বছরভর হাজারও ঘটনা৷ শুধু ঘটনা বললে ভুল হবে, দুর্ঘটনার ঘনঘটাও কম কিছু নয়৷ পরিসংখ্যান দেওয়া কঠিন৷ তবুও তারই মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা দাগ কেটেছে আম আদমির জীবনে৷ বছর শেষে সেগুলিরই স্মৃতিচারনা করল সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল।
তুষার ধসে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে মৃত শতাধিক
বছরের শুরুতে বড় কোনও ঘটনা না ঘটলেও ৫ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ তুষার ঝড় আছড়ে পড়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তানের আশপাশের অঞ্চলে। লাগাতার তুষারপাত ও ধসের কারণে এই দুই দেশে মারা যান ১০০ জনেরও বেশি লোক৷ দুই দেশের সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে সংবাদসংস্থা জানিয়েছে, পূর্ব আফগানিস্তানেই মারা যান অন্তত ৫০ জন৷ নিখোঁজ হন অন্তত ৩০ থেকে ৪০ জন৷ দুর্যোগের কারণে আফগানিস্তানের বাদাখস্তান প্রদেশের ১২ টি জেলা বিশ্বের বাকি অংশ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ সেখানে টেলি যোগাযোগ ও বিদ্যুত্ সরবরাহ ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত হয়ে যায়৷ এক ফুট বরফের তলায় চলে যায় রাজধানী কাবুলও৷ ব্যাহত হয় জনজীবন৷ বন্ধ রাখতে হয় সরকারি অফিস, স্কুল, কলেজ, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলিকে৷ একই অবস্থা হয় পাক অধিকৃত কাশ্মীরের চিত্রল ও খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের বেশ কয়েকটি জায়গারও৷
লালকেল্লার অন্দর থেকে উদ্ধার বাক্সভর্তি গ্রেনেড
দিনটা ছিল ফেব্রুয়ারির ৬ তারিখ। সাত সকালে লালকেল্লা থেকে উদ্ধার হয় বাক্সভর্তি গ্রেনেড৷ ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্য ছড়ায় গোটা রাজধানীতে৷ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াড, দমকল আধিকারিক এবং নিরাপত্তারক্ষীরা। ওদিন সেখানে সাফাইয়ের দায়িত্বে থাকা এক কর্মীর চোখে পড়ে গ্রেনেড ভর্তি বাক্সটি৷ তিনিই সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ফোন করেন দিল্লি পুলিশের কন্ট্রোল রুমে৷ জানান, লালকেল্লার পুরনো কুয়োর একটি বাক্সে কিছু বিস্ফোরক পাওয়া গিয়েছে৷ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থলে পৌঁছয় দমকলের বড় টিম, বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াড৷ ঘটনাস্থলে পৌঁছে আরও ২-৩টি গ্রেনেড ভর্তি বাক্স উদ্ধার করেন বম্ব ডিসপোজাল স্কোয়াডের আধিকারিকরা৷ প্রাথমিক তদন্তের পর সেনা অনুমান করে, বিস্ফোরকগুলি সেনাবাহিনীরই সম্পত্তি৷ কোনওভাবে পরিত্যক্ত অবস্থায় সেগুলি রয়ে গিয়েছিল৷
মার্কিন সেনাই সর্বশক্তিমান, আফগানিস্তানে ‘মাদার অফ অল বম্বস’ ফেলে হুঙ্কার ট্রাম্পের
এপ্রিল মাসের ১৩ তারিখ পূর্ব আফগানিস্তানের ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে বড়সড় হামলা চালায় আমেরিকা। ২১ হাজার ৬০০ পাউন্ডের (প্রায় ১০ হাজার কিলোগ্রাম) GBU-43 বোমা নিক্ষেপ করে ওয়াশিংটন৷ বোমাটি পরমাণু বোমার পরই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বোমা৷ বিশ্বের সবচেয়ে বিধ্বংসী এবং মারণক্ষমতাসম্পন্ন এই ভয়াবহ বোমাকে সামরিক পরিভাষায় বলে ‘ম্যাসিভ অর্ডিন্যান্স এয়ার ব্লাস্ট’৷ মার্কিন বায়ুসেনা ও মার্কিন সামরিক সদর দফর পেন্টাগনের কর্তারা এই বোমাকে আদর করে ডাকেন ‘মাদার অফ অল বম্বস’ (সব বোমার মা)৷ এটি জিপিএস নিয়ন্ত্রিত৷ এই হামলার পরই রাতের অন্ধকার আকাশ ভেদ করে বিশালাকায় আগুনের গোলা উপরের দিকে উঠে যায়৷ সর্বগ্রাসী আগুনের বলয় ছিল অন্তত চারশো মিটার জুড়ে৷ আশপাশের কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকার মাটি কেঁপে ওঠে৷ ভূমিকম্পের ভয়ে আতঙ্কে ছোটছুটি শুরু করেন স্থানীয় গ্রামের অজস্ত্র বাসিন্দা৷ কিন্তু বেশ কয়েক মিনিট পরেই বাসিন্দাদের ভুল ভাঙে৷ পরে জানা যায়, কোথাও একটা শক্তিশালী বিস্ফোরণ হয়েছে৷ বাতাসে তখন শুধুই পোড়া বারুদের অসহ্য দুর্গন্ধ৷ হিরোসিমা এবং নাগাসাকির পর এত বড় বোমা এর আগে আমেরিকা কোনও দেশের বিরুদ্ধে নিক্ষেপ করেনি৷
ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মৃত্যু মডেল সোনিকার, গ্রেপ্তার অভিনেতা বিক্রম
এপ্রিল ২৯, ২০১৭। দিনটি ছিল শনিবার। আর ভোরের আলো ফুটতেই টলিউডে নেমে আসে শোকের ছায়া। পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন মডেল তথা অভিনেত্রী সোনিকা সিং চৌহান৷ কিন্তু এটি কি নিছকই দুর্ঘটনা ছিল? বিভিন্ন মহলে এরপর প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। তদন্তে নামে পুলিশ। সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা, প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান, বিক্রমের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। অভিযোগ ওঠে বিক্রমের গাফিলতির কারণেই প্রাণ হারাতে হয় সনিকাকে। যদিও প্রথমে নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেন বিক্রম। এরপরই তাঁর নামে মামলা রুজু হয়। পুলিশের সঙ্গে একরকম লুকোচুরি খেলতে শুরু করেন অভিনেতা। শেষমেশ অবশ্য বন্ধুর ফোনে আড়ি পেতে অভিনেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর জুলাই মাসে বিক্রমের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেয় টালিগঞ্জ থানার পুলিশ। চার্জশিটে অনিচ্ছাকৃত খুনের উল্লেখ করা হয়। গাড়ি দুর্ঘটনার সময় সেই জায়গায় উপস্থিত পুরসভার এক ঝাড়ুদার, এক ট্যাক্সিচালক-সহ মোট আটজনের বয়ানের ভিত্তিতে তৈরি করা হয় চার্জশিট। পাশাপাশি গাড়ির গতিবেগের ফরেনসিক রিপোর্ট, রক্তের নমুনা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্যও উল্লেখ করা হয়। বেশি কিছুদিন জেলে থাকার পর শেষপর্যন্ত জামিনে মুক্তি পান।
উৎকল এক্সপ্রেসের ১০টি বগি লাইনচ্যুত
১৯ আগষ্ট উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরের কাছে খতৌলিতে উলটে যায় পুরী-হরিদ্বার-কলিঙ্গ উৎকল এক্সপ্রেস। লাইনচ্যুত হয় ট্রেনটির ১০টি কামরা। মারা যান কমপক্ষে ২৩ জন মানুষ। আহত হন শতাধিক যাত্রী। দুর্ঘটনার ব্যাপকতা দেখলে চমকে উঠতে হয়। দুর্ঘটনার পর রেলের একটির কামরার উপর আর একটি কামরা উঠে যায়। যা দেখে বোঝা যায়, ট্রেনটি বেশ দ্রুতই চলছিল। মৃতদের জন্য ৩.৫ লক্ষ টাকা ও আহতদের জন্য ৫০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করেছেন রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু। নিহতদের জন্য গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রাথমিকভাবে নাশকতার আশঙ্কাই করেছিলেন রেল ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কর্তারা। ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন সন্ত্রাসদমন শাখার আধিকারিকরাও। কিন্তু নাশকতা নয়, রেলের গাফিলতিতেই উৎকল এক্সপ্রেসের ১০টি কামরা লাইনচ্যুত হয়।
অরুণাচল প্রদেশে বায়ুসেনার চপার ভেঙে নিহত ৭
৬ অক্টোবর অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াংয়ের কাছে ভেঙে পড়ে বায়ুসেনার একটি চপার। চপারটি ভেঙে মারা যান সাতজন। চিনা সীমান্তের কাছেই ভেঙে পড়ে চপারটি। ওঠে গাফিলতির অভিযোগ। প্রকাশ্যে আসে ওই চপার ক্র্যাশের একটি হাড় হিম করা ভিডিও। ওই ভিডিওয় দেখা যায়, রাশিয়ান কপ্টারটি একটি নিরেট ইটের মতো মাটিতে আছড়ে পড়ছে। ভিডিওটির সত্যতা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক শীর্ষ কর্তা স্বীকারও করে নেন। ভেঙে পড়ার আগে বেশ খানিকক্ষণ আকাশে চক্কর কাটছিল কপ্টারটি। সেই মুহূর্তের ছবি ধরা পড়ে ওই ভিডিও-য়। কপ্টারটি সেনা পোস্টে কেরোসিনের জার ফেলার কাজ করত। কিন্তু পরপর কয়েকটি জার ফেলার পর একটি জার নিচে পড়ার সময় তার প্যারাসুটটি আচমকাই খুলে চপারের লেজের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। মুহূর্তে চপারের পিছনের অংশে আগুন ধরে যায়। চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, জ্বালানির জারের হ্যান্ডেল কি খারাপ ছিল? নাকি চালক ও কর্মীরা কীভাবে মাঝ আকাশ থেকে জ্বালানির জার নিচে ফেলতে হয় তার উপযুক্ত প্রক্রিয়া জানতেন না বা মেনে চলেননি। সেনা পোস্টে জ্বালানির জার ফেলার আগে কি ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছিল? এছাড়া এই ঘটনায় দেখা দেয় কফিন বিতর্কও। কেন শহিদ জওয়ানদের মৃতদেহ কফিনের বদলে কার্ডবোর্ডে করে আনা হয়েছিল, ওঠে সেই প্রশ্ন।
প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে তলিয়ে গেল জাহাজ, নিখোঁজ হন ১১ জন ভারতীয় নাবিক
১৩ অক্টোবর বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে তলিয়ে গেল পণ্যবাহী জাহাজ। মাঝসমুদ্রে ঝড় ওঠায় ফিলিপিন্সের কাছে প্রশান্ত মহাসাগরেই ডুবে যায় জাহাজটি। দুর্ঘটনার পর নিখোঁজ ১১ জন ভারতীয় নাবিক। এমারেল্ড স্টার নামে জাহাজটির ওজন প্রায় ৩৩,২০৫ টন। সেদিন গভীর রাতের দিকে একটি বিপদসংকেত আসে জাহাজটি থেকে। ফিলিপিন্সের উত্তর দিক থেকে ২৮০ কিলোমিটার পূর্বে যাচ্ছিল জলযানটি। ওই এলাকায় আরও তিনটি জাহাজও ছিল। দুর্ঘটনার পর ১৫ জনকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু ১১ জন ভারতীয় কর্মী নিঁখোজ হয়ে গিয়েছিলেন।
উত্তরপ্রদেশ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিস্ফোরণে মৃত ২২
১ নভেম্বর উত্তরপ্রদেশে ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশনের (এনটিপিসি) তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে ভয়াবহ বিস্ফোরণে মারা যান ২২ জন কর্মী। মৃতদের পরিবারকে ২ লক্ষ টাকা ও আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে আশেপাশের এলাকা ধুলোর নিচে চাপা পড়ে যায়। পরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান উচ্চপদস্থ আধিকারিকরা। গিয়েছিলেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধিও।
সুদীপ দত্ত ভৌমিক, সাংবাদিক হত্যা ত্রিপুরায়
২১ নভেম্বর খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান ত্রিপুরার সাংবাদিক সুদীপ দত্ত ভৌমিক। চলতি বছরেই খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন এক সাংবাদিক শান্তনু ভৌমিক। তবে সেবার অভিযোগের তির আইপিএফটি সমর্থকদের দিকে। আর সুদীপ্তর ক্ষেত্রে ট্রিগারে হাত ছিল খোদ পুলিশের। খবর দেওয়ার নাম করেই সুদীপকে ডাকেন ত্রিপুরা স্টেট রাইফেলসের দ্বিতীয় বাহিনীর কমান্ডার তপন দেববর্মা। এর আগেও বেশ কয়েকটি আর্থিক কেলেঙ্কারির কথা ফাঁস করেছিলেন তিনি। নতুন খবরের প্রত্যাশাতেই সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন ক্রাইম বিভাগের ওই সিনিয়র সাংবাদিক। তাঁকে গোপন খবর দেওয়ার নাম করে ডেকে নেওয়া হয় কমান্ডারের নিজস্ব ঘরে। সেখানেই চলে হত্যালীলা। নিজের অফিসঘরে ডেকে তাঁকে গুলি করে মারার নির্দেশ দেন কমান্ডার। গুলি করেন নিরাপত্তা রক্ষী নন্দকুমার রিয়াং। গুলির শব্দ শুনে ক্যাম্পের অন্যান্যরা ছুটে আসেন। নিরাপত্তারক্ষীর হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু সুদীপকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় অনেক দেরিতে। ততক্ষণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ‘স্যন্দন’ নামে যে পত্রিকায় ওই সাংবাদিক কাজ করতেন, তাঁর সম্পাদক সুবলকুমার দেবের অভিযোগ ছিল, পূর্বপরিকল্পিতভাবেই খুন করা হয়েছে ওই সাংবাদিককে। ক্যাম্পের অভ্যন্তরের কেলেঙ্কারি ফাঁস করারই মাশুল দিতে হয় তাঁকে। ’স্যন্দন’ পত্রিকার সম্পাদকীয় কলাম কালো রাখা হয়। প্রতিবাদে শামিল হয় ‘ত্রিপুরা দর্পণ’, ‘দৈনিক সংবাদ’-এর মতো সংবাদপত্রগুলি। কোনওটির সম্পাদকীয় কলাম কালো, কোনওটিরই বা সাদা করে রাখা হয়েছিল। তাঁর পরিবারের পাশে দাঁড়ান বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিহত সাংবাদিকের মায়ের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ ফোনে কথা বলেন। পরিবারের সকলের সঙ্গে দেখা করেন ত্রিপুরায় তৃণমূলের পর্যবেক্ষক তথা বিধানগরের মেয়র সব্যসাচী দত্ত। নিহত সুদীপবাবুর ভাইকে পশ্চিমবঙ্গে চাকরি দেওয়ারও প্রস্তাব দেন মুখ্যমন্ত্রী।
The post ফিরে দেখা ২০১৭: বছর জুড়ে যে সব ঘটনার ঘনঘটা appeared first on Sangbad Pratidin.