রক্তাল্পতা শুধু মহিলাদের ক্ষেত্রেই বাড়বাড়ন্ত নয়, শিশুদের শরীরেও এই অসুখ মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এ বিষয়ে অনেকেই অবগত নন। তাই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রসূন ভট্টাচার্য সতর্ক করলেন। শুনলেন জিনিয়া সরকার।
এদেশে তথা এ রাজ্যে মহিলাদের মধ্যে রক্তে আয়রনের ঘাটতি বা রক্তাল্পতার (Anemia) সমস্যা অন্যতম। কিন্তু এটা শিশুদের মধ্যেও বেশ বেশি। বলা ভালো, এ রাজ্যে শিশুদের শরীরেরও রক্তের ঘাটতি মারাত্মকভাবেই দেখা যায়। যা অনেকেরই জানা নেই। তাই সমস্যা হলেও তেমন গা করেন না অভিভাবকরা।
কোন বয়সে শিশুর ঝুঁকি বেশি?
শিশুদের অ্যানিমিয়া বয়স ভেদে নানা রকম হতে পারে। নিওনেট (জন্মের একমাসের মধ্যে) অথবা ইনফ্যান্সি অর্থাৎ জন্ম থেকে এক বছর বয়সের মধ্যে শিশুর অ্যানিমিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যাটা বেশ বেশি। তার পর এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে অ্যানিমিয়া হতে পারে। আবার পাঁচ থেকে বারো বছর বয়সের মধ্যেও অ্যানিমিয়া হয়। – এই বয়স ভেদে অ্যানিমিয়ার প্রকার নির্ভর করে। এছাড়াও প্রিম্যাচিওর বেবি হলে তাদের মধ্যেও রক্তাল্পতার সমস্যা প্রকাশ পায়।
বয়সের সঙ্গে কারণ আলাদা
এ রাজ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু অ্যানিমিয়ার সমস্যায় ভোগে। বেশিরভাগ শিশুরই অ্যানিমিয়ার পিছনে অন্যতম কারণ থাকে অপুষ্টি। আর একটি সমস্যাও রয়েছে, তা হল কৃমি সংক্রমণ। যদিও দ্বিতীয় কারণটি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। সাধারণত ১-৩ বছর বয়সের মধ্যে যে অ্যানিমিয়া দেখা যায় তা মূলত অপুষ্টিজনিত অথবা থ্যালাসেমিয়ার কারণ হতে পারে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের যথেষ্ট সচেতন হতে হবে। কারণ, একদিকে মায়ের স্তন্যপান থেকে শিশু যখন স্বাভাবিক আহারে প্রবেশ করছে, আর আরেক দিকে ভূমিষ্ঠকালে ফিটাল হিমোগ্লোবিন থেকে স্বাভাবিক অ্যাডাল্ট হিমোগ্লোবিনে পরিণত হচ্ছে। এই পরিবর্তনকালীন সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া শিশুর এমন হওয়ার পিছনে থাকে কনজেনিটাল অ্যানিমিয়া, কোনও সংক্রমণ থেকেও অ্যানিমিয়া হতে পারে।
আবার মায়ের যদি Rh নেগেটিভ হয় অর্থাৎ লোহিত রক্তকণিকায় আরএইচ ফ্যাক্টর অনুপস্থিত থাকে সেই মহিলার সন্তান Rh পজিটিভ হলে সাধারণত হেমোলেটিক ডিজিজ ও ফিটাস অ্যান্ড নিউবর্নে আক্রান্ত হয় শিশু। এক্ষেত্রে সদ্যোজাতর শরীরে লোহিত রক্তকণিকা তৈরি হওয়ার আগেই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে রক্তাল্পতা প্রকট হয়। এই অ্যানিমিয়া গর্ভাবস্থা থেকেই শুরু হয়। তাই অনেক সময়ই এই কারণে ভ্রূণ নষ্টও হয়ে যায়। আর এই সমস্যা নিয়ে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে সদ্যোজাতর জন্ডিস প্রকাশ পায়। এই জন্ডিস মারাত্মক রকমের হয়।
শিশুকালে অ্যানিমিয়ার আরও একটি কারণ হল থ্যালাসেমিয়া। এতে একজনের শরীরে অ্যাডাল্ট হিমোগ্লোবিনের মাত্রা যা থাকার কথা, সেটা অনেক কম মাত্রায় থাকে। যখন সদ্যোজাতর শরীর থেকে ফিটাল হিমোগ্লোবিনের মাত্রা চলে যেতে থাকে ও অ্যাডাল্ট হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়তে থাকে তখনই সমস্যা প্রকট হয়। শিশু যখন জন্মায় তার হিমোগ্লোবিনকে বলা হয় ফিটাল হিমোগ্লোবিন। জন্মের পর সেটাই ক্রমে ক্রমে অ্যাডাল্ট হিমোগ্লোবিনে পরিণত হয়।
[আরও পড়ুন: হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলেন কবীর সুমন, কেমন আছেন ‘গানওয়ালা’? ]
এছাড়া গর্ভস্থ শিশু যদি সময়ের আগে জন্মগ্রহণ করে (গর্ভাবস্থার ২৮-৩০ সপ্তাহের মধ্যে জন্ম নেওয়া শিশু) অর্থাৎ প্রিম্যাচিওর শিশু হলে প্রিম্যাচিওর অ্যানিমিয়ার প্রকোপ পড়ে। এদের শরীরে উপযুক্ত পরিমাণে রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরি হয় না।
হতে পারে সিকেল সেল অ্যানিমিয়াও। এক্ষেত্রে আরবিসি (এক বিশেষ ধরনের হিমোগ্লোবিন) যা অ্যাডাল্ট হিমোগ্লোবিনের অন্যতম উপাদান, রক্তের এই উপাদান সিকেল সেল ডিজিজে উপস্থিত থাকে না।
সদ্যোজাতর অ্যানিমিয়া রোধে মায়ের জরুরি
তাই একটা কথা সকলের জানা দরকার, যখন একজন মা হচ্ছেন বা গর্ভে সন্তান রয়েছে, তখন মায়ের রক্তের গ্রুপ ও অ্যান্টিবডি স্ক্রিনিং টেস্ট করা খুব জরুরি। যদি মায়ের রক্তে কোনওরকম অসামঞ্জস্য থাকে, সে ক্ষেত্রে তখনই সচেতন হওয়া সম্ভব।
এছাড়া কনজিনিটাল ইনফেকশনের জন্য রুবেলা, সাইটোমেগালো ভাইরাস মায়ের শরীরে রয়েছে কি না তা নির্ণায়ক টেস্ট ‘টর্চ’ (TORCH) করাও দরকার চিকিৎসকের পরামর্শ মতো।
যে বাবা-মা থ্যালাসেমিয়া কেরিয়ার হয় তাদের সন্তানের প্রায় ২৫ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার। এই কারণে অ্যানিমিয়াও প্রকাশ পায়।
চিকিৎসা
শিশুর অ্যানিমিয়ার সমস্যায় রক্ত দেওয়ার দরকার পড়ে না। কিন্তু উপযুক্ত চিকিৎসা খুবই জরুরি। পুষ্টির অভাবে অ্যানিমিয়া হলে সেক্ষেত্রে আয়রনজনিত খাবার খাওয়া আবশ্যক। যেমন, চিনির বদলে গুড়, খেজুর, শাক, মাংসের মেটে, মাছ খাওয়াতে হবে শিশুকে।
অন্যান্য কারণজনিত (কনজিনিটাল বা সংক্রমণজনিত) অ্যানিমিয়ায় আগে কারণটার উপযুক্ত চিকিৎসা করতে হয়। শুধু খাবার খেয়ে এই ধরনের অ্যানিমিয়া প্রতিহত করা সম্ভব নয়। কখনও ব্লাড ট্রান্সফিউশনের প্রয়োজন পড়ে, কখনও ফোটোথেরাপি দ্বারা চিকিৎসার দরকার হয়। তাই লক্ষণ থাকলে চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়া জরুরি। না হলে শিশু শরীরে রক্তের অভাবে অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে।