যে মিডিয়া ২০১২ সালে জ্যোতি সিংয়ের সময় গর্জে ওঠা বিক্ষোভকে শ্বাসরোধী শক্তি দিয়ে ‘কভার’ করেছিল, বিলকিস বানো-র ক্ষেত্রে তারা বেশিরভাগই চুপ। উচ্চমাত্রার প্রাইমটাইম বিতর্ক, কোনও আলোড়ন সৃষ্টিকারী সম্পাদকীয় বা বিলকিসের ন্যায়বিচারের দাবিতে ক্যাম্পেন- কিছুই চোখে পড়ছে না তেমন! লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই
যে শিরোনাম দিয়ে লেখার শুরু, তা ‘শোলে’ সিনেমায় অভিনেতা এ. কে. হাঙ্গলের চরিত্রের বলা বিখ্যাত সংলাপ। গুজরাট সরকারের একটি কমিটির দাক্ষিণ্যে বিলকিস বানো-র গণধর্ষণকারী এবং তাঁর পরিবারের সদস্য ও শিশু-কন্যার খুনিদের যাবজ্জীবন সাজা মকুব হওয়ার পর ও সেই অপরাধীরা সাড়ম্বরে সম্মানিত হওয়ার পর এই প্রশ্নটাই ছুড়ে দিতে ইচ্ছা করে। কোথাও কোনও মোমবাতি মিছিল নেই, কোনও ধরনা নেই, রাস্তাঘাটে প্রতিবাদ নেই বিলকিসের জন্য বিচার চেয়ে। এক দশক আগে জ্যোতি সিংয়ের (নির্ভয়া) গণধর্ষণ ও খুনের পর দেশজুড়ে যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল, সেই আলোড়নের ছিটেফোঁটাও দেখতে পাওয়া গেল না। পরিবর্তে একটি স্পষ্ট নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে ক্ষমতার অলিগলি এবং সুশীল সমাজের অন্দরে, যে সম্মিলিত ক্ষোভ ২০১২ সালের শীতকালে ভয়ংকরভাবে অনুরণিত হয়েছিল, তা এখন কোথায়?
শুরু করা যাক শীর্ষ নেতৃত্ব দিয়েই। ১৫ আগস্ট, দেশ যখন ৭৫তম স্বাধীনতা দিবসের পূর্তি উদ্যাপন করছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন ‘নারীশক্তি’ নিয়ে গালভরা বক্তব্য রাখছেন, দেশকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, মহিলাদের অসম্মান করে কোনও দেশ এগিয়ে যেতে পারে না, তার কয়েক ঘণ্টা পরেই বিলকিস বানো-র অভিযুক্ত ধর্ষকরা গুজরাট জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গেল। এবং গোধরার ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ’ তাদের গলায় মালা পরিয়ে বরণ করল এমনভাবে, যেন তারা দেশনায়ক! দোষীদের কারও অনুশোচনার লেশমাত্র নেই, এমনকী, পর্যালোচনা কমিটির এক বিজেপি বিধায়ক ধর্ষকদের ভূয়সী প্রশংসা করলেন ‘সংস্কারী’ ব্রাহ্মণ হওয়ার জন্য। মোদি সরকার এ-বিষয়ে কোনও মন্তব্য না করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, হয় ক্ষমতার ঔদ্ধত্যে আটকে রয়েছে তারা, নয়তো বা সময়ের কাঁটা ২০০২-এ ফেরায় তারা কিঞ্চিৎ বিব্রত।
[আরও পড়ুন: শীতঘুমে কংগ্রেস, বিরোধী পরিসর দখলের দ্বৈরথে কি কেজরি-নীতীশ?]
কোনও প্রবীণ মন্ত্রী বা ক্ষমতাশালী বিজেপির মুখপাত্র এ-বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাননি। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র প্যাটেল বা সে-রাজ্যের কোনও বিজেপি নেতার তরফে একচিলতে উচ্চারণ নেই। এমনকী, দেশের নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানিও নির্বাক, সাধারণত তাঁর কথার ভাঁড়ারে টান পড়ে না। ‘জাতীয় মহিলা কমিশন’, অর্থাৎ এনসিডব্লিউ-র কোনও বিবৃতি নেই, যারা এই মাসের শুরুতেই কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর একটি বোকা ভুলের জন্য সশব্দে ফেটে পড়েছিল, যখন তিনি ভুলভাবে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে ‘রাষ্ট্র-পত্নী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। স্পষ্টতই ধর্ষকদের গলায় মালা পরানোর দৃশ্যটি সরকারি সংগঠনকে ততটা বিব্রত করতে পারেনি। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি) এখনও পর্যন্ত একটিই মিটিং ডেকেছিল এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার জন্য, কিন্তু তারা এখনও জমসমক্ষে কোনও বিবৃতি দেয়নি। এই সংগঠনের চেয়ারপার্সন, শীর্ষ আদালতের প্রাক্তন বিচারপতি প্রধানমন্ত্রীকে ‘বহুমুখী প্রতিভা’-র সম্মানে ভূষিত করেছেন।
সর্বভারতীয় প্রধান জাতীয় দলগুলির মধ্যে, শুধুমাত্র কংগ্রেস এবং বামেরা বিলকিসের রায় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। যদিও বামেরা প্রান্তিক শক্তি, কিন্তু কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া, যা কিনা এমন পরিস্থিতিতে প্রশংসনীয়, সেই প্রতিক্রিয়া গান্ধীনগরের তুলনায় দিল্লিতে অনেক বেশি সোচ্চার। কিন্তু আম আদমি পার্টি, যারা ২০১২ সালের বিক্ষোভের সময় নাগরিক সমাজের সক্রিয়তার প্রথম সারিতে থাকা দল, তাদের এই প্রকট নীরবতার কী অর্থ? তারপর দশ বছর কেটে গিয়েছে। ‘আপ’ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী থেকে মূলধারার রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে, তাদের দৃঢ় নজর এখন গুজরাটের হিন্দু মধ্যবিত্ত ভোটের দিকে।
যে শীর্ষ আদালত জ্যোতি সিং মামলায় দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেছে, তারাও এবার ‘সেফ’ খেলেছে: এই বছরের মে মাসে একটি অদ্ভুত আদেশ দিয়েছে আদালত। ১৯৯২ সালের একটি প্রাচীন নথির উপর ভিত্তি করে সাজা মকুবের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য গুজরাট সরকারের বিবেচনার উপর ছেড়ে দেয়। ১৯৯২-এর এই নথি ২০১৪ সালের ধর্ষণ-সংক্রান্ত নীতির তুলনায় বেশি পদ্ধতিমাফিক। ২০১৪-এর নীতি স্পষ্টভাবে অভিযুক্ত ধর্ষকদের ক্ষমা নিষিদ্ধ করে। যে মিডিয়া ২০১২ সালে জ্যোতি সিংয়ের সময় গর্জে ওঠা বিক্ষোভকে শ্বাসরোধী শক্তি দিয়ে কভার করেছিল, বিলকিসের ক্ষেত্রে তারা বেশিরভাগই চুপ করে থাকার রাস্তাই বেছে নিয়েছে। উচ্চমাত্রার প্রাইম টাইম বিতর্ক, আলোড়ন সৃষ্টিকারী সম্পাদকীয় বা বিলকিসের ন্যায়বিচারের দাবিতে কোনও ক্যাম্পেন তেমন চোখে পড়ল না।
সেই সুশীল সমাজ কোথায় গেল, বিশেষ করে শহুরে মধ্যবিত্তরা, যারা এক দশক আগে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে তাদের অন্তর্নিহিত উদাসীনতাকে ঝেড়ে ফেলেছিল? গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় গণধর্ষণ এবং ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত পাশবিকতা দেশের রাজধানীতে চলন্ত বাসে গণধর্ষণে গর্জে ওঠা ‘সম্মিলিত বিবেক’-কে (কালেকটিভ কনশাসনেস) নাড়া দেয় বলে মনে হয় না। যেন ২০০২ সালে রাধিকপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে সেদিন যা ঘটেছিল, তা এখনকার ‘নতুন’ ভারতের স্মৃতিকোষ্ঠ থেকে অনেক দূরে। পিটিশনে সই করে ‘প্রতীকী’ প্রতিবাদ-ই যেন সর্বোত্তম প্রতিবাদ বলে মনে হচ্ছে।
এক অর্থে, জ্যোতি সিংয়ের ট্র্যাজেডি এবং ন্যায়বিচারের জন্য বিলকিসের অবিরাম অনুসন্ধানে রাষ্ট্র এবং নাগরিক সমাজের এই যে বিপরীত প্রতিক্রিয়া, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, গত দশকে রাষ্ট্র এবং নাগরিক সমাজ- উভয়ই কতটা বদলে গিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী রাজনীতির উত্থান এমন যে কোনও ভিন্ন স্বরকে কার্যকরভাবে নিঃশেষ করে দিয়েছে, যা ক্ষমতাসীনের প্রভাবশালী আখ্যানকে চ্যালেঞ্জ করতে পারত। যে কোনও নির্বাচনী সুবিধার জন্য হিন্দু পরিচয়কে সুসংহত ও দৃঢ় করতে হবে, এই বিশ্বাসটি এতটাই গেঁথে গিয়েছে যে, রাজনৈতিক নীতিবোধ সেখানে মরে যাচ্ছে ভোটব্যাংকের রাজনীতির কাছে। আটের দশকে, রাজীব গান্ধী সরকার এক মুসলিম নারীর সমানাধিকারের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছিল মুসলিম ধর্মযাজকদের খুশি করতে গিয়ে। শাহ বানো-র মামলা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ প্রকল্পকে দুর্বল করে দিয়েছিল এবং বিজেপিকে রাজনৈতিক দরজায় পদক্ষেপের সুযোগ করে দিয়েছিল। এখন, সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে। বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠ তোষণের রাজনীতির নকশা তৈরিই হয়েছে নির্বাচনী আধিপত্যকে স্থায়ী করার জন্য, আর তার মূল্য চোকাতে হচ্ছে আর-এক মুসলিম মহিলার ন্যায়বিচারের জন্য নিরলস লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে।
তদুপরি, অপরাধের শিকার হওয়া মানুষদের সহায়তা প্রদানের জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেগুলিকে মারাত্মকভাবে আপস করতে হচ্ছে এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য। গুজরাট সরকারের পর্যালোচনা কমিটি এখন একচেটিয়াভাবে দলীয় স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে, এই কমিটিতে দু’জন বর্তমান বিজেপি বিধায়ক রয়েছেন। কিন্তু প্রতিবাদী ও বিচলিত বিলকিসের ন্যায্য শুনানি পাওয়ার সম্ভাবনা সেখানে কম-ই। রাজীব গান্ধীর হত্যাকারীদের সঙ্গে জড়িত ২০১৬ সালের শ্রীহরণ মামলার একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ ইঙ্গিত দিয়েছে যে, সাজা মকুব বা সাজা কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতি বাধ্যতামূলক- সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক হর্তাকর্তারা কি এই অপরাধ থেকে রেহাই পাবেন? সত্যিটা হল যে, এমন নমনীয় আমলাতন্ত্র, এমন দুর্বল বিচারব্যবস্থা এবং একটি চিয়ারলিডিং মিডিয়া কার্যত অসম্ভব করে তুলেছে কার্যনির্বাহী ক্ষমতার অবাধ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করার প্রক্রিয়াকে।
কেন এত প্রভাবশালী নাগরিক ২০১২ সালের স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহে যোগ দিয়ে, আজ তার বিপরীতে গিয়ে ‘জাস্টিস ফর বিলকিস’ ক্যাম্পেনে তাদের কণ্ঠ মেলাতে এত ভয় পাচ্ছে? এখানেই বদলে যাওয়া নৈতিক পরাকাষ্ঠার চেহারাটা খোলতাই হয়ে যাচ্ছে। এমন এক বিভক্ত সমাজের ছবি সামনে ধরা পড়ছে, যার ন্যায়বিচারের ধারণাগুলি ক্রমাগত গভীর কুসংস্কার এবং সম্পূর্ণ গোঁড়ামির দৃষ্টিতে প্রতিভাত হচ্ছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি সাম্প্রদায়িক মোড় না এনে বিলকিসের দুর্দশাকে শনাক্ত করতে অক্ষম, যেখানে একজন মুসলিম মহিলা হিসাবে তাঁর পরিচয় ছাপিয়ে যাচ্ছে সঙ্গে জড়িত অপরাধের নিছক অমানবিকতাকে।
‘যখন একজন হিন্দু মহিলাকে ধর্ষণ এবং নির্যাতন করা হয়, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?’- সোশ্যাল মিডিয়ায় ডানপন্থী ইন্টারনেট সেনারা প্রায়শই এই কথাটা জিজ্ঞাসা করে থাকে। যখন ২০১২ সালের বিক্ষুব্ধ সমাজের আদর্শবাদী উচ্ছ্বাস ২০২২ সালে এসে একটি উদ্দেশ্যমূলক ‘হোয়াটঅ্যাবাউট্রি’-তে পালটে যায়, তখন মনের মেরুকরণ আরও প্রকট হয়ে ওঠে। আশঙ্কার ব্যাপার এটাই যে, বিলকিসেই ব্যাপারটা শেষ হয়ে যাচ্ছে না।
পুনশ্চ: এক তরুণ ‘মিলেনিয়াল’ সহকর্মী আমাকে পরামর্শ দেয় যে, ২০২২ সালের হিংস্রতা আর বিলকিসের মামলা নিয়ে চিন্তাভাবনা এবার বন্ধ করা উচিত আমার। ‘২০ বছর হয়ে গিয়েছে, এবার সময় এসেছে এটা ভুলে যাওয়ার’- এই ছিল তার অযাচিত উপদেশ। শুধু সেই সহকর্মী যদি এই কথাটাই বিলকিসের চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারত!