বিশ্বদীপ দে: এডওয়ার্ড বুলার্ড। বিখ্যাত ব্রিটিশ ভূ-পদার্থবিদ। তাঁর একটি বক্তব্য দিয়ে এই লেখা শুরু করা যেতে পারে। তিনি ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে লিখেছিলেন, 'পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ ঘিরে রেখেছে সমুদ্র। এবং চাঁদের আকার সম্পর্কে যা জানা যায় তার চেয়ে অনেক কম আমরা জানি সমুদ্রের তলদেশ সম্পর্কে।' আসলে মাথার উপরে যে অনন্তবিস্তারী মহাকাশ, তার চেয়েও মানুষের কাছে যেন বেশি রহস্যময় সমুদ্রের গভীর তলদেশ। আর এবার সেখানেই নজরদারি শুরু করেছে নাসা! বলা হচ্ছে ডেডলাইন মাত্র দুমাসের (যার অনেকটা অংশ কেটেও গিয়েছে)। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগছে, কেন এই দ্রুততা? কী হবে দুমাস পরে? নাসার বিজ্ঞানীরা কি কিছু আশঙ্কা করছেন?
প্রথমেই আশ্বস্ত করা যাক, তেমন কিছু নয়। পৃথিবীর জন্য কোনও দুঃসংবাদ লুকিয়ে নেই সমুদ্রের গভীরে। আসলে নাসা 'সমুদ্রমন্থন' করতে চাইছে একটাই কারণে। মহাবিশ্বে প্রাণের স্বরূপ খোঁজাই তাদের আসল উদ্দেশ্য। বহুদিন ধরে যে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হচ্ছে, এবার হয়তো তার কোনও সুস্পষ্ট উত্তরের সন্ধান মিলতেই পারে। কীভাবে? সেকথায় আসার আগে নাসার সমুদ্র অভিযানের বিষয়টি স্পষ্ট করে দেওয়া যাক। ফ্লোরিডার সৈকতের কাছেই রয়েছে বিশ্বের একমাত্র 'আন্ডারওয়াটার ল্যাব' অ্যাকোয়ারিয়াস রিফ বেস। প্রতি বছরই নাসা সেখানে কয়েকজন গবেষক ও নভোচরকে পাঠায়। এখানে চলছে প্রোজেক্ট নিমো (নাসা'জ এক্সট্রিম এনভায়রনমেন্ট মিশন অপারেশনস)। এই নভোচরদের একটা বিশেষ নামও রয়েছে- অ্যাকোয়ানটস। যাই হোক, নাসার একটা স্বয়ংচালিত যানও রয়েছে যেটি সমুদ্রে গভীরতাতেও দিব্যি চলাচল করতে পারে। যার নাম 'অর্ফিয়ুস'। আর এর সাহায্যেই এখন সমুদ্রপৃষ্ঠের ১০ কিমিরও বেশি গভীরে নেমে গবেষণা চালাচ্ছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। এমনিতে সমুদ্রের গভীরে লুকিয়ে থাকা রহস্য সমাধানে আমেরিকার 'ন্যাশনাল ওশিয়ানিক অ্যান্ড অ্যাটমস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন' তথা নোয়া নামের এক সংস্থা রয়েছে। কিন্তু এই অভিযানে নাসাই শামিল হয়েছে, কেননা সমুদ্রের গভীরে লুকিয়ে থাকা রহস্যের অন্দরে আসলে মহাকাশকেই খুঁজছে নাসা। আর সেজন্য রীতিমতো কঠিন চ্যালেঞ্জ সামলাতে হচ্ছে। কতটা কঠিন?
একটা পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। জলজ প্রাণীদের ৯০ শতাংশ প্রজাতিই থাকে এপিপেলাজিক জোন তথা দ্য সানলাইট জোনে। কেননা যতই গভীরে যাওয়া হবে ততই চাপ বাড়তে থাকবে। ১০ মিটার অন্তর ১ অ্যাটমস্ফিয়ার প্রেশার বাড়ে। ১ অ্যাটমস্ফিয়ার প্রেশার মানে আমাদের পৃথিবীতে যে বায়ুমণ্ডলের চাপ সেটা। অর্থাৎ সমুদ্রগর্ভে যতই নিচে নামা যাবে, ১০ মিটারে সেই চাপ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এভাবে ক্রমেই বাড়তে থাকবে। আর নাসা নামছে সমুদ্রের গভীরে ৬ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১১ হাজার মিটার পর্যন্ত অঞ্চলে। যার পোশাকি নাম 'দ্য হেডাল জোন' (জলের গ্রিক দেবতা হেডাসের অনুসরণে এই নামকরণ)। এখানেই পৃথিবীতে প্রাণের প্রথম সঞ্চার হয়েছিল। এই অঞ্চলে রয়েছে নানা প্রতিকূলতা। চাপের কথা তো বলাই হল। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে হাইড্রোথার্মাল ভেন্টস। এগুলো হল জলের নিচের আগ্নেয়গিরি। যা মাটির উপরের আগ্নেয়গিরির মতোই অগ্ন্যুৎপাত ঘটায়। যার ধাক্কায় সমুদ্রের তলদেশের তাপমাত্রা ৪০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যায়। এই সব প্রতিকূলতাকে সামলেই অভিযান চালাচ্ছে নাসা। কিন্তু কেন?
এপ্রসঙ্গে বলা যাক নাসার ইউরোপা ক্লিপার মিশনের কথা। সৌরজগতের কোনও গ্রহে যে প্রাণ থাকা সম্ভব নয়, সেব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত বিজ্ঞানীরা। একমাত্র মঙ্গল নিয়ে কিছুটা আশা ছিল। কিন্তু সেখানে মোটামুটি খতিয়ে দেখা হয়ে গিয়েছে। মেলেনি কোনও সবুজ সংকেত। আপাতত মহাকাশবিজ্ঞানীদের নজর বিভিন্ন গ্রহের উপগ্রহের দিকে। আর যে উপগ্রহটির দিকে সবচেয়ে বেশি নজর তার নাম ইউরোপা। মাত্র কয়েকদিন আগে, ১৪ অক্টোবর মহাকাশে পাড়ি দিয়েছে ইউরোপা ক্লিপার। যাত্রাপথে রয়েছে ২.৯ বিলিয়ন কিমি! ২০৩০ সালের এপ্রিলে সেটি বৃহস্পতিতে পৌঁছবে। তার পর নামবে ইউরোপায়। ২ থেকে ২০ মিটার পুরু বরফের স্তর রয়েছে ইউরোপার উপরে। তার নিচে রয়েছে সমুদ্র। যে সমুদ্র নোনা জলের। এমনটাই জানা গিয়েছে এখনও পর্যন্ত। ফলে সেই সমুদ্রের তলদেশেই মিলতে পারে প্রাণের অনুকূল পরিবেশের সন্ধান! মিলে যেতে পারে প্রাণের খোঁজও। এক ক্রায়োবট বরফের স্তর খনন করে সমুদ্রে নামবে এবং ৪৮টি মাইক্রো রোবট মিলে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াবে সেই অপার্থিব সমুদ্রের তলদেশ। মনে রাখতে হবে, ইউরোপা ক্লিপারই কোনও গ্রহ বা উপগ্রহকে পর্যবেক্ষণের জন্য নাসার তৈরি বৃহত্তম মহাকাশযান। ফলে এই অভিযানকে নাসা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে সেটা এখান থেকেই বোঝা যায়।
সেই কারণেই মাস দুয়েকের একটা ডেডলাইন ধরে সমুদ্রের তলদেশেও অনুসন্ধান চালাচ্ছে নাসা। যার বেশ অনেকটা সময়কালই পেরিয়ে এসেছে। এই সময়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে সমুদ্রের তলদেশের আশ্চর্য জগৎকে। খুঁটিয়ে। আসলে প্রাণের জন্য অনুকূল বলে মানুষ যা ভেবে এসেছে, সেটাই একমাত্র শর্ত কিনা তা নিয়ে সংশয় দীর্ঘদিনের। কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এর অন্যথা হতেই পারে। কেননা ব্রহ্মাণ্ডের অনন্ত বিস্তারে পৃথিবীই জীবিত প্রাণীর একমাত্র ঠিকানা, এই বিষয়টা সত্যিই অবিশ্বাস্য মনে হয়। তাই প্রাণের স্বরূপকে বুঝে নিয়ে ভিনগ্রহে তার সন্ধান করতে চাইছে নাসা। আর এই মুহূর্তে তাদের নজর ইউরোপার দিকে। মিলবে কি সেখানকার সমুদ্রের তলায় প্রাণের খোঁজ? উত্তরটা পেতে কয়েক বছর অপেক্ষা করতেই হবে।