shono
Advertisement

নতুন করে ইতিহাস লিখতে হচ্ছে কেন শি জিনপিংকে?

বলিউডের কোনও ‘কামব্যাক ড্রামা’-র চেয়ে কম রোমহর্ষক নয় জিনপিংয়ের জীবন।
Posted: 10:14 AM Nov 13, 2021Updated: 10:14 AM Nov 13, 2021

চিনের কমিউনিস্ট পার্টির ১০০ বছর উপলক্ষে যে-ইতিহাস লেখা হচ্ছে, সেই ইতিহাস নিয়ে প্লেনামে বর্তমান শাসক শি জিনপিং-কে মাও সে তুং এবং দেং জিয়াও পিংয়ের তুলনীয় মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নতুন করে ইতিহাস লিখতে হচ্ছে কেন? লিখছেন সুমন ভট্টাচার্য

Advertisement

 

বীরভূম এবং বর্ধমানের সমাজচর্চার বৃত্তে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই আলোড়ন চলছে পাণ্ডুরাজার ঢিবি নিয়ে। পাণ্ডুরাজার ঢিবিকে ঠিকমতো সংরক্ষণ করতে হবে, পুরাতত্ত্ব বিভাগকে সব দেখেশুনে, খনন করে ও ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষা করে ইতিহাস চর্চার সুযোগ দিতে হবে- এরকম দাবিতে অসংখ্য পোস্টার পড়েছে। বাংলার ইতিহাসকে বদলে দিতে পারে পাণ্ডুরাজার ঢিবির প্রত্নতাত্ত্বিক খনন, এমনই বহু গবেষকের বিশ্বাস। এই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্তেজিত মতবিনিময় দেখতে দেখতে ভাবছিলাম, সত্যিই তো, ইতিহাসকে নতুন করে লেখার এবং দেখার চেষ্টাই বারে বারে রাজনীতিতে নতুন মোড় এনে দিয়েছে। ছোটবেলায় পড়া কথাগুলো আবার মাথার মধ্যে নড়চড়ে বসে, যে, ইতিহাসই আসলে রাজনীতির সবচেয়ে বড় ল্যাবরেটরি, পরীক্ষাগার।

বর্ধমান থেকে বেজিংয়ে নজর ঘোরালে ইতিহাস লেখাটা কেন শাসকের জন্য জরুরি, সেটা আরও পরিষ্কার হয়ে যায়। চিনা কমিউনিস্ট পার্টির ১০০ বছর উপলক্ষে যে-ইতিহাস লেখা হচ্ছে, সেই ইতিহাস নিয়ে প্লেনামে বর্তমান শাসক শি জিনপিংকে মাও সে তুং এবং দেং জিয়াও পিংয়ের তুলনীয় মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, দলের ১০০ বছরের ইতিহাস লিখতে গিয়ে কমিউনিস্ট চিনের প্রতিষ্ঠাতা, কিংবদন্তি নেতা মাও সে তুং এবং মাও-পরবর্তী জমানায় যিনি দেশকে ‘বাজার অর্থনীতি’-তে দীক্ষিত করলেন, সেই দেং জিয়াও পিংয়ের মতো ‘আইকনিক’ নেতার সমান গুরুত্ব দেওয়া হল শি জিনপিংকে।

[আরও পড়ুন: ছ’টি যুদ্ধ লড়তে প্রস্তুত হচ্ছে চিন, তৈরি থাকতে হবে ভারতকেও]

কম বড় কথা নয়! এশিয়ার এই সর্ববৃহৎ রাষ্ট্র এবং নিশ্চিতভাবেই সবচেয়ে বড় অর্থনীতির কান্ডারি, অর্থাৎ চিনের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধানকে যে-ভাষায় তাঁর দল প্রশংসা করেছে, তা চমকে দেওয়ার মতো। প্লেনামে দেশের ৩৭০ জন শীর্ষদলীয় নেতা যেভাবে শি জিনপিংয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাতে ধরে নেওয়া হচ্ছে, ২০২২ সালে আরও পাঁচ বছরের জন্য তাঁর শীর্ষপদে বসা শুধু সময়ের অপেক্ষা।
কিন্তু আরও পাঁচ বছর, না আজীবন?

এই প্রশ্নের উত্তর কেউ জানে না। কারণ, দু’-বারের বেশি দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়া যাবে না, এই বিধিকে ২০১৮ সালেই শি সংশোধন করিয়ে নিয়েছেন। তাই পূর্বতন জিয়াং জেমিন বা হু জিনতাওয়ের মতো দু’বারের পরে তিনি সরে দাঁড়াবেন, এমন বাসনা চিনের বর্তমান সর্বোচ্চ নেতার যে নেই, তা ইতিমধ্যেই পরিষ্কার। কিন্তু ২০২২ থেকে পাঁচ বছর শাসনের তৃতীয় দফা পার করার পরেও যে তিনি পদ ছেড়ে অবসর নিয়ে একান্ত জীবনযাপন করতে চাইবেন- তার কি ইঙ্গিত মিলছে? এমনকী, হু জিনতাওয়ের শাসনের সময়ে, ২০১০ সালে, যেমন পরবর্ত মুখ হিসাবে শি জিনপিং সামনে চলে এসেছিলেন, চিনের কমিউনিস্ট পার্টিতে বর্তমানে তেমন কোনও উত্তরসূরিরও দেখা নেই। সেই পরিস্থিতিতে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস লিখতে গিয়ে যদি মাও সে তুংয়ের মতোই ‘কাল্ট’ হিসাবে শি জিনপিংকে দেখানো হতে থাকে, তাহলে কী ধরে নেব? যিনি চিনে কমিউনিস্ট শাসনের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই অবিসংবাদিত নেতা মাও সে তুংয়ের মতোই এখন দলে শি জিনপিংয়ের একাধিপত্য। এবং মাও যেমন আমৃত্যু ক্ষমতায় ছিলেন, তেমনই শি জিনপিংও থাকতে চান।

বেজিং এবং মস্কোতে একই নেতা দুই বা তিন যুগ থাকলে পরে উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কী কী নবদিগন্তের সূচনা হতে পারে, সেই নিয়ে শি জিনপিং বা ভ্লাদিমির পুতিনের পৃষ্ঠপোষকতায় গবেষণাপত্র প্রকাশ পাবে কি না- তা আগামী দিনই বলবে। কিন্তু একটি সাবেক কমিউনিস্ট-শাসিত রাষ্ট্র, মানে রাশিয়া আর একটি বর্তমানে কমিউনিস্ট রাষ্ট্র, চিন, দু’টির ক্ষেত্রেই শাসকের ‘মডেল’ অভিন্ন। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ, মানে ততক্ষণই ক্ষমতায়। আধুনিক পৃথিবীতে এই যে নিজেকে ‘রাজা’ মনে করা, এটা কোন ধরনের মানসিকতার পরিচয় দেয়, কেন কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থায় এই ধরনের ‘ডিক্টেটর’ বা একতান্ত্রিক শাসকের বারবার আবির্ভাব হয়, তা নিয়েও লম্বা প্রতর্ক হতে পারে। আপাতত বলা যায়, শি জিনপিং চিনের একদলীয় শাসনব্যবস্থায় নতুন ‘ডিক্টেটর’ এবং কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে ছাড়া আর কাউকে দেখছে না, তা দিনের আলোর মতো সত্য।

শাসক যখন এই ধরনের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ বা ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’-র চেহারা নেয়, তখন ইতিহাস নতুন করে লেখাটাও জরুরি হয়ে পড়ে। সেটা পৃথিবীর যে-কোনও দেশের ক্ষেত্রেই সত্যি, কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে হয়তো আরও বেশি করে বাস্তব। মাও-কে ‘সুপ্রিম লিডার’ বা অবিসংবাদী নেতা রূপে তুলে ধরে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির বিখ্যাত প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছিল ১৯৪৫ সালে, আর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের হিংসাদীর্ণ দিনগুলোর পরে দেং জিয়াও পিং তাঁর নতুন রাস্তায় হাঁটার ঘোষণাপত্রকে পাস করিয়ে নিয়েছিলেন ১৯৮১ সালে। ‘দ্য নিউইয়র্ক টাইমস’ বা ‘বিবিসি’-র মতো সংবাদমাধ্যম সেসব ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের সঙ্গে বৃহস্পতিবার বেজিংয়ে শেষ হওয়া প্লেনামের যে তুলনা করছে, তার একটাই কারণ। সবকিছুর উপরে এমন শি জিনপিংয়ের অমোঘ সিলমোহর।

ইতিহাস লেখাটা যে জরুরি, সেটা অবশ্য শি জিনপিং নিজের জীবন দিয়ে জানেন। কারণ, একদা মাওয়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, চিনা কমিউনিস্ট পার্টির উজ্জ্বলতম তারকা শি জংজুনকে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় জেল খাটতে হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, মাও-বিরোধী ইতিহাস লিখতে মদত দেওয়া।

সাম্প্রতিকের মহাপ্রতাপশালী চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শি জিনপিংয়ের বাবা এই শি জংজুন। জংজুন আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছেলে তাঁকে চিঠিতে লিখেছিল, সবাই যখন তাঁকে পিতৃপরিচয় তুলে গালাগালি দিত, তখনও তিনি জানতেন, আসলে তাঁর বাবা-ই ‘রোল মডেল’। শি জিনপিংয়ের ব্যক্তিজীবনকে যদি কেউ কাটাছেঁড়া করে তাহলে দেখা যাবে, আসলে সেটা বলিউডের কোনও ‘কামব্যাক ড্রামা’-র চেয়ে কম রোমহর্ষক নয়। বাবা জেলে, ছেলেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে দূরতম প্রদেশে কঠিনতম চাকরি দিয়ে। কিন্তু ছেলে ভেঙে পড়ছে না, পার্টির বিরুদ্ধাচরণ করছে না, বরং বারে বারে আবেদন করে যাচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের সুযোগ পাওয়ার জন্য। ৯ বার শি জিনপিংয়ের আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ার পরে ১০ বারের বেলায় শিকে ছিঁড়ছে। একে ধন্যি ছেলের অধ্যবসায় বলতে পারেন, সবুরে মেওয়া ফলে বললেও অত্যুক্তি হয় না!

সেই শি জিনপিং যে তাঁর ন’বছরের শাসনে আইকনিক শাসক হয়ে দল এবং সরকারের উপরে একচেটিয়া কর্তৃত্ব কায়েম করতে চাইবেন, সেটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। বিশেষ করে বাবার জীবন তাঁকে শিখিয়ে দিয়েছে, লাল চিনে দলকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই সবচেয়ে জরুরি। সেটা পেরেছেন বলেই কমিউনিস্ট পার্টি নিজের ইতিহাস লিখতে গিয়ে শি জিনপিং-এর দুই পূর্বসূরি, জিয়াং জেমিন এবং হু জিনতাওয়ের চেয়ে বর্তমান শাসককে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। অথচ মনে রাখতে হবে, দেং-পরবর্তী জমানার এই দুই নেতা শুধু চিনকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অন্তর্ভুক্ত করেননি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ দেখিয়েছিলেন। হংকং এবং ম্যাকাও-কে চিনে ফেরত এনেছিলেন। কিন্তু জিয়াং জেমিন বা হু জিনতাওয়ের মতো নেতাকে পিছনে ঠেলে দিয়ে, তাঁদের ২০ বছরের শাসনকে বামন বানিয়ে দিয়ে যখন শি সব প্রচারকে নিজের দিকে টেনে নেন, তখন এটাও ধরে নেওয়া স্বাভাবিক, তিনি হালফিলের ‘মাও সে তুং’। এক এবং অবিসংবাদী।

মাও যাঁকে ইতিহাস লেখার অভিযোগে জেল খাটিয়েছিলেন, তাঁর ছেলে যদি ফিরে এসে সেই কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাসে নিজেকে মাওয়ের সমান উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন, তাহলে আসলে এটা ইতিহাসের মধুরতম প্রতিশোধ বলা যেতে পারে। কিন্তু এই গল্পে আরও কিছু নাটকীয় মোচড় আছে। শি জিনপিংয়ের আমলকে যেসব বিষয়ের জন্য সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হয়, তার মধ্যে অন্যতম- ব্যক্তিস্বাধীনতাকে একেবারে দুমড়েমুচড়ে দেওয়া। কোভিডকে গোপনীয়তার আবরণে ঢেকে রাখা আসলে এই লৌহযবনিকা তৈরি করা, যেখানে ব্যক্তি একটা সংখ্যামাত্র। চিনের কমিউনিস্ট পার্টি যে এটাই চায়, সেটা অবশ্য আমরা জেনে গিয়েছিলাম ১৯৮৯ সালে, তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের ছাত্রদের আন্দোলন দমনের সময় থেকে। যাঁরা চিনের রাজনীতির খবরাখবর রাখেন, তাঁরা জানেন, গণতন্ত্রের দাবিতে বেজিংয়ের রাস্তায় ছাত্রদের এই আন্দোলনকে সে-দেশের কমিউনিস্ট পার্টির পদত্যাগী সাধারণ সম্পাদক হু ইয়াওবাংয়ের সমর্থকদের বিক্ষোভ বলে মনে করা হয়। একদিকে যেমন দেং জিয়াও পিং সেই আন্দোলনকে একেবারে ট্যাঙ্ক দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন, তেমনই হু ইয়াওবাংকে বিস্মৃতির অতলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ইতিহাস বলে, ১৯৮৭-তে হু ইয়াওবাং পদত্যাগ করার আগে পর্যন্ত চিনা কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো এবং কেন্দ্রীয় কমিটিতে তাঁর সোচ্চার সমর্থক ছিলেন মাত্র একজন, শি জংজুন, বর্তমানের সাধারণ সম্পাদকের বাবা, হুয়ের পদত্যাগের পর, অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের ঘটনার আগের বছর রাজনীতি থেকে অবসর নেন শি জংজুন।

‘পার্টি’, মানে চিনের কমিউনিস্ট পার্টি কী চায়, সেটা তাই শি জিনপিং অস্থি-মজ্জায় জানেন। এখনকার চিনে তাঁর অবিস্মরণীয় উত্থান তাই একটা পুরনো বাংলা গানকে মনে করিয়ে দিতে পারে। ‘প্রতিশোধ’ সিনেমায় কিশোরকুমারের কণ্ঠে সুখেন দাস গেয়েছিলেন: ‘হয়তো আমাকে কারও মনে নেই,/ আমি যে ছিলাম এই গ্রামেতেই/ এই মাটিতেই জন্ম আমার,/ তাই তো ফিরে এলাম আবার…।’

[আরও পড়ুন: জ্বালানির দাম কমিয়েছে সরকার, এতদিন পর এই সামান্য তৎপরতা কি কাজে দেবে?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement