঙ্গে বিরোধে সাংঘাতিকভাবে সক্রিয়। ওই দ্বীপপুঞ্জ ঘিরে চিনা নৌ ও বিমানবাহিনীও জাপানকে নানাভাবে প্রতিনিয়ত হয়রান করে চলেছে। সেক্ষেত্রে টোকিও কী করছে? টোকিও নিজের সমুদ্র অঞ্চলে জমির অবস্থান নিয়ে কঠিন ও কঠোর। নয়াদিল্লিকেও এই একই রণকৌশল অবলম্বন করতে হবে। চিনকে কখনওই বিশ্বাস করা যাবে না।
৯ ডিসেম্বরের চিনা আগ্রাসনের ঘটনা ভারতের কাছে ‘নিও নর্মাল’ ঘটনা। নতুনত্ব আছে বলে ভারতের বিদেশমন্ত্রক মনে করছে না। ভারত ও চিনের সীমান্ত বিবাদ মেটানোর জন্য ২৫ রাউন্ড আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ভারতের সংসদে সরকারের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে চিনা সেনা ৪০০ বার সীমান্ত অতিক্রম করে ভিতরে ঢুকেছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে ৬০০ বার ঢুকেছে তারা। ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালে পশ্চিম সেক্টরে সীমা লঙ্ঘন করেও কিন্তু ২০১৪ সালে শি জিনপিংয়ের ভারত সফরের সময় লাদাখে চিনা সেনা আগ্রাসন চালায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেই সফরেই শি জিনপিংকে সে তথ্য জানাতে বাধ্য হন। তিন বছর পর নাট্যমঞ্চ হয়ে যায় ডোকলাম। ২০২০ সালে এপ্রিল মাসে লাদাখ ও গালওয়ানে চিনের আক্রমণ ছিল সবচেয়ে কদর্য। এটিও পশ্চিম সেক্টরে। ’৮৭ সাল থেকে এ ধরনের সীমালঙ্ঘন হয়েই চলেছে নিয়মিত। এবার নতুনত্ব হল চিনের নাট্যমঞ্চ অরুণাচল প্রদেশ।
১৯৬২ সালে মাও জে দংয়ের কাছ থেকে ‘সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশন’ নির্দেশ পায় যে, ভারতকে আক্রমণ করতে হবে। চৌ এনলাই ভারতে আসেন এই পরিকল্পিত আক্রমণের ঠিক এক সপ্তাহ আগে। তিনি নেহরুকে বলেছিলেন, যুদ্ধের কোনও প্রশ্নই উঠছে না। দেশে ফিরে গিয়ে চৌ এনলাই মাওকে নেহরুর ‘পঞ্চশীল নীতি’-র প্রতি আস্থার কথা জানান। মাও চৌ এনলাই-কে বলেন, “আপনি নেহরুকে জানান চিন ও ভারত ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’-এর বদলে ‘সশস্ত্র, সহাবস্থান’-এ থাকা অভ্যাস করুক।” ১৯৯৩ সালে নরসিমা রাও বেজিংয়ে গিয়ে সীমান্ত শান্তিচুক্তি করেন প্রথমবারের জন্য। তখন থেকে বারবার সীমান্ত শান্তিচুক্তি হয়ে এসেছে, কিন্তু আজও সুরাহা হল না। কখনওই চিন নিয়ন্ত্রণরেখাকে সংজ্ঞায়িত করতে রাজি হয়নি।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জি-২০ সম্মেলন হবে। এই সম্মেলনে শি জিনপিংয়ের আসার কথা। বিদেশ মন্ত্রককে চিন জানিয়েছে শি জিনপিং আসবেন। জি-২০’র পাশাপাশি ‘সাংহাই কো-অপারেশনও’-এরও বৈঠক হবে ২০২৩-এ। তাতেও তো চিনের আসার কথা। দুটো সম্মেলনেই শি-জিনপিং নাও আসতে পারেন। হতে পারে সাংহাই বৈঠকে তিনি প্রধানমন্ত্রী বা বিদেশমন্ত্রীকে পাঠাবেন।
জি-২০ সম্মেলনে ভারতের অধিনায়কত্বকে লঘু করার জন্যই কি এই চিনা আগ্রাসন? সাউথ ব্লক বলছে, সে তো অনেক দিন বাকি। এখন এত তাড়াতাড়ি কেন? দু’টি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে এই যুদ্ধর দামামা কি এক চূড়ান্ত অশুভ লক্ষণ নয়? বিশেষত যখন ইউক্রেন-রুশ সংঘাতকে কেন্দ্র করে এক নতুন ঠান্ডাযুদ্ধের শঙ্কা বিশ্বজুড়ে। বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। তখন সভ্যতার এ এক নতুন সংকট। কোভিড দমন না করে যুদ্ধের হুমকি?
এর ফলে ভারত আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে নতুন নতুন যুদ্ধাস্ত্র আমেরিকা কাছ থেকে কেনার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। রাশিয়ার কাছ থেকে নেওয়া অস্ত্রভাণ্ডারের মান যথেষ্ট খারাপ- এ অভিযোগ উঠছে। প্রস্তুত থাকা সভ্যতা, মানছি। যুদ্ধের জন্যও প্রস্তুত থাকা আবশ্যক। কিন্তু চিনের সঙ্গে আলোচনার পথে এই জট ছাড়ানোর চেষ্টা এখনও শ্রেষ্ঠ সমাধান বলেই মনে করি।
ভারত ও চিনের সেনা কোর কমান্ডারদের ১৭তম সীমান্ত আলোচনা যে এর মধ্যে হল, তা আশার কথা। দু’-পক্ষ যৌথ অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে যে, সীমান্তে দু’-পক্ষ স্থিতাবস্থা আর নিরাপত্তা বজায় রাখবে। কিন্তু চুসুল-মলডো সীমান্তে আলোচনায় বিরোধ মেটেনি। অনেকে বলছে, ভারত কেন আক্রমণাত্মক হচ্ছে না! চিনকে রক্তচক্ষু দেখানো কি উচিত কাজ হবে? আমার কিন্তু মনে হয়, আলোচনাই সমাধানের একমাত্র ও শ্রেষ্ঠ পথ। যুদ্ধ রসিকতার বিষয় নয়!
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক
redhat.jayanta@gmail.com