সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ফের এক গৃহযুদ্ধ। ফের পতন সরকারের। গত ১৩ বছর ধরে গৃহযুদ্ধের আগুনে জ্বলছিল সিরিয়া। কড়া হাতে সেই বিদ্রোহ দমন করার সব রকম চেষ্টা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। কিন্তু অবশেষে হারতে মানতে বাধ্য হয় তাঁর বাহিনী। গত ১৩ বছরে যা হয়নি সেটাই হল। মাত্র ১৩ দিনেই আসাদের থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিল বিদ্রোহীরা। যাদের মাথায় রয়েছে আল কায়দার শাখা সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। কোন সমীকরণে গুঁড়িয়ে গেল আসাদ সাম্রাজ্য?
বাশারের আগে ১৯৭১ সাল থেকে সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট ছিলেন তাঁর বাবা হাফেজ আল-আসাদ। ২০০০ সালে বাবার মৃত্যু হলে দেশটির প্রেসিডেন্ট হন বাশার। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ বছর ধরে পশ্চিম এশিয়ার এই দেশটির ক্ষমতার রাশ ধরে রেখেছিল আসাদ পরিবার। কিন্তু জলঘোলা হতে শুরু করে ২০১১ সালে। আরব বসন্তের হাওয়ায় উত্তাল হয়ে ওঠে মরুপ্রদেশটি। আকাশ বাতাস কেঁপে ওঠে একনায়ক হঠাও, গণতন্ত্র ফেরাও স্লোগানে। শুরু হয়ে যায় গৃহযুদ্ধ। আসাদকে গদিচ্যুত করতে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিদ্রোহীদের যৌথমঞ্চ ‘সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস’ (এসডিএফ)। কুর্দ বাহিনী পিপলস প্রোটেকশন ইউনিটের (ওয়াইপিজি) নেতৃত্বে আরম্ভ হয় এক অসম যুদ্ধ। লড়াইয়ে বিদ্রোহীদের সাহায্য করতে শুরু করে আমেরিকা। পাশাপাশি আসাদের হয়ে আসরে নামে ইরানের মদতপুষ্ট হেজবোল্লা, রাশিয়া।
২০১১ থেকে শুরু হওয়া এই গৃহযুদ্ধে প্রাণ ঝরেছে বহু মানুষের। ২০১৩ সালে বিদ্রোহীদের দমনে আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে গুটায় রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে। প্রাণ যায় ছোট ছোট শিশু-সহ হাজার হাজার মানুষের। যা নিয়ে রাষ্ট্রসংঘের তোপের মুখে পড়ে আসাদ সরকার। কিন্তু এভাবেই জারি ছিল লড়াই। যা তীব্র আকার ধারণ করে চলতি বছরের নভেম্বরে। গত ২৭ তারিখ আসাদ বাহিনীর হয়ে লড়তে অস্বীকার করে হেজবোল্লা। সেদিনই সিরিয়ার অন্যতম প্রধান শহর আলেপ্পোর একটা বড় অংশ দখল করে নেয় বিদ্রোহীরা। পরের দিন সরকারি বাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করে ইদলিব প্রদেশে ঢুকে পড়ে তারা।
এভাবেই একের পর এক শহরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে এইচটিএসের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীরা। ৩০ তারিখ গোটা আলেপ্পো দখল করে নেওয়ার ঘোষণা করে তারা। হামলায় ক্ষতবিক্ষত হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম শহর। ১ ডিসেম্বর পালটা আঘাত হানে আসাদ বাহিনী। তারা ইদলিব এবং আলেপ্পোতে আকাশপথে হামলা চালায়। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। এর পর ২ থেকে ৬ ডিসেম্বর একে একে হোমস, দারা, হামার দখল নেয় বন্দুকধারীরা। ৭ ডিসেম্বর রাজধানী দামাস্কাসের দরজায় কড়া নাড়ে বিদ্রোহী বাহিনী। কিন্তু সেখানে তীব্র লড়াই করে সেনা। সহজে হার মানতে রাজি হয়নি তারা। কিন্তু ৮ ডিসেম্বর অর্থাৎ রবিবার ভোরে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় আসাদ বাহিনী। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম দেখাতে শুরু করে, সিরিয়ায় সরকার পড়ে গিয়েছে। দামাস্কাসের মসজিদে গিয়ে জয় ঘোষণা করেন তাহরির আল-শামের প্রধান আবু মহম্মদ আল জোলানি। ইস্তফা দিয়ে দেশ ছেড়ে পালান গদিচ্যুত প্রেসিডেন্ট আসাদ।
বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা সংঘাত বড় প্রভাব ফেলে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে। গাজায় হামাসের কোমড় ভেঙে দিয়েছে ইজরায়েল। যাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিল লেবাননের হেজবোল্লা। ইরানের মদতপুষ্ট এই জঙ্গি সংগঠনটির প্রধান হাসান নাসরাল্লাকে খতম করে ইজরায়েলি সেনা। ফলে দুর্বল হয়ে যায় হেজবোল্লা। প্রায় একদশক ধরে ইরানের নির্দেশে আসাদ সরকারের হয়ে লড়াই ছিল তারা। কিন্তু লেবাননের লড়াই ছেড়ে আসাদের পাশে দাঁড়ানো হেজবোল্লার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাই তারা সিরিয়া থেকে সরে আসার ঘোষণা করতেই হামলা শুরু করে আল শাম। এদিকে দীর্ঘ দুবছর ধরে ইউক্রেনের সঙ্গে লড়াই করায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে গণ্য হয় গিয়েছে সিরিয়া। ফলে সব দিক থেকে সাঁড়াশি চাপে পড়েন আসাদ। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগায় বিদ্রোহীরা। মাত্র ১৩ দিনেই আসাদ সাম্রাজ্যের পতন ঘটায় তারা। কিন্তু গণতন্ত্র ফেরানোর লড়াই এখন কার্যত হাইজ্যাক করে নিয়েছে জেহাদিরা। যা সিরিয়ার নাগরিকদের পাশাপাশি গোটা বিশ্বের কাছে নতুন করে ত্রাস হয়ে উঠতে পারে।