বিশ্বদীপ দে: বাবা রামদেব (Baba Ramdev)। অ্যালোপ্যাথি (Allopathy) সম্পর্কে তাঁর হালফিলের মন্তব্যই বিতর্ক উসকে দিয়েছে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শাখা সম্পর্কে। স্বভাবতই প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ দেশের বহু চিকিৎসক। যদিও এই বিতর্কের সাম্প্রতিকতম আপডেট হল, যোগগুরু ভোলবদল করেছেন। জানিয়ে দিয়েছেন, ডাক্তাররা ‘ঈশ্বরের দূত’। তাতে বিতর্ক কতটা ধামাচাপা পড়বে সেটা আগামী দিনে দেখা যাবে। কিন্তু অ্যালোপ্যাথি সম্পর্কে তাঁর এহেন মন্তব্যে বহু ইতিহাস সচেতন মানুষের মনে উঁকি দিয়ে গিয়েছে অ্যালোপ্যাথির ইতিহাস। আরও ভাল ভাবে বললে ‘অ্যালোপ্যাথি’ র নামকরণের কথা।
নামকরণের বহু আগে থেকেই এই চিকিৎসা পদ্ধতির অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু ১৮১০ সালের আগে তাকে অ্যালোপ্যাথি নামে কেউ ডাকেনি। সেই ইতিহাসও ভীষণ অদ্ভুত। কে করেছিলেন এই নামকরণ? ভদ্রলোকের নাম ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান (Dr. Samuel Hahnemann)। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। হোমিওপ্যাথির (Homeopathy) জনক। সেই তিনিই কিন্তু নামকরণ করেছিলেন অ্যালোপ্যাথির। এটা দু’টি গ্রিক শব্দের সমষ্টি। ‘অ্যালো’ অর্থাৎ অন্য। ‘প্যাথি’ কথাটা এসেছে ভোগান্তি (Suffering) বা রোগ অর্থে। দুইয়ে মিলে অ্যালোপ্যাথি। কিন্তু হোমিওপ্যাথির জনক হঠাৎ অন্য এক চিকিৎসা পদ্ধতির নাম দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কেন? তা জানতে গেলে একবার হ্যানিম্যানের জীবনকথা জানতে হবে।
[আরও পড়ুন: নাসার চন্দ্রাভিযানে বড় দায়িত্বে ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার, কোয়াম্বাটুরের কন্যাকে নিয়ে গর্বিত দেশ]
১৭৫৫ সালে জার্মানির (Germany) স্যাক্সনি প্রদেশের মেইসেন শহরে জন্ম তাঁর। চিত্রশিল্পী বাবার ছেলে হ্যানিম্যানেরও নানা ভাষায় আগ্রহ ছিল। কিন্তু সেসব ফেলে তিনি ডাক্তারি পড়া শুরু করেন। ১৭৭৯ সালে ডাক্তারি পাশ করে প্র্যাকটিসও শুরু করেন। কিন্তু সেই আমলের চিকিৎসা পদ্ধতি তাঁকে মোটেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আসলে সেই যুগে, অর্থাৎ যখন ‘অ্যালোপ্যাথি’ নামকরণও হয়নি, তখন এই চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল বেশ খানিকটা ‘আসুরিক’! সেই আমলে মূলত রোগীর রোগলক্ষণের বিপরীত ক্রিয়া করার মতো ওষুধ প্রয়োগ বা রুগীর রক্তপাত ঘটানোই ছিল চিকিৎসার চেহারা। এতে যে বেশ ঝুঁকি ছিল, তা স্পষ্টতই বোঝা যায়। এই কারণে হ্যানিম্যানের সহ্য হয়নি এমন চিকিৎসা পদ্ধতি।
আত্মজীবনীতে তিনি এ সম্পর্কে ক্ষোভ উগরে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর নিজেকে কার্যত অচেনা রোগীদের ‘খুনি’ বলে মনে হচ্ছিল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, প্র্যাকটিস বন্ধ করে রসায়নের চর্চা ও বই লেখা, অনুবাদ এসবেই তিনি নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে শুরু করেন।
আসলে এই সময় থেকেই তিনি এক বিকল্প পথের সন্ধান করতে শুরু করেন। ১৮০৭ সালে তাঁর লেখা একটি প্রবন্ধে ‘হোমিওপ্যাথি’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন হ্যানিম্যান। এবং তার সূত্র ধরে তথাকথিত মূলধারাকে চিহ্নিত করতে তাঁর প্রয়োজন হয়ে পড়ে বিপরীতার্থক কোনও শব্দ বা শব্দবন্ধের। আর এখান থেকেই জন্ম নেয় ‘অ্যালোপ্যাথি’। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে নামকরণ পরে হলেও অ্যালোপ্যাথি বলতে আমরা যা বুঝি তার আদি রূপ আরও আগে থেকেই ছিল। মোটামুটি ভাবে ধরে নেওয়া হয়, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিসের যে প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি, সেটাই ছিল অ্যালোপ্যাথির উৎস।
[আরও পড়ুন: মিলল ডাইনোসরদের নতুন এক প্রজাতির সন্ধান! বিস্মিত বিজ্ঞানীরা]
সেই সময় থেকে নিয়ে হ্যানিম্যানের আমলে এসে ‘অ্যালোপ্যাথি’ নামকরণ। এবং তারপরেও দুই শতাব্দী পেরিয়ে আসা। আজকের দিনে ‘অ্যালোপ্যাথি’ শব্দটা ক্রমেই সেকেলে হয়ে পড়ছে। এখন বরং ‘মডার্ন মেডিসিন’ (modern medicine) বলাই শ্রেয়। তেমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বছর দুয়েক আগে কোঝিকোড়ে এক বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির সেমিনারে এই কথা বলতে শোনা গিয়েছিল যোগদানকারী ডা. কেকে বিক্রমণকে। তিনি অ্যালোপ্যাথি নামটাতেই আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাঁর সাফ কথা ছিল, সেই কোন আমলে হ্যানিম্যান হোমিওপ্যাথির বিপরীতে বসাতে যে নাম দিয়েছিলেন কেন এখনও তা বয়ে বেড়াতে হবে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রকে বোঝাতে? সম্মেলনের বাকি চিকিৎসকরাও তাঁর সঙ্গে একমত হয়েছিলেন। তাঁদের সকলেরই মত ছিল, আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র পুরোপুরি ভাবে প্রমাণ-নির্ভর এক চিকিৎসা পদ্ধতি। সেই দিকে তাকিয়ে ‘অ্যালোপ্যাথি’ শব্দটি নিতান্তই সেকেলে।
আসলে এই দু’শো বছরে অ্যালোপ্যাথি অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে। আমাদের দেশ, যেখানে কয়েক হাজার বছর ধরে আয়ুর্বেদেরই জয়জয়কার সেখানে অ্যালোপ্যাথির প্রবেশ খুব সহজ ছিল না। শাসক ইংরেজরাও সেটা বুঝেছিল। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে শেষে ১৭৯৬ সালে গুটিবসন্তের টিকা ছবিটা বদলে দিতে শুরু করছিল। তার আগে গুটিবসন্ত অনেকের প্রাণ কাড়লেও টিকা এসে পড়ার পরে দেখা গেল মুক্তি মিলেছে মারণ ভাইরাসের হাত থেকে। সেই শুরু। যাই হোক। তারপরও অনেক পথ পেরিয়ে এসে নিজের চেহারা-চরিত্রও বদলে ফেলেছে অ্যালোপ্যাথি।
একসময় অ্যালোপ্যাথির চিকিৎসা পদ্ধতিতে ভয় পেতেন মানুষ। কাটাকুটি ও রক্তারক্তির ভয়াবহতায় ডাক্তারদের থেকে কার্যত ছুটে পালাতে হত ভয়ে। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সেই ভয়ও অর্থহীন হয়ে গিয়েছে। ‘ইমেজ’ বদলে ক্রমশ আরও উজ্জ্বল হয়েছে ‘ত্রাতা’ ভাবমূর্তি। প্রতিটি চিকিৎসা পদ্ধতিরই নিজস্ব গতিবিধি রয়েছে। তবে ‘অ্যালোপ্যাথি’ তথা ‘মডার্ন মেডিসিন’-এ গবেষণা যে হারে ব্যাপক ও বিস্তৃত রূপ ধারণ করেছে, সেটাই তার শ্রেষ্ঠত্বের আসল কারণ। যার খুব বড় প্রমাণ আমরা এই সময়ে দাঁড়িয়ে হাতেনাতে পেয়েছি। চিনের (China) ইউহান শহর থেকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে অতিমারী সৃষ্টি করেছে কোভিড-১৯ (COVID-19)। সেই রোগের টিকা আবিষ্কার হোক কিংবা ‘কোভিড যোদ্ধা’ হয়ে বিপণ্ণ রোগীর শুশ্রুষা— আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির যে কোনও বিকল্প নেই, তা প্রমাণিত।
একটা পরিসংখ্যান বলছে, ২০০০ থেকে ২০৩০— এই সময়কালে সারা বিশ্বে ৭ কোটি মানুষকে ১০টি প্রাণঘাতী অসুখের হাত থেকে বাঁচাচ্ছে ও বাঁচাবে অ্যালোপ্যাথি। বার্ষিক হিসেবে অন্তত ২০ লক্ষ মানুষ মৃত্যুকে এড়াতে পারেন অ্যালোপ্যাথির দৌলতে। এ এক অনিবার্য সত্যি। যে কারণে অ্যালোপ্যাথিকে ‘স্টুপিড’ বলা রামদেবকেও শেষমেশ মেনে নিতে হয়, ‘‘আপৎকালীন চিকিৎসা ও শল্য চিকিৎসায় অ্যালোপ্যাথিই সেরা। এই নিয়ে কোনও দ্বিমত থাকতে পারে না।’’